জ্ঞানের সূতিকাগার কেন আজ হত্যাপুরী?
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৯:৩০
যখন লিখতে বসেছি তখন সারাদেশ দুটো হত্যাকাণ্ড নিয়ে উত্তাল। দুটো হত্যাকাণ্ডই ঘটেছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। যেখানে মানুষের সবচেয়ে বেশি নিরাপদ থাকার কথা, যেখানে সবচেয়ে বেশি নীতি, নৈতিক, আইন-শৃঙ্খলা ও মানবাধিকারের চর্চা হওয়ার কথা সেখানেই এমন নৃশংস-নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চুরির অভিযোগে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীর উপস্থিত ছিল। উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে নৃশংসভাবে তোফাজ্জল নামের সেই যুবকের উপর অত্যাচার চালিয়েছে, অনেকে আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করেছে। এর থেকে নির্মম, মর্মান্তিক, হতাশাজনক কী আর হতে পারে! নির্বিচারে, নৃশংসভাবে মানুষকে গুম-খুন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন থেকে শুরু করে ভোট ডাকাতির কারণে শেখ হাসিনা সরকারকে এদেশের মানুষ উৎখাত করেছে। কিন্তু সেই একই নৃসংশতা যদি এখনো বিরাজমান থাকে তাহলে পরিবর্তনটা আসলে কোথায় সেই প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
এখানে অনেকেই বলছেন, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে ছাত্রলীগ জড়িত। জালাল মিয়া নামক যে ছাত্রলীগের প্রাক্তন নেতার কথা বলা হচ্ছে, তিনি হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপসম্পাদক। কোটা সংস্কার আন্দোলনের চলাকালে তিনি ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগে করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন। এবার তাকে সাধারণ শিক্ষার্থী বলবেন নাকি তাকে ছাত্রলীগের পান্ডা হিসেবেই বিবেচনা করবেন সেই বিচারের ভার আপনাদের উপরই ছেড়ে দিলাম।
এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জড়িত থাকলেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। সবাই নিজের বাহাদুরি জাহির করতে একজন মানুষের উপর নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লো এটা চূড়ান্ত পর্যায়ের গোঁয়ার্তুমি, মূর্খতা ও অমানবিকতা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের যদি এতটুকু মানবিকতা না থাকে, আত্মনিয়ন্ত্রণ না থাকে তাহলে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ শোচনীয়।
এবার আসা যাক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যার বিষয়ে। গত ১৫ জুলাই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে আন্দোলনরতদের ওপর হামলার ঘটনায় শামীম নামক সেই নেতা সামনের সারিতে ছিলেন এমন অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা মারধোর করলে পরবর্তীতে তিনি মারা যান।
শামীমের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। তবে মূখ্য বিষয় হল- যদি কেউ অপরাধী করে থাকে, অন্যায় কাজের সাথে সম্পৃক্ত থেকে থাকে তাহলে তার বিচারের জন্য আইন আছে, আদালত আছে। কাউকে নৃশংসভাবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হঠকারিতা ও অন্যায়ের একশেষ। গণমাধ্যমের উঠে এসেছে এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল ছাত্রদলের বেশ কয়েকজন সদস্য এবং একজন সমন্বয়কের সম্পৃক্ততাও পাওয়া গেছে। যদিও হত্যাকাণ্ডে ছাত্রদল সদস্যদের জড়িত থাকার বিষয়টি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি পুরোপুরি অস্বীকার করে বলেছে তাদের জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কমেটি নেই। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছাত্রদলের সম্পৃক্ততা বিষয়টি উঠে এসেছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে বলতে হয়, যেখানে বিএনপির দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় অগ্রনী ভূমিকা পালন করা উচিত, সেখানে তাদের দ্বারাই এমন অমানবিক ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির দশা এই হলে, দেশে স্থিতিশীল পরিবেশের আশা করা আকাশ কুসুম কল্পনার নামান্তর।
দুটি হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেই লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে- এই ঘটনা দ্বয়ের পূর্বে কিংবা শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপস্থিতি নেই। ঘটনা যখন অনেক দূর গড়িয়েছে তখন উভয় ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দেখা গেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, দেশের এহেন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এড়ানোয় তাদের ভূমিকা কী এবং তারা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে কী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে?
বিপ্লব পরবর্তী সময়ে কয়েকদিন দেশে স্বাভাবিকভাবেই বিশৃঙ্খলা বিরাজমান থাকে। সেটা মূলত জনসাধারণের ক্ষোভের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু বিশৃঙ্খলা যখন দীর্ঘস্থায়ী হয়, অপকর্ম-হত্যাকাণ্ড যখন পরিকল্পিতভাবে হতে থাকে তখন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। তখন দেশের ভবিষ্যৎ অনিবার্যভাবেই অমাবস্যার রাতে মতন অন্ধকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় দেড় মাস হয়েছে কিন্তু দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক নয়। জায়গায় জায়গায় গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে, নির্মমভাবে মানুষ মারা হচ্ছে। এর দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। সরকারের সবচেয়ে বেশি মনোনিবেশ করা উচিত দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণের দিকে। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, যেকোনো অপকর্ম ঘটলেই নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক দলের উপর দায় চাপিয়ে সাধারণ অপরাধীদের আড়ালে রাখার মানসিকতা পরিহার করতে হবে। এটা মানতে হবে, অন্যায়, অপরাধ, জুলুম এই সকল কর্ম শুধু আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, বিএনপি, ছাত্রদল করছে না, অনেক সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থী এর সাথে জড়িত। এ বিষয়টি স্বীকার করেই সংকট সমাধানের পথে এগোতে হবে। মনে রাখা দরকার, আইন-আদালতের দায়িত্ব নিজে কাঁধে তুলে নিলে, দেশের সিস্টেম কলাপ্স করবে। দেশে চূড়ান্ত পর্যায়ের অরাজকতা সৃষ্টি হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এজেডএস
বিশ্ববিদ্যালয়: জ্ঞানের সূতিকাগার নাকি হত্যাপুরী রবিউল আওয়াল পারভেজ