Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে খেলছে কারা?

আহসান হাবিব
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৯:৪৩

দেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ পোশাক খাত। আর এই খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা তেমন গুরুত্ব দেই না। কেন? বিএনপি সরকারের আমল থেকে পোশাক খাতে আন্দোলনের সূত্রপাত। কথায় কথায় পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন। বিএনপির শাসনামলে পোশাক কারখানায় অসন্তোষ লেগেই থাকত। সরকার পরিবর্তন হল। ক্ষমতায় এলো আওয়ামী লীগ সরকার। তারা ক্ষমতায় থাকলেন ১৭ বছর। আওয়ামী লীগ সরকার পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি করলেন ৮ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা। তারপরও শ্রমিকরা পান থেকে চুন খসলেই গাড়ি ভাঙচুর থেকে শুরু করে রাস্তা অবরোধসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করতে থাকে। পোশাক শ্রমিকদের এই আন্দোলনের শেষ কোথায়? প্রশ্ন আসতেই পারে─ তারা কি কারও উস্কানিতে ভাঙচুর ও রাস্তা অবরোধ করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেন। নাকি এর পেছনে অন্য কোনোও উদ্দেশ্য থাকে? আসলে পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে খেলছে কারা?

বিজ্ঞাপন

গত ১ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। গোটা মাস আন্দোলন চলতে থাকে। ১ আগস্ট থেকে শুরু হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলন। এক দফা আন্দোলন। সরকার পতনের আন্দোলন। ৫ আগস্ট আন্দোলনের মুখে আওয়ামী সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় এবং শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে ভারতের দিল্লিতে চলে যান। এরপর দেশে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। তারা ক্ষমতায় বসতে না বসতেই দেশে বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। আনসার কর্মীরা সচিবালয় ঘেরাও করে উপদেষ্টাদের অবরুদ্ধ করে আন্দোলন করেন। আনসারদের আন্দোলন বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে শুরু হয় পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন। এই আন্দোলন কি অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলার আন্দোলন? এই আন্দোলন দেখার জন্য কি হাজারের বেশি ছাত্র-জনতা আওয়ামী ফ্যাসিবাদি সরকারের হাতে প্রাণ দিয়েছে?

বিজ্ঞাপন

গত ৩১ আগস্ট ২১ দফা ও ১৭ দফা দাবিতে গাজীপুরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ও নারায়ণগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেন ফার্মাসিউটিক্যালস কারখানার শ্রমিকরা। যা গত ৫০ বছরের মধ্যে নজিরবিহীন। ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার সাভার ও ধামরাইয়ে পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা নানা দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। পরে সেখানকার অন্তত ১৫টি পোশাক কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

শিল্প পুলিশ ও বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, ২ সেপ্টেম্বর শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে তৈরি পোশাক, ওষুধ, খাদ্যসহ বিভিন্ন শিল্পের শতাধিক কারখানার উৎপাদন বন্ধ ছিল। বিক্ষোভ শুরুর পর আশুলিয়ায় ৪০টি ও গাজীপুরে ৪৫টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। গাজীপুরের ১১টি তৈরি পোশাক কারখানায় ভাঙচুর করা হয়। দুটি কারখানায় লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। শ্রমিক বিক্ষোভের ফলে ২৫০টির তৈরি পোশাক কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। শ্রমিক বিক্ষোভের নামে পোশাক কারখানায় লুটপাট, ভাঙচুর কাদের ইন্ধনে হয়েছে তা তদন্ত করে খুঁজে বের করতে হবে। বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্যই পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনে উস্কে দিতে পারে একটি কুচক্রী মহল। পোশাক শিল্পকে বাঁচাতে হলে এদেরকে খুঁজে বের করে কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

শ্রমিকরা যেসব দাবিতে আন্দোলন করছেন, সেসবের মধ্যে রয়েছে বর্তমানে যে ন্যূনতম বেতন রয়েছে তা বৃদ্ধি করা, বৈষম্যবিরোধী শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের কোনো কর্মীকে পরবর্তী সময়ে কোনো প্রকার হয়রানি বা চাকরিচ্যুত না করা, সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন করা, প্রত্যেক শ্রমিককে দুই বেলা খাবার প্রদান, খাবারের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বৈষম্য না রাখা, খাবারের মান উন্নয়ন, খাবারের মেন্যু পরিবর্তন করা, দুই ঈদে বেতনের সমপরিমাণ বোনাস ও বৈশাখী বোনাস প্রদান, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্রাচুইটি চালু করা, সব কর্মচারীর কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টা করা, হাজিরা বোনাস প্রদান, সব সরকারি ছুটি প্রদান এবং ছুটির হয়রানি বন্ধ করা, শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন, কোম্পানিতে কর্মরত অবস্থায় কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনার শিকার হলে কোম্পানি কর্তৃক ক্ষতিপূরণ প্রদান। যা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়।

শ্রমিকদের যেসব দাবি রয়েছে তার মধ্যে বেশ কিছু দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক। এমনকি এসব দাবি নিয়ে মালিকপক্ষ বা মালিকদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠনগুলোও বিপক্ষে রয়েছে বলে তেমন শোনা যায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব দাবি এমন সময়ে করা হচ্ছে, তা মোটেই দাবি-দাওয়া উত্থাপন বা পূরণের জন্য অনুকুল কিনা ভাবা দরকার।

২০২৩ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের সময় শ্রমিকদের ওপর হামলা ও গুলিবর্ষণ করেছিল পুলিশ ও সরকারি সন্ত্রাসী বাহিনী। এতে শ্রমিক নিহতসহ আহতও হয়েছেন অনেক পথচারী। বার বার শ্রমিকদের আন্দোলন পোশাক শিল্পের জন্য মঙ্গলজনক নয়।

দাবি-দাওয়া পেশের আগে শ্রমিকদের চিন্তা করতে হবে তারা যেসব দাবি করছেন তা বাস্তবায়নে সরকার এবং মালিক পক্ষের সক্ষমতা আছে কিনা। আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় কাজের সুযোগ তৈরি করা এবং সেটি ধরে রাখাই মুখ্য হওয়া উচিত। কারণ প্রতি বছর উচ্চ শিক্ষা শেষ করা অনেক কর্মক্ষম ব্যক্তি বেকার থাকছেন। এসব বেকারদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং সবার জন্য কাজের ব্যবস্থা হলে সেক্ষেত্রে কাজের মান, বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য আরো বিষয়ে মনোযোগী হবার সুযোগ রয়েছে।

বর্তমানে আর্থিক খাতের অবস্থা অত্যন্ত ভয়ংকর। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাস শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। এছাড়া গত ১৫ বছরে শুধু ব্যাংক খাতেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৯১০ কোটি টাকা, যার অধিকাংশই আদায় অযোগ্য। ফলে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশই এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে। ২০০৯ তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। তাছাড়া দেশের প্রচুর টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দেশের উৎপাদন খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারে। এমতাবস্থায় শ্রমিক আন্দোলনের কারণে যদি উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়ে, তাহলে দেশে অর্থনীতি আরো নাজুক অবস্থায় পড়বে। তবে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে শ্রমিকদেরকেও আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। তাদেরকে মনে রাখতে হবে, আলোচনার মাধ্যমেই দাবি-দাওয়া আদায় করা যায়। কর্মবিরতি, অবরোধ, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিকাণ্ড আদতে কোনো সমাধান বয়ে আনে না, বরং পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে। তাদের কোনো দাবি-দাওয়া থাকলে লিখিতভাবে কারখানা কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেন, এমনকি একটি কপি স্থানীয় শ্রম দপ্তরকে দিতে পারেন।

কোনো পরিস্থিতিতেই লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হামলা, ভাঙচুরকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। এ ব্যাপারে সরকারকে অত্যন্ত কঠোর হতে হবে এবং এগুলো প্রতিরোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই যাতে এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা না ঘটে সেক্ষেত্রে শ্রম অধিদপ্তরকে কার্যকরি ভূমিকা নিতে হবে। শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কারখানা পরিদর্শন করে মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধির সাথে আলোচনা করতে হবে।

ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকালে পুলিশ কিংবা অন্য বাহিনীগুলোর আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠে। এতে শতাধিক শ্রমিকসহ হাজারখানেক মানুষ নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন বহু হাজার। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে তাদের স্বার্থ তাদের অধিকার অন্যতম প্রধান বিবেচনা হতে হবে। কিন্তু বিদ্যমান আইন, বিধিবিধান এবং রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে বৈষম্য দমন-পীড়ন নৃশংসতার অবসান হবে না।
বিদ্যমান শ্রম আইন যথাযথভাবে মেনে চললে শ্রমিকদের অধিকাংশ দাবি পূরণ হয়ে যাবে। বেশ কিছু দাবি শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার সুযোগ রয়েছে। ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির ব্যাপারে শ্রমিকদের বর্তমান দাবির প্রেক্ষিতে সরকার সব পক্ষকে সাথে নিয়ে মজুরি পর্যালোচনা করে তিন মাসের মধ্যে নতুন মজুরি ঘোষণা করতে পারে।

তাছাড়া বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র একমাস পার হয়েছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সংস্কার শুরু করেছে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার। এরই মধ্যে ব্যাংক খাত সংস্কারে কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। তাছাড়া সংকট উত্তরণে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এবং সাধারণ গ্রাহকদের মাঝে আস্থা ফিরে আসবে।

মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক অটুট থাকলে তৃতীয় পক্ষের সুযোগ নেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। মালিক-শ্রমিক শক্তিশালী সম্পর্কের অভাবে বা তাদের মধ্যে দূরত্বের কারণে তৃতীয় পক্ষ বারবার সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আসছে।

৫৩ বছরের বাংলাদেশ বর্তমানে এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। এসময় থেকে উত্তরণে দেশের অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবে। এমতাবস্থায় প্রয়োজন সরকার-মালিক-শ্রমিকের যৌথ প্রয়াস, শিল্পে কোন আন্দোলন, বিক্ষোভ, সহিংসতা নয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

আহসান হাবিব পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনের শেষ কোথায়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর