Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বনাম জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়

মাহতাব মুহাম্মদ
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:০৮

গত এক যুগ ধরে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলন চলছে। সময়ে সময়ে মানববন্ধন হয়েছে, সমাবেশ হয়েছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দেও চাকরিপ্রার্থীরা শাহবাগ অবরোধ করেছে। আন্দোলন এখনো চলমান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সাথে চাকরিপ্রার্থীরা দেখা করেছে। উপদেষ্টা নিজেও বয়সসীমা বৃদ্ধি করার পক্ষে বিভিন্ন সময় মত দিয়েছেন। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে অনুরোধ করা হলেও তা বিতাড়িত আওয়ামী সরকার ভ্রুক্ষেপ করেনি। আওয়ামী সরকারের আমলে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫-এ উন্নীত করার অনুরোধ জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। কিন্তু তখন সেই অনুরোধকে পাত্তাই দেয়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নির্দেশনা মেনেই তারা পাত্তা দেয়নি। এর আগে জাতীয় সংসদের স্পিকার থাকাকালীন সময়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার জন্য প্রস্তাব করেছিলেন। তখনও তাঁর দাবিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। এরপর আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পুনরায় সরকার গঠন করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দলের নির্বাচনি ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করে উল্টো এর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে যা স্পষ্ট প্রতারণা৷ সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও শেখ হাসিনার সুরে সুর মিলিয়ে বয়সসসীমা ৩৫ না করার ব্যাপারে অটল থাকে। কিছু সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবি তুলেছিলেন। তাদের সেই দাবিকেও প্রত্যাখ্যান করা হয়। সবশেষ গত ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৩৫ বছর ও অবসরের বয়স ৬৫ বছর করার দাবি জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি পাঠায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ চিঠিটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠিয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানায়। কিন্তু এবারও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাদের অবস্থানে অনড়। বয়সসীমা ৩৫ করা তো দূরের কথা, উল্টো বলে দিলেন যে, বয়সসীমা ৩৫-এ উন্নীত করার বিষয়টি গুজব। গত রোববার (২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রি.) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন। বিষয়টি একদিকে যেমন দুঃখজনক, অপরদিকে তা লক্ষ লক্ষ চাকরিপ্রার্থীদের সাথে এক প্রকার রসিকতাও। দীর্ঘদিন ধরে ন্যায্য দাবিতে করা চাকরিপ্রার্থীদের চলমান আন্দোলনকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়ার উপলক্ষ হতে পারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই গোঁয়ার্তুমি। পূর্বে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নির্দেশে গোঁয়ার্তুমি করলেও এখন কার নির্দেশে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গোঁয়ার্তুমি করছে, সেটা জানা জরুরি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ই শুধু এ রকম করছে নাকি এর পেছনে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের গণহত্যার সহযোগী কেউ ইন্ধন যোগাচ্ছে, সেটা খুঁজে বের করা দরকার।

বিজ্ঞাপন

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একগুঁয়েমির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমাকে ৩৫ না করার পক্ষে মত দিয়ে চলেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক আমলা আলী ইমাম মজুমদার। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বয়ান দিয়ে চলেছেন যাতে বয়সসীমা ৩৫-এ উন্নীত করা না হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি চাকরিপ্রার্থীদের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল যে, তাদের যৌক্তিক ও ন্যায্য দাবি বাস্তবায়নে সরকার উদ্যোগ নেবে। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ বক্তব্যে চাকরিপ্রার্থীরা যারপরনাই মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। সেইসাথে বয়সসীমা ৩৫ করার বিরুদ্ধাচরণকারী আলী ইমাম মজুমদারের মত ব্যক্তি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থাকাতে চাকরিপ্রার্থীরা অস্বস্তিতে রয়েছে। এই উপদেষ্টার অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ।

বিজ্ঞাপন

অথচ পৃথিবীর ১৬২ দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর বা তদূর্ধ্ব। কোনো কোনো দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমাই নেই। যেকোনো বয়সে চাকরিতে প্রবেশ করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেই চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর। আর বাকি দেশগুলোতে ৩৫ কিংবা তারও বেশি। এমনকি ভারতেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-এর বেশি যা পশ্চিমবঙ্গে ৪০ বছর। ইন্দোনেশিয়ায় ৪৫, ইতালিতে ৩৫, নেপালে ৩৫, ফ্রান্সে ৪০, শ্রীলঙ্কায় ৪৫ বছর, কাতারে ৩৫, নরওয়েতে ৩৫, সুইডেনে ৩৫, মালয়েশিয়ায় ৫৫, সৌদি আরবে ৫৫, সিঙ্গাপুরে ৫৫, অষ্ট্রেলিয়ায় ৫৫ বছর; এমনকি কানাডা ও আমেরিকায় চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৫৯ বছর। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই যেখানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ কিংবা ৪০ বছর বা তদূর্ধ্ব নির্ধারণ করে মানবসম্পদ উন্নয়নে দেশের জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে ৩০ বছর বয়স পার হবার পর পরই একজন তরুণ বা তরুণীকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের অযোগ্য ঘোষণা করা হচ্ছে, তাও আবার কিছু খোঁড়া যুক্তিতে।

মূলত, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নির্ধারিত হওয়া শুরু হয় ঔপনিবেশিক আমল থেকে। তখন চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৩ বছর। সে সময় অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের দিকে ভারতবর্ষে মানুষের গড় আয়ু ছিলো ৩২-৩৩ বছরের মধ্যে। পরে পাকিস্তান আমলে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে ২৫ বছর নির্ধারণ করা হয়। তখন মানুষের গড় আয়ু ছিলো ১৯৫৫ সালের দিকে ৩৬-৩৭ বছরের মধ্যে। ১৯৬৫ সালের দিকে গড় আয়ু ছিলো ৪২-৪৩ বছরের মধ্যে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা আরো দুই বছর বাড়িয়ে ২৭ বছর নির্ধারণ করা হয়। তখন গড় আয়ু ছিলো ১৯৭১ সাল হতে ১৯৮০ পর্যন্ত ৪৬-৫৩ বছরের মধ্যে। এরপর আরেক দফায় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হয় ১৯৯১ সালে। তখন বয়সসীমা ২৭ বছর থেকে ৩০ বছরে উন্নীত করা হয় । এ সময় গড় আয়ু ছিল ৫৬-৫৭ বছরের মধ্যে। কিন্তু ৩৩ বছর পর এসেও ২০২৪ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা আর বাড়েনি; সেই ৩০ বছর-ই রয়ে গেছে, যেখানে এই ৩৩ বছরে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে মোট ১৬ বছর অর্থাৎ গড় আয়ু ৫৭ বছর থেকে ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু এত বছর বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৩ বছর পূর্বে যা নির্ধারিত ছিল, এখনো সেটিই আছে অর্থাৎ ৩০ বছর। এটি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমাও বৃদ্ধি করা জরুরি।

এর সাথে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যমান সেশনজট। একজন ছাত্রের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করতে করতে বয়স হয়ে যায় ২৪-২৫ বছর। শিক্ষাজীবনের কোনো স্তরে বছরখানেকের জন্য ড্রপ আউট হলে কোনো ক্ষেত্রে তা ২৬ কিংবা ২৭ বছরও হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুসারে, প্রথম শ্রেণিতে কোনো শিক্ষার্থীকে ভর্তি করাতে গেলে বয়স হতে হবে সর্বনিম্ন ৬ বছরের বেশি। তাহলে ছয় বছরের বেশি বয়সে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া কোনো শিক্ষার্থীর এসএসসি পাশ করতে গেলেই বয়স হয়ে যাবে ১৬ বছরের বেশি। কোনো শ্রেণিতে ইয়ার ড্রপ হলে বা এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে এসএসসি পাশ করতেই বয়স ১৭ বছরের বেশি হয়ে যাবে। তারপর এইচএসসি, সেশনজটহীন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে সর্বনিম্ন ৭ বছর সময় লাগবে। তখন বয়স হবে ২৪ বছরের বেশি। যদি এইচএসসি কিংবা অন্য পর্যায়ে ইয়ার ড্রপ হয়, তখন তার বয়স ২৫-২৬ হয়ে যাবে। সেশনজটের কথা তো বাকিই আছে। যদি সেশনজট থাকে, তবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে শিক্ষার্থীর বয়স ২৫-২৭ বছরও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা তো ৩০ বছর। তাহলে দেড় যুগ ধরে পরিশ্রম করে পড়াশোনা সম্পন্ন করার পর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য একজন চাকরিপ্রার্থী সময় পাচ্ছে ৩ থেকে ৫ বছর অর্থাৎ দেড় যুগের বেশি সময় ধরে করা পরিশ্রমের স্বীকৃতিস্বরুপ পাওয়া সার্টিফিকেটের মেয়াদ ৩-৫ বছর। কী হাস্যকর! ৩০ বছরের পর থেকে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তার সার্টিফিকেটের মূল্যই নেই। কোনো কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও সরকারি নিয়ম অনুসরণ করে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর নির্ধারণ করে বিজ্ঞাপন দেয়। অথচ পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দেশেই চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর কিংবা তদূর্ধ্ব। শুধু বাংলাদেশই পাকিস্তানের সাথে একাত্মতা পোষণ করে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর রাখতে বদ্ধপরিকর। এসব কর্মকাণ্ড সম্পাদনের সপক্ষে কিছু লোক খোঁড়া যুক্তি দিয়ে থাকে। তাদের কিছু যুক্তি হলো: ১. বয়সসীমা বৃদ্ধি পেলে সরকারের ব্যয় ও বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাবে ২. চাকরির বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে ৩. ত্রিশোর্ধ্ব ব্যক্তি ত্রিশের কম বয়সীদের তুলনায় কম এনার্জেটিক হবে ও কাজে পিছিয়ে পড়বে ৪. প্রশাসনে জটিলতা দেখা দেবে

আসলে এগুলো কোনো ভ্যালিড যুক্তি নয়। বয়সসীমা ৩৫ করলে সরকারের ব্যয় বাড়বে, এমন যুক্তি তুলে এর বিরোধিতা করা ঠিক নয়। দেশের সকল সেক্টরেই ব্যয়বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজেট বৃদ্ধি হচ্ছে, বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। সামরিক খাতে ব্যয়বৃদ্ধি পাচ্ছে, শিক্ষাখাতে ব্যয়বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব সেক্টরেই ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য বাজেটও বাড়াতে হচ্ছে। দেশের সকল খাতে ব্যয়বৃদ্ধি পেলে বয়সসীমা ৩৫ বছর করাতেও কিছুটা ব্যয় বৃদ্ধি পেলে দোষের কী? এ ব্যয় তো দেশের মানুষের জন্যই। দুনিয়ার দুই তৃতীয়াংশের বেশি দেশ যদি এ বিষয়টা সামলাতে পারে, বাংলাদেশ কেনো নয়? বাংলাদেশ কি নেপালের চাইতেও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল নাকি? তাই বয়সসীমা বাড়ালে সরকারের ব্যয়বৃদ্ধি পাবে বলে বয়সসীমা ৩৫ নির্ধারণ না করার যুক্তি ধোপে টেকে না। যদি বেকারত্ব বৃদ্ধির প্রসঙ্গ আনা হয়, তাহলে বলবো: বয়স ৩৫ করলে বেকারত্ব হু হু করে বাড়বে ব্যাপারটা এ রকম নাও হতে পারে। বেকারত্ব তো বয়স ৩৫ না করলেও বাড়বে। গত দেড় যুগ ধরে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বর্ধিতকরণের জন্য আন্দোলন হচ্ছে। কিন্তু বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হয়নি। এতদিন বয়সসীমা বৃদ্ধি না করানোর কারণে কি বেকারত্বের হার স্থির ছিলো? বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায়নি? বেকারত্বের হার ঠিকই বৃদ্ধি পেয়েছে। বয়সসীমা বৃদ্ধি করা বা না-করার ওপর বেকারত্বের হার বৃদ্ধি নির্ভর করেনি। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্বের হার কমানো যেতে পারে। কিন্তু বেকারত্বের হার বাড়বে সন্দেহ করে কেউ কাউকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। আর বয়সসীমা ৩৫ করলে সব চাকরিপ্রার্থী জীবিকা নির্বাহের জন্য ৩৫ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, বিষয়টি এমন নয়। এদের মধ্যে অনেকেই অন্য কোনো কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করবে। এর পাশাপাশি হয়তো সরকারি চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যাবে। যারা ৩৫ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা না করে অন্য পেশায় চলে যাবে, তারা যাক। আর যারা সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে চায়, তাদের সেই সুযোগ থাকা উচিত। পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশের বেশি দেশ চাকরিপ্রার্থীদের এই সুযোগ দিয়েছে। আরেকটি যুক্তি দেয়া হয় যে, বয়সসীমা বৃদ্ধি করলে চাকরির বাজারে অসম প্রতিযোগিতা হবে। আদতে, এখানে সম-অসম প্রতিযোগিতার বিষয়টি অবান্তর। প্রতিযোগিতা হবে মেধার ভিত্তিতে। বয়সের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা না হওয়াই উচিত। কারণ এটা কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নয় যে, বয়স ভিত্তিক দল গঠন করে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হবে। চাকরির বাজারে মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা হবে, বয়সের ভিত্তিতে নয়। এই বিষয়টি অনুধাবন করেই বিশ্বের অনেক দেশে চাকরিতে প্রবেশে কোনো বয়সের সীমারেখাই রাখেনি। সেসব দেশে মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে যেকোনো বয়সেই চাকরিতে যোগদান করা যায়। আরেকটি কথা বলা হয়, ত্রিশোর্ধ্ব ব্যক্তি নাকি ত্রিশের নিচে থাকা ব্যক্তির চেয়ে কাজ-কর্মে পিছিয়ে থাকবে। এই যুক্তিকে সবচেয়ে দুর্বল মনে হয়েছে৷ বয়স ত্রিশোর্ধ্ব হলেই তারা কম এনার্জেটিক হয়ে যাবে তা সত্য নয়। অনেক ত্রিশোর্ধ্ব ব্যক্তি অল্প বয়সী সহকর্মীর তুলনায় বেশি এনার্জেটিকও হতে পারে। ত্রিশোর্ধ্ব ব্যক্তি কোনো অংশেই ত্রিশের নিচে থাকা সহকর্মীদের চেয়ে কাজে পিছিয়ে থাকে না। বরং অভিজ্ঞতায় সে আরো এগিয়ে থাকে যা কাজকে আরো সুচারুভাবে করার সহায়ক হয়। এই বিষয়টি না বুঝেই বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশের বেশি দেশ এবং কি কানাডা, আমেরিকাও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫-এর বেশি নির্ধারণ করেছে নাকি?

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধিতে প্রশাসনিক অস্থিরতা বাড়বে, এ বিষয়টিও তেমন কোনো নিরাময় অযোগ্য ব্যাধি নয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব। এটা তেমন বড় কোনো ইস্যু হতে পারে না। আরেকটি যুক্তি দেয়া হয় যে, বয়সসীমা ৩৫ করলে প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিকতা সম্পন্ন করে চাকরিতে যোগদান করতে করতে অনেকের ৩৭ বছর বয়স হয়ে যায়। কথা হলো, অনেকের হয়। সবার তো হয় না। আর এখানে ৩৭ বছর হলেই সমস্যা কী? আমেরিকা, কানাডায় তো ৫৯ বছরেও চাকরিতে যোগদান করা যায়; সেখানে ৩৭ বছর তো আহামরি কিছু নয়। মাথায় রাখা উচিত, আমাদের গড় আয়ু কিন্তু বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে। আগের গড় আয়ুর ওপর নির্ভর করে কথা বললে চলবে না। তাই চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ না করার পেছনে যে যুক্তিগুলো দেয়া হয়, সেগুলো গ্রহণযোগ্য নয়।

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক সারজিস আলম বয়সসীমা বৃদ্ধির পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে সেটি ৩২ বছর। সারজিস আলম বয়সবৃদ্ধির পক্ষে মত দেয়ায় তাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু বয়সসীমা ৩২ বছর করার গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার দোহাই দিয়ে বয়সসীমা ৩২ বছর করার পক্ষে মত দিলেও দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণেই বরং চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করা অধিকতর যৌক্তিক। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে৷ সেশনজটের জাঁতাকলে পিষ্ট একজন চাকরিপ্রার্থীর ন্যায্য দাবি এটা হতেই পারে যে, ‘চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা অবশ্যই ৩৫ বছর করতে হবে’।

তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে চাকরিপ্রার্থীদের ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়নে তৎপর হওয়া এবং চাকরিপ্রার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছরে উন্নীত করে বহির্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় নজির স্থাপন করা।

লেখক: কলামিস্ট

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা মাহতাব মুহাম্মদ মুক্তমত

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর