দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার নতুন যাত্রা
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:৫২
বামপন্থি রাজনীতিবিদ অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকেই আস্থা রেখেছে দ্বীপরাষ্ট্র নান্দনিক সৌন্দর্যের দেশ শ্রীলঙ্কা। নিয়োগ হয়েছে দেশটির প্রধানমন্ত্রীরও। শ্রীলংকার নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে হরিণী অমরাসুরিয়াকে নিয়োগ দিয়েছেন দেশটির বামপন্থি প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া কুমার দিশানায়েকে। মঙ্গলবার শ্রীলংকার ১৬তম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন তিনি। নির্বচানের আগে ব্যাপক প্রচার করেন সব প্রার্থীই। দিশানায়েকের ন্যাশনাল পিপল’স পাওয়ার জোট ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশ ভোট পাওয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী দল সামাগি জন বালাওয়াগার (এসজেবি) নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা পেয়েছেন ৩২ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভোট। মাত্র ১৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে। এই দিশানায়েকই কিন্তু ২০১৯ সালের নির্বাচনে পেয়েছিলেন মাত্র ৩ শতাংশ ভোট। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই তিনি সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। সময় এবং জনগণ এরকমই। ইতিমধ্যে তিনি শপথ গ্রহণও করেছেন। সম্ভবত বিগত সরকারের দুর্নীতিতে দেশের অর্থনীতির করুণ দশা জনগণকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে এবং তারা এমন কাউকে খুঁজছিল যে তাদের আইকন হতে পারে। ২০২২ আর্থিক সংকটে জেরবার হওয়ার পরে এটাই শ্রীলঙ্কার প্রথম নির্বাচন। ওই বছরই তীব্র জ্বালানি সংকট, মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির কারণে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের বিরুদ্ধে চরমে ওঠে ক্ষোভ। রাজপাকসে পরিবারের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ঋণ ও আরও নান কারণে আর্থিক দিক থেকে দেউলিয়ার খাদে থাকা শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ভালোভাবেই। তবে দরকার ছিল একজন রাষ্ট্রনায়কের যার হাত ধরে এই উত্তরণ আরও তরাণি¦ত হবে। জনগণ এক্ষেত্রে বেছে নিয়েছে দিশানায়েককেই। যদি শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণকে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে সংক্ষেপে যা আসবে সেটি হলো, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, অতি বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় খাতে বিশাল ঋণ, দুদর্শিতার অভাব, বেকারত্ব বৃদ্ধি, বৈশ্বিক মন্দার কবলে পড়া ইত্যাদি। সুতরাং এখন শ্রীলঙ্কাকে ভালো অবস্থানে পৌছাতে হলে বর্তমান সরকারকে অর্থাৎ দিশানায়েককে প্রথমেই দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত প্রশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
দেশটির এক চতুর্থাংশ জনগণকে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে হবে। দেশটিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে এবং তাদের বোঝাতে হবে শ্রীলল্কা বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখন উল্লেখযোগ্য একটি দেশ। নতুন প্রেসিডেন্ট তার প্রচারণায় শিক্ষাক্ষেত্রে ২০,০০০টি নতুন চাকরি তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অর্থাৎ তাকে বেকারত্ব দূরিকরণে জোর দিতে হবে। কারণ পথ হারিয়ে সেখানে বেকারত্ব বেড়ে গিয়েছিল। দিশানায়েকের সামনে চ্যালেঞ্জ আরও রয়েছে। সেটি হলো এশিয়ার কূটনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখা। সম্ভবত এটিই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয়। কারণ ভারত ও চীনের প্রভাবের একদিকে ঝুলে পড়া যে বেশ বিপদজনক সেটি ভারত বিরোধী হিসেবে পরিচিত মালদ্বীপের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মইজ্জু হয়তো অনুধাবন করছেন। মুখে যাই বলা হোক না কেন, কাউকেই পাশ কাটিয়ে উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব না। যদিও দিশানায়েকের সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণে কিছুটা ভারত বিরোধী মনোভাবের কথা শোনা যায় কিন্তু আমার ধারণা দিশানায়েক এই ভুলটা হয়তো করবেন না। বরং ভারসাম্য নীতি বজায় রেখেই চলবেন। দিশানায়েকের ক্ষমতায় আসায় শ্রীলঙ্কার একটি বড় লাভও হয়েছে। সেটি হলো শ্রীলঙ্কা দীর্ঘদিনের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রাধান্য ছিল। এখন তা থাকছে না। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা পরিবারতন্ত্রের জাল ছিঁড়তে পেরেছে। নির্বচানে রনিল বিক্রমাসিংহেই ছিল দিশানায়েকের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। কারণ শ্রীলঙ্কার গণঅভ্যূত্থানের নানা পট পরিবর্তনের সময়ে দেশটির দায়িত্ব যায় রনিল বিক্রমাসিংহের হাতে। তিনিই কিন্তু এই দুই বছরে শ্রীলঙ্কাকে টেনে তুলেছেন। তারপরও তিনি হেরেছেন বামপন্থী এই রাজনীতিকের কাছে। এটাই জনগণ।
১৯৬৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন দিশানায়েক। রাজনীতির পথে হাঁটা শুরু করেন ছাত্র জীবন থেকেই। সেই হিসেবে বলা যায় তিনি একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক। ২০০০ সালে তিনি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০০৪ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি কৃষি, প্রাণিসম্পদ, ভূমি ও সেচ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রধান বিরোধী হুইপ হিসেবে কাজ করেন। ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ১৭তম জাতীয় কনভেনশনে তিনি জেভিপির নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে তিনি তৈরি করেছিলেন ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি)। তারপর নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনে তার দল মাত্র তিন শতাংশ ভোট পায়। সেখান থেকে ঘুরে দাড়িয়ে তিনি আজ শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হলেন। এর পেছনে অনেকগুলো কারণই রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আগের প্রেসিডেন্টের সিমাহীন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি এবং যার ফলে অতিষ্ঠ ছিল সাধারণ জনগণ, এছাড়াও বেকারত্ব দেশটির সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, চীনসহ কয়েকটি দেশের কাছে ঋণ হওয়া এবং বিপরীতে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমে যাওয়া, এর সাথে করোনা মহামারী ও পরবর্তী বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি দেশটিকে বিপর্যস্থ করে তুলেছিল যা দেশটির শাসক গোষ্ঠীর উপর থেকে জনগণের আস্থা তুলে নিতে ভূমিকা রেখেছিল। এর পাশাপাশি দিশানায়েকের দলের সেই সময় সাহসী ভূমিকার কারণে জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পায় এবং যার ফলশ্রুতিতেই এই বিজয়। জনগণের এই আস্থার অবদান দেওয়া সহজ হবে না দিশানায়েকের জন্য। কারণ অর্থনীতি এখনও বিপর্যস্থ। বৈদেশিক ঋণ এখনও মাথার উপর ঝুলছে। বেকারত্ব দূরিকরণে নিতে হবে বেশি কিছু সাহসী পদক্ষেপ। সংস্কার করতে হবে অর্থনৈতিক বিভিন্ন খাতে। পর্যটন শিল্পকে গতিশীল করতে হবে। দিশানায়েক নিশ্চয়ই সেসব ভালোই বুঝতে পারেন। শ্রীলঙ্কা পরিবারতন্ত্র থেকে মুক্ত হয়েছে এটাও যেন দেশটির একটি অর্জন। নতুন শ্রীলঙ্কায় দিশানায়েকের নেতৃত্ব কতটা শক্তিশালী হবে সেটি সময়ই বলে দিবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিষ্ট