Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৬২ বছরেও বন্ধ হয়নি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ

রাকিবুল ইসলাম
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:৩৬

আজ ১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস। ১৯৬২ সালের এই দিনে পাকিস্তানি শাসন, শোষণ ও শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হন ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুলসহ নাম না-জানা অনেকেই। তাদের স্মরণে এই দিনকে শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের মাত্র ২ মাস পর ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। শরীফ কমিশন নামে খ্যাত এসএম শরীফের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। এতে শিক্ষা বিষয়ে যেসব প্রস্তাবনা ছিল তা প্রকারান্তরে শিক্ষা সংকোচনের পক্ষে গিয়েছিল। প্রস্তাবিত প্রতিবেদনে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে ছাত্র বেতন বর্ধিত করার প্রস্তাব ছিল। ২৭ অধ্যায়ে বিভক্ত শরীফ কমিশনের ওই প্রতিবেদনে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত সাধারণ, পেশামূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রসঙ্গ, শিক্ষার মাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক, হরফ সমস্যা, প্রশাসন, অর্থবরাদ্দ, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। আইয়ুব সরকার এই রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ এবং তা ১৯৬২ সাল থেকে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে।

বিজ্ঞাপন

শরীফ কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতি কাঠামোতে শিক্ষাকে তিন স্তরে ভাগ করা হয়- প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর। ৫ বছরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও ৩ বছরে উচ্চতর ডিগ্রি কোর্স এবং ২ বছরের স্নাতকোত্তর কোর্সের ব্যবস্থা থাকবে বলে প্রস্তাব করা হয়। উচ্চশিক্ষা ধনিকশ্রেণীর জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এজন্য পাস নম্বর ধরা হয় শতকরা ৫০, দ্বিতীয় বিভাগ শতকরা ৬০ এবং প্রথম বিভাগ শতকরা ৭০ নম্বর। এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার প্রস্তাব করে। শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করাতে ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়েছিল। রিপোর্টের শেষ পর্যায়ে বর্ণমালা সংস্কারেরও প্রস্তাব ছিল।

বিজ্ঞাপন

বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন আইয়ুবের এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা কলেজসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্ব স্ব দাবির ভিত্তিতে জুলাই-আগস্ট মাস জুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে। এ আন্দোলন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ওই দিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশে যোগ দেন। সমাবেশ শেষে মিছিল বের হয়। জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে- এ গুজব শুনে মিছিল দ্রুত নবাবপুরের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু হাইকোর্টের সামনে পুলিশ এতে বাধা দেয়। তবে মিছিলকারীরা সংঘাতে না গিয়ে আবদুল গনি রোডে অগ্রসর হয়। তখন পুলিশ মিছিলের পেছন থেকে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে। এতে তিনজন নিহত হয়। ওই দিন সারাদেশে মিছিলে পুলিশ গুলি করে। টঙ্গীতে ছাত্র-শ্রমিকদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে এক শ্রমিকেরও মৃত্যু হয়। তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার শেষ পর্যন্ত শরিফ কমিশন রিপোর্টের বাস্তবায়ন স্থগিত ঘোষণা করে।

শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে বাষট্টির যে আন্দোলন, তা আজও অর্জিত হয়নি। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ঠেকানো যায়নি বরং বেড়েছে। বছর বছর শিক্ষা দিবস পালন হলেও যে জন্য এই দিবস, সেই লক্ষ্য কিন্তু অর্জিত হয়নি। শিক্ষালাভের অধিকার সংবিধান স্বীকৃত হলেও, বর্তমান বাজারে শিক্ষাও হয়ে উঠেছে পণ্য। দেশের যে কয়েকটি স্বায়ত্বশাসিত এবং সরকারি বিশ্বিবদ্যালয় গুলো রয়েছে সেগুলোতে প্রকৃত শিক্ষা ও মুক্তজ্ঞানচর্চা কোনটিই এখন নেই।

সারাদেশের আনাচে কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বে সরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আর কোচিং সেন্টার। ভাড়ায় চালিত ছোট্ট ফ্ল্যাটে হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বানিজ্য। এখানে মূল্য নেই রবীন্দ্রসংগীত কিংবা নজরুলসংগীতের, এখানে মূল্য নেই সাহিত্যে চর্চার, এখানে মূল্য নেই কবিতার, মূল্য নেই নাটকের। এখানে মূল্য আছে সেসব বিভাগের, যেসব বিভাগ দিয়ে লোভনীয় বেতনের চাকুরী পাওয়া যায়।

২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় বছরে ৩২শ’কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ১০৯ কোচিং সেন্টার। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে এসব ‘কোচিং’। একবার ভেবে দেখুন শুধু কোচিং সেন্টার যদি বছরে ৩২শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় তাহলে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরে কত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে? গত ১৬বছরের শাষণে শেখ হাসিনা সরকার পুরোপুরি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিনত করেছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে।

শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে সৃষ্ট শ্রেণি বৈষম্য স্পষ্টতই আমাদের সার্বিক সামাজিকীকরণের প্রধান অন্তরায়। ফলে যে উচ্চশিক্ষা একদিন বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বপ্ন ও সাধের মণিকাঞ্চন সাধন করতো, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণে আজ তা হয়ে ওঠেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ট্র্যাজিডি। এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়তো বাঙ্গালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি উচ্চশিক্ষাকে কেন্দ্র করে স্বপ্ন দেখতে ভুলেই যাবে।

ছাত্র-জনতার গনঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেছেন ৫ই আগষ্ট।দেশে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড.ইউনূস কে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠন হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণেরর পর থেকে দেশের সংস্কারের কথা বলে আসছেন এবং সংস্কারের পথেই হাঁটছেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিৎ শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার দ্রুত করা। দলীয় লেজুড়বৃত্তি কেন্দ্রীক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে দেশের সকাল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে দ্রুত ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিয়ে সুষ্ঠ ধারার ছাত্র রাজনীতি নিশ্চিত করা এখন জরুরী।

মহান শিক্ষা দিবস বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ও অন্যান্য সংগঠন পালন করলেও এটি জাতীয় ভাবে পালন হয়না। আন্দোলনের ৬২বছর পর ও এ শিক্ষা আন্দোলন কে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। মহান শিক্ষা দিবস কে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করে সার্বজনীন বিজ্ঞান ভিত্তিক, সেকুলার, বৈষম্যহীন ও একই পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার।

লেখক: সাংবাদিক, সংস্কৃতিককর্মী

মুক্তমত রাকিবুল ইসলাম শিক্ষা দিবস: ৬২ বছরেও বন্ধ হয়নি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ

বিজ্ঞাপন

নতুন ইসির শপথ রোববার দুপুরে
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:২৩

আরো

সম্পর্কিত খবর