Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খুন নয়, ছাত্রলীগ করাটাই অপরাধের

শিশির ওয়াহিদ
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৪৭

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বরগুনার মোহাম্মদ মাসুদ কামাল ওরফে তোফাজ্জেলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বাবা-মা-ভাই ও প্রেমিকাকে হারিয়ে তোফাজ্জেল মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। খুনিরা এ-তথ্য জানার পরও তাকে ছাড় দেয়নি। ক্ষুধাতুর তোফাজ্জেলকে ভাত খাইয়ে নিজেদের লাশের ক্ষুধা নিবারণ করেছে মেধাবী খুনিরা। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের পর শুরু হয়েছে নানাবিধ টালবাহানা। পলিটিক্যাল শিল্ড বা রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে খুনিদের অতীতের রাজনৈতিক পরিচয়কে টেনে আনা হচ্ছে, বলা হচ্ছে তাদের কেউ-কেউ ছাত্রলীগের নেতা বা কর্মী ছিলো। ছাত্রলীগকে জড়িয়ে ফেলার কারণ আছে। পাবলিক অপিনিয়ন বা পাবলিক পার্সেপশানের একটা গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন তারা পেতে পারে, ফলে বিচারকার্যে এড়িয়ে যাওয়া খুনিদের সুবিধাপ্রদান ও বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনকে চাপে ফেলার এটি একটি বড় কৌশল।

বিজ্ঞাপন

দেশের প্রথমসারির কিছু গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে, খুনিরা না-কি সবাই ছাত্রলীগের নেতা। ঘুরেফিরে তাদের ‘রাজনৈতিক পরিচয়টাকে’ই ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। তারা পরোক্ষভাবে বোঝাতে চাইছে, কাউকে ভাত খাইয়ে নির্মমভাবে খুন করা অপরাধ নয়, বরং ছাত্রলীগ করা অপরাধ।

একজন ব্যক্তি একইসাথে অনেকগুলো আইডেন্টিটি বহন করে। তার মধ্যে রাজনৈতিক পরিচয়টা অতি গৌণ। যেমন ধরুন, ‘জনাব করিম চৌধুরী একজন বাংলাদেশি মুসলমান, সে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং তিনি জনতা পার্টির সদস্য।’ এই এক বাক্যে আমরা জনাব করিমের কয়টা পরিচয় পেলাম? —পাঁচটি। এক— করিমের একটি বংশপরিচয় আছে, তার বংশ ‘চৌধুরী’, দুই— সে একটি দেশের নাগরিক, বাংলাদেশি, তিন— তার ধর্মপরিচয় আছে, সে একজন মুসলমান, চার— তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, পাঁচ— সে জনতা পার্টি নামের একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য, এগুলো সব তার পরিচয় বা আইডেন্টিটি।

কিন্তু আমরা খেয়াল করেছি, একজন ব্যক্তির একাধিক পরিচয় থাকলেও বিশেষ উদ্দেশ্যে বা একশ্রেণির নজরকাঁড়ার জন্য শুধু একটিমাত্র গৌণ পরিচয়কেই মুখ্য হিশেবে বারবার উপস্থাপন করা হয়। এ রেওয়াজ বহুদিনের, এর স্থান-কাল পাত্রভেদে ভিন্নতা আছে। যেমন, করিম যদি ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী দেশটার নাগরিক হয়ে কোনো অন্যায়কর্ম করে ধরা পড়তেন, তাহলে সেদেশের গণমাধ্যমগুলোর সংবাদের শিরোনাম এমনটাও হতে পারে— ‘জনতার হাতে আটক হলেন মুসলিম চোর করিম’। আবার এ চিত্র বাংলাদেশে হলে দেখতে পাই এমন— ‘সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন জনতা পার্টির নেতা, কিংবা ‘চুরির অভিযোগে আটক হলেন জনতাপার্টির করিম’। অথচ করিম যে আরো স্বতন্ত্র কিছু পরিচয় বহন করতো, এটা মতলববাজরা প্রচার করবেনা। স্পষ্ট যে, স্থান-কাল পাত্রভেদে মতলববাজরা যখন যে পরিচয়টা মূখ্য মনে করবে সেটাকেই ফলাও করে প্রচার করবে। এখন তারা সুবিধা পাচ্ছে ছাত্রলীগ পরিচয়টা তুলে ধরে। যেন খুন করাটা অপরাধ নয়, অতীতে ছাত্রলীগ করাটা অপরাধের।

বিজ্ঞাপন

প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, ৫ আগস্টের আগ অবধি ছাত্রলীগের ছিলোনা কারা? সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, এরাও তো ছাত্রলীগের পদধারী নেতা ছিলেন। আমার অনুমান ভুল না হলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০% বা তারও অধিক ছেলে-মেয়ে কোনো-না কোনোভাবে স্বেচ্ছায় অথবা বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলো, মিছিল-সমাবেশে শরিক হতো, কেউ কেউ ক্ষমতাসীন দলের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে নেতাদের পদলেহন করে একটি পদ বাগিয়ে নিয়েছেন, আবার কেউ কেউ ‘অমুক ভাইকে’ নানাবিধ সেবা-শুশ্রূষার মধ্য দিয়ে বনে গেছেন হল কিংবা কোনো একটি শাখার অঘোষিত অধিপতি। আমি এমনও ছাত্রকে চিনি যার অন্তরে উগ্র-মৌলবাদ ও রাজনৈতিক লক্ষ্য ভিন্ন, অথচ বিশেষ সুবিধা নিতে সে বনে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদের পদধারী নেতা। কিন্তু এদের লেজ বেরিয়ে যেতে শুরু করেছিল জুলাইয়ের মধ্যভাগ থেকে। উচ্চফলনশীল জাতের এসব নেতা-কর্মীগুলো একে-একে নিজেদের আঁতুড়ঘরে ফিরে যেতে শুরু করেছিল, তোফাজ্জেলের হত্যাকারীরাও সেই একই ঘরানার। এই খুনিরা আওয়ামী লীগ সরকার পতনের লক্ষ্যে মিছিলের অগ্রভাগে নেতৃত্ব দিয়েছে, ফেইসবুকে মুহম্মদ ইউনুসকে শুভেচ্ছাবানে ভাসিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে দুর্দান্ত প্রতাপের সাথে দিনাতিপাত করেছে; যা এইমুহুর্তে একজন ছাত্রলীগের ন্যুনতম কোনো কর্মীর পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম গোটাকতক ‘ছাত্রলীগ নেতা’ তোফাজ্জেলকে খুন করলেন, তাহলে অন্য সাধারণ শিক্ষার্থীরা কী করছিলো সেখানে? তারা তো কদিন আগেও ক্যাম্পাস থেকে ‘ছাত্রলীগ খ্যাদাও’ আন্দোলনে যুক্ত ছিলো, ছাত্রলীগের পদধারী কাউকে পেলেই অপমান-অপদস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে, তাহলে তোফাজ্জেলের খুনিরা যদি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীই হবে, তবে তারা এতদূর এলো কীভাবে?

আমি বলছিনা যে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে মানুষ কোনো অপকর্ম করেনা, অবশ্যই করে। এমন বহু ঘটনা আছে যেগুলো রাজনৈতিক পরিচয় মূখ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু তোফাজ্জেলকে হত্যার ঘটনায় খুনিদের রাজনৈতিক পরিচয়টা টেনে আনা একেবারে অনর্থক ও অর্বাচীনের মতো কাজ, তাও যদি হয় সে রাজনীতি অতীতের! জামায়াতে ইসলামির বর্তমান আমির শফিকুর রহমান একসময় ছাত্রলীগের (জাসদ) রাজনীতি করেছেন, তারপর ছাত্রশিবিরে যোগদান করেন। এখন যদি জামায়াতের আমির শফিকুর কোনো অপকর্ম করেন, তাহলে কি প্রচারটা এভাবে হবে— ‘খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হলেন ছাত্রলীগ নেতা শফিকুর রহমান’! এটা কি হাস্যকর নয়?

রাজনীতির সস্তা এই অপকৌশলগুলো পরিত্যাগ করা প্রয়োজন। অপরাধীর সাজা তার অপরাধ দেখে বিচার করতে হবে, কোনো ভিন্ন পরিচয় দেখে নয়। অপরাধী মানেই অপরাধী, অপরাধের রাজনীতিকরণ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। গণমাধ্যমের স্বেচ্ছাচারীতা নিয়ে নতুন করে কিছু বলতে চাইনা, তারা তথাকথিত স্বাধীনতা পেয়েছে, বাতাবি লেবু চাষের স্বাধীনতা। আমরা দেখতে থাকি, তারা কতদিন এভাবে বাম্পার ফলন দিয়ে যেতে পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

সারাবাংলা/এজেডএস

ছাত্রলীগ শিশির ওয়াহিদ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর