বিচারবহির্ভূত হত্যার দ্রুত বিচার চাই
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৩৯
গত কয়েকদিন সোস্যাল মিডিয়ায়, পত্রিকায়, টেলিভিশনে কিছু ছবি ও ভিডিও ক্লিপ দেখে চোখের পানি সত্যিই ধরে রাখা যায় না! একটি ভিডিও বার বার সামনে আসছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে একজনকে নিরপরাধ মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যাক্তিকে ভাত খাইয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। আরেক ভিডিও ক্লিপে দেখলাম পাহাড়ে দাউদাউ করে জ্বলছে অর্ধশতাধিক দোকানপাট।
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন। ছাত্র জনতার গনঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। শেষ হয় টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা হাসিনা শাসনের। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূস কে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠন হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তারা দায়িত্ব গ্রহণেরর পর থেকে দেশের সংস্কারের কথা বলে আসছেন এবং সংস্কারের পথেই হাঁটছেন।
কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের দেড় মাসেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়নি পাহাড় থেকে সমতল কিংবা নিজের বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়। হামলা, মারামারি, গণপিটুনি, খুনোখুনি চলছেই।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল তা এখনো চলছে। এখনো মানুষের মধ্যে সহনশীলতা ফিরে আসেনি। সুযোগ পেলেই মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। চলতি বছর ১৫ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ৩৩ জনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে ১৮ সেপ্টেম্বর বুধবার সন্ধ্যায় চোর সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে আটকের পর গেস্টরুমে নিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেখানে তাকে রাত ১০টা পর্যন্ত দফায় দফায় মারধর করে শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে ওই যুবককে ক্যান্টিনে বসিয়ে ভাতও খাওয়ানো হয়। এরপর পুনরায় মারধর করা হয় ।
রাত ১০টার দিকে হলের হাউস টিউটররা ঘটনাস্থলে গেলে রাত ১২টার দিকে তোফাজ্জলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় কয়েকজন শিক্ষার্থী। পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
একই দিনে দেশের আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা গণপিটুনির শিকার হন। বুধবার সন্ধ্যায় শামীমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট এলাকায় দেখতে পান কয়েকজন শিক্ষার্থী। এ সময় উপস্থিত বিক্ষুব্ধ কয়েকজন তাকে মারধর করে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যান। পরে প্রক্টরিয়াল বডি তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। এরপর গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে সাভার গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরে গরুচোর সন্দেহে দুজনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়।
গত ৯ সেপ্টেম্বর বগুড়া সদরের গোকুল ইউনিয়ন পরিষদের সামনে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান মিজানকে কুপিয়ে হত্যার পর ঘাতক সন্দেহে লেদো নামে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। বলা যায়, প্রকাশ্যেই খুনের বদলে খুন।সোমবার রাত ৮টার দিকে দুর্বৃত্তরা মোটরসাইকেলে এসে মিজানকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। তার ঘাতক সন্দেহে রাতেই গোকুল এলাকায় স্থানীয় লোকজন লেদো নামে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিলে তিনি মারা যান।
গত ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার সদ্যোজাত সন্তান ও স্ত্রীর জন্য ওষুধ আনতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের সামনে হামলার শিকার হন তিনি। ঘটনার মাত্র চার দিন আগে কন্যাসন্তানের পিতা হন তিনি। দশ বছর আগে এক সন্ত্রাসী হামলায় এক পা হারিয়েছিলেন মাসুদ। সেই হামলার অভিযোগ ছিল রাবি ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ইউটিউবার আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমকে বগুড়ার আদালত প্রাঙ্গণে গণপিটুনি দিয়ে কান ধরে ওঠবস করানো হয়। হামলাকারীদের অভিযোগ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে গালি দেওয়ায় তাকে মারধর করা হয়েছে।
গত ৫ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলায় পূর্বশত্রুতার জের ধরে দুজনকে কুপিয়ে হত্যার পর স্থানীয় বাসিন্দাদের গণপিটুনিতে আবু তালেব মিয়া নামে একজন নিহত হন।
গত ৪ সেপ্টেম্বর হজরত মুহম্মদ (সা.)-কে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটূক্তির অভিযোগে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের দপ্তরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতেই গণপিটুনির শিকার হন উৎসব মণ্ডল নামে এক তরুণ।
গত ১৪ আগস্ট রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকায় গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যান সাইফ আরাফাত শরীফ ও সাইদুল ইসলাম ইয়াসিনসহ ৩ জন। এভাবে প্রায়ই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনিতে লোকজন মারা যাচ্ছে।
সরকার পতনের-পরবর্তী কয়েকদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সহিংসতা ও গণপিটুনিতে মারা গেছে বহু মানুষ।গত ৫আগস্ট সরকার পতনের পর বিকেল থেকে শুরু হয় লুটপাট অগ্নিসংযোগ চলে রাতভর।ভেঙে ফেলা হয় দেশের অধিকাংশ ভাস্কর্য। দূর্বত্তরা আগুন দেয় বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২নম্বার বাড়িতে। হামলা চালায় সংখ্যা লঘুদের বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের অফিসে ও সদ্য সাবেক এমপি মন্ত্রীর বাড়িতে চলে অগ্নিসংযোগ লুটপাট। হামলা হয় দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যলয়ে।ভাংচুর হয় কয়েকটি মন্দির ও মাজারে। ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ চলে সরকারি নানা স্থাপনায়। দেশের অধিকাংশ থানায় আগুন দেয় দূর্বত্তরা। এদিন প্রতিহিংসায় প্রাণ হারান সারাদেশে পুলিশসহ অর্ধশতাধিক।
৫ আগস্টের এক মাস আগে পুরো জুলাই মাস ছিল রক্তাক্ত সেই সময় শেখ হাসিনার মসনদ বাঁচাতে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু সদস্যের নির্বিচার গুলিতে প্রাণ হারায় ৭০০ জনের বেশি মানুষ আর আহত হয় ২০ হাজারের বেশি মানুষ। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র আসকের তথ্য মতে, দেশে গত সাড়ে ৬ বছরে গণপিটুনিতে কমপক্ষে ২৮৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
সমতলের সাথে ভালোনেই পাহাড়ের মানুষও। খাগড়াছড়ি শহরের নোয়াপাড়া এলাকায় ১৮ সেপ্টেম্বর বুধবার ভোরে মোহাম্মদ মামুন (৩০) নামের এক ব্যক্তিকে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মারধর করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় পরে তাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনার সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে দীঘিনালায় বিক্ষোভ মিছিল বের করেন বাঙালিরা। পাঁচটার দিকে ৩০০ থেকে ৪০০ বাঙালি জামতলি ও বোয়ালখালী বাজারের দিক থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। তারা লারমা স্কয়ারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এসময় পাহাড়িরা বাধা দিলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এতে অন্তত তিনজন আহত হয়েছেন। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে লারমা স্কয়ার ও দীঘিনালা কলেজের আশেপাশে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দোকান ও ঘরবাড়ি আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।
বৃহস্পতিবার রাতভর জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। রাতের গোলাগুলি
ও বিকেলের সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন।নিহতরা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)।
বৃহস্পতিবার রাতে (আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টা) জেলা শহরের নারানখখাইয়া, স্বনির্ভর এলাকায় ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। এতে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গভীর রাত পর্যন্ত পাওয়া যায় গুলির শব্দ ।পাহাড়ের এই চিত্র দেশের বয়সের সমান।গণতন্ত্রের খোলসে পাহাড়ে তালেবানী বন্দুকের শাসন টিকিয়ে রাখার চেষ্টা বহুপুরোনো।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি হয়। শান্তিচুক্তির মাত্র দেড় বছর পর ১৯৯৯ সালের ৪ এপ্রিল রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইহাটে আদিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ধারাবাহিকভাবে এই সংঘর্ষ চলমান। পাহাড় থেকে সেনাশাসন প্রত্যাহার, শান্তিচুক্তির দফাগুলোর প্রতিটি সুনির্দিষ্টভাবে বাস্তবায়ন হলেই এই সংঘর্ষ বন্ধ হবে।
অবিলম্বে পাহাড় থেকে সেনাশাসন প্রত্যাহার করে শান্তিচুক্তির দফাগুলোর বাস্তবায়ন করা হোক দ্রুত। সকাল বিচারবহির্ভূত হত্যার বিচার হোক দ্রুত। পাহাড় থেকে সমতল সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জোর দাবি জানাচ্ছি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কাছে।
পাহাড় থেকে সমতল মানুষ থাকুক নিরাপদ। বন্ধ হোক মানুষ খুন।
লেখক: সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মী
সারাবাংলা/এজেডএস