বাংলাদেশে পরিবর্তনশীল অভিভাবকত্ব অনুশীলন
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৪০
বাংলাদেশে অভিভাবকত্বের ধারণা ও পদ্ধতি গত কয়েক দশকে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। দেশের দ্রুত নগরায়ণ, শিক্ষার বিস্তার এবং বিশ্বব্যাপী তথ্য ও প্রযুক্তির প্রসারের প্রভাবে অভিভাবকত্বের ধারণা নতুন রূপ নিচ্ছে।
আগের দিনে বাবা-মা তাদের সন্তানদেরকে অনেক কঠোরভাবে শাসন করতেন। বাচ্চাদেরকে শুধু বাবা-মার কথা মানতে হতো এবং তাদের আদেশ পালন করতে হতো। কিন্তু আজকাল, বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা অনেক বদলে গেছে। আমরা অন্য দেশের মানুষের সাথে যোগাযোগ করি এবং অনেক নতুন জিনিস শিখি। তাই বাবা-মাও আগের মতো কঠোর নয়। তারা এখন তাদের সন্তানদের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করেন এবং সন্তানদের মতামতকে গুরুত্ব দেন।
ঐতিহাসিকভাবে, বাংলাদেশে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান। এই ব্যবস্থায় বাবা পরিবারের প্রধান হিসেবে গণ্য হন এবং তাঁর কথাই চূড়ান্ত হিসেবে মেনে নেওয়া হয়। বাচ্চাদের কাছ থেকে অবাধ্যতা সহ্য করা হয় না। শারীরিক শাস্তি হল শৃঙ্খলা বজায় রাখার একটি সাধারণ পদ্ধতি, যা সমাজের সামগ্রিক মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে ধরে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশী সমাজে ব্যক্তির চেয়ে সমাজের স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে, শিশুদেরকে ছোটবেলা থেকেই পরিবার ও সমাজের নিয়মকানুন মেনে চলতে শেখানো হয়। তাদের ব্যক্তিগত মতামত বা অনুভূতির চেয়ে পরিবারের সম্মান ও ঐতিহ্য বজায় রাখাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
তবে বাংলাদেশে অভিভাবকত্বের অনুশীলন গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। এই পরিবর্তনগুলি মূলত দেশের দ্রুত নগরায়ণ, শিক্ষায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি এবং মিডিয়া ও প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী অভিভাবকত্বের প্রবণতার সংস্পর্শে আসার জন্য দায়ী করা যেতে পারে।
শিক্ষা, বিশেষ করে মহিলাদের শিক্ষার প্রসার, অভিভাবকত্ব শৈলী পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চালকদের মধ্যে একটি। শিক্ষার প্রবেশাধিকার উন্নত হওয়ার সাথে সাথে, অভিভাবকদের একটি নতুন প্রজন্ম ঐতিহ্যগত কর্তৃত্ববাদী মডেলকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশু বিকাশ ও মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত আধুনিক তত্ত্বের প্রচারের ফলে বাবা-মা তাদের সন্তানদের লালন-পালনে নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করছেন। তারা শাস্তির পরিবর্তে যোগাযোগ, বোঝাপড়া এবং ইতিবাচক শক্তিবৃদ্ধির মাধ্যমে সন্তানের ব্যক্তিত্ব গঠনে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের দ্রুত নগরায়ণের ফলে অভিভাবকত্বের ধারণা ও পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরে মানুষের স্থানান্তরের ফলে পারিবারিক কাঠামোতে পরিবর্তন এসেছে। বর্ধিত পরিবারের পরিবর্তে অণু পরিবারের সংখ্যা বাড়ার কারণে শহুরে পিতামাতাদের সন্তানদের লালন-পালনের দায়িত্ব আরও বেড়েছে। এছাড়া, শহুরে জীবনের চাপ, কর্মজীবী পরিবার এবং সন্তানদের শিক্ষাগত চাহিদা বাড়ার কারণে অভিভাবকত্বের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে।
আধুনিক শহরে জীবনযাত্রার ধরণ আগের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগতির হয়ে উঠেছে। বাবা-মায়েরা কাজের চাপে অনেক ব্যস্ত থাকেন। এই কারণে তারা সন্তানদের সাথে আগের মতো সময় দিতে পারছেন না। ফলে তারা সন্তানদের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য অনেক সময় নমনীয় হচ্ছেন। তারা সন্তানদের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করছেন, তাদের মতামত শুনছেন এবং তাদের স্বাধীনতা দিচ্ছেন। তবে একই সাথে তারা সন্তানদেরকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সীমাবদ্ধতাও আরোপ করছেন।
বিশেষ করে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া বাংলাদেশের অভিভাবকদের বিশ্বের বিভিন্ন অভিভাবকত্ব পদ্ধতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এখন বাংলাদেশি অভিভাবকরা অ্যাটাচমেন্ট প্যারেন্টিং, পজিটিভ প্যারেন্টিং, মন্টেসরি পদ্ধতিসহ নানা ধরনের অভিভাবকত্বের কৌশল সম্পর্কে জানতে পারছেন এবং সেগুলো তাদের সন্তানদের লালন-পালনে ব্যবহার করছেন।
আধুনিক বাংলাদেশী পরিবারগুলো শিশুদের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও বিকাশের দিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তা এবং মানসিক বুদ্ধিমত্তার মতো গুণাবলীকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে তারা চায় তাদের সন্তান যেন সুন্দর মানুষ হয়ে গড়ে উঠে।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান অভিভাবকত্বের ধারণাকেও বদলে দিয়েছে। আর্থিক সচ্ছলতার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের শিক্ষা, বিনোদন এবং ব্যক্তিগত বিকাশের জন্য আরও বেশি সুযোগ করে দিতে সক্ষম হচ্ছে। এর ফলে অভিভাবকরা সন্তানদের সার্বিক উন্নয়নের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন এবং আগের তুলনায় আরও সহায়ক ও উন্নত পদ্ধতিতে তাদের লালন-পালন করছেন।
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে জড়িত করতে চায়। তারা চায় তাদের সন্তানেরা নিজের মতামত দিতে পারে এবং নিজের পছন্দগুলো বেছে নিতে পারে। এটা এক ধরনের গণতান্ত্রিক পরিবার পরিচালনার দিকে ইঙ্গিত করে। তারা চায় তাদের সন্তানরা আজকের জগতে সফল হোক, যেখানে স্বাধীন চিন্তা, সমস্যা সমাধান এবং অন্যদের সাথে মিশে কাজ করার দক্ষতা খুবই জরুরি।
তবে, শহর ও শিক্ষিত পরিবারগুলোতে আধুনিক অভিভাবকত্বের ধারণা প্রচলিত হলেও, গ্রামীণ ও কম পড়াশোনা করা পরিবারগুলোতে এখনও পুরনো ধরনের কর্তৃত্ববাদী অভিভাবকত্ব চলে। এই পরিবারগুলোতে বাবা-মা তাদের সন্তানদের উপর বেশি নিয়ন্ত্রণ রাখতে চান এবং শিশুদেরকে শাসন করতে বিশ্বাস করেন। তারা সাধারণত রক্ষণশীল মূল্যবোধ মেনে চলেন এবং শিশুদেরকে আনুগত্য ও শৃঙ্খলা শিখাতে গুরুত্ব দেন।
শিক্ষার সীমিত সুযোগ, দারিদ্র্য এবং পুরাতন ধারণাগুলোর প্রভাবের কারণে অনেক পরিবার এখনও কঠোর নিয়মকানুনের মাধ্যমে তাদের পরিবারকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারা মনে করে এইভাবেই তারা তাদের সন্তানদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে এবং পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারবে।
উপরোক্ত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, বাংলাদেশে শিশুদের প্রতি আরও ভালোভাবে দায়িত্ব নেওয়ার নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করার প্রবণতা বাড়ছে। শিশু অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, সরকারি উদ্যোগ এবং ইউনিসেফের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাজের ফলে দেশে অভিভাবকত্বের ধারণা বদলাচ্ছে।
শিশু অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইনগত ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার ফলে শিশুদের প্রতি শারীরিক শাস্তির প্রচলন কমে যাচ্ছে। একইসাথে, শিশুদের অধিকার এবং সুরক্ষার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সাথে সম্পর্ক গড়ার নতুন উপায় খুঁজছেন।
বাংলাদেশে পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় পিতারা কেবল পরিবারের উপার্জনকারী নন, তারা সন্তানদের সার্বিক বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। আগে মূলত মাতারা সন্তানদের দেখাশোনা করতেন, কিন্তু এখন পিতারাও সন্তানদের শিক্ষা, সামাজিক বিকাশ এবং মানসিক সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে সামনের সারিতে আছেন।
যাইহোক, যেহেতু লিঙ্গ ভূমিকা আরও শিথিল হয়ে ওঠেছে এবং পিতারা তাদের সন্তানদের লালন-পালনে আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করছেন, বাংলাদেশে অভিভাবকত্ব আরও সহযোগিতামূলক হয়ে উঠছে। অনেক বাবা এখন গৃহকর্মে সাহায্য করা, বিদ্যালয়ের প্যারেন্টস মিটিংএ যোগদান, এবং তাদের সন্তানদের সাথে মানসম্পন্ন সময় কাটানো, অতীতের কঠোর, কর্তৃত্ববাদী চিত্র থেকে দূরে সরে যাওয়ার মতো কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করে।
বাংলাদেশের পরিবর্তিত সমাজে অভিভাবকত্বের ধারণাও পাল্টেছে। আগের মতো কঠোর শাসন-নিষেধের পরিবর্তে, এখন শিশুদের স্বাধীনতা দিয়ে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শহর ও গ্রামের মধ্যে এই পরিবর্তনের গতি ও পরিমাণ ভিন্ন হলেও, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশী পরিবারগুলো শিশু-কেন্দ্রিক অভিভাবকত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে অভিভাবকত্বের ধারণা দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। শিক্ষার ব্যাপকতা, শহরে মানুষের জীবনযাপন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিভাবকত্বের ধারণা আমাদের দেশে আসার কারণে এই পরিবর্তন হচ্ছে। নারী-পুরুষের ভূমিকাও এই পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ আধুনিক হওয়ার সাথে সাথে অভিভাবকত্বের ধারণাও আরও আধুনিক হচ্ছে।
এখনকার অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের লালন-পালনে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন এবং তারা তাদের সন্তানদের স্বাধীনভাবে ভাবতে এবং কাজ করতে উৎসাহিত করেন। তবে একই সাথে তারা নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকেও ভুলেন না।
এই পরিবর্তন বাংলাদেশী সমাজের নতুন আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে। আজকের বাবা-মা তাদের সন্তানদের আরও আত্মবিশ্বাসী, সৃজনশীল এবং এই জটিল পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম করে গড়ে তুলতে চান।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা