শরৎ বাংলাদেশের কোমল স্নিগ্ধ এক ঋতু
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৪
শরৎ বাংলাদেশের কোমল স্নিগ্ধ এক ঋতু। শরৎ ঋতুর রয়েছে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের ছয়টি ঋতু ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন রূপের পসরা নিয়ে হাজির হয়। এক এক ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন ফুলে,ফলে,ফসলে সেজে ওঠে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর আর কোন দেশের প্রকৃতিতে ঋতু বৈচিত্রের এমন রূপ মনে হয় নেই।
শরৎকালের প্রকৃতি হয় কোমল, শান্ত-স্নিগ্ধ,উদার। ক্ষণিকের জন্য বৃষ্টি আর কখনো রৌদ্রজ্জ্বল নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা।নদী,বিল,পুকুর ও হাওরের স্বচ্ছ পানির বুকে শুভ্র লালপদ্মর হাসি প্রেয়সীর হাসির মতোই সুন্দর।শিশিরভেজা ঘাসের বুকে শিউলি ফুলের সৌন্দর্য প্রেয়সীর সৌন্দর্যের যে কম নয়।নদীর কিনারে বালির চরে হেসে ওঠা সারি সারি কাশফুল মন ছুঁয়ে যায় সবার।
শরতের ফুলে ফুলে সেজে উঠেছে গোটা প্রকৃতি।এ প্রকৃতিতে শাপলা, শালুক,জুঁই, কেয়া, কাশফুল, জবা, কামিনি, মালতি, মলিকা, মাধবী,দোলনচাঁপা, বেলি, জারুল, নয়নতারা, ধুতরা, ঝিঙে, জয়ন্ত্রী, শ্বেতকাঝন, রাধুচূড়া, স্থলপদ্মা, বোগেনভেলিয়াসহ নানা রকমের কত ফুলে হেসে ওঠে গ্রামবাংলার রূপ। সত্যি শরতের প্রকৃতি বড়ই বৈচিত্র্যময়, লাবণ্যময়ী।এজন্যই হয়তো ঋতুর রাণী বলাহয় শরৎকালকে।
বাংলা সাহিত্যের অমর বটবৃক্ষ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋতু বন্দনার কবিতা, গান রচনা করেছেন প্রকৃতির সাথে মিশে। বিভিন্ন ঋতু ভিত্তিক তাঁর গান,কবিতা আছে অনেক।কবিগুরূ শরৎ নিয়ে লিখেছেন-
‘শরৎ তোমার অরূণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাড়িয়ে মোহন অঙ্গুলি।
শরৎ তোমার শিশির ধোওয়া কুন্তলে
বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।’
বাংলা সাহিত্যাকাশে উজ্জ্বল ধুমকেতু কবি কাজী নজরুল ইসলাম। অন্যায়, অত্যাচার, পরাধীনতা তাঁকে বিদ্রোহী করে তুললেও; প্রেম, বিরহের চির কাঙ্গাল কবি শরতেরও জয়গান গেয়েছেন তাঁর কবিতা আর গানে।”রাখি বন্ধন” কবিতায় কবি শরৎ কালের রূপ তুলে ধরেছেন এভাবে-
‘সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরণী?
নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরনী!
অলাকার পানে বলাকা ছুটেছে মেঘদূত মন মোহিয়া
চঞ্চু রাঙা কলমীর কুড়ি মরতের ভেট বহিয়া।
সখির গাঁয়ের সেঁউতি বোটার ফিরোজায় ঢঙ পেশোয়াজ
আসমানী আর মৃন্ময়ী সখি মিশিয়াছে,মেঠোপথ মাঝ।’
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে বাংলার প্রকৃতিকে এঁকেছেন। বাংলার হিজল, তমাল, ধানসিঁড়ি নদীর মতো শরৎও কবির কবিতায় এসেছে সার্থক রূপে।কবিজীবনানন্দ দাশ লিখেছেন-
‘এখানে আকাশ নীল/নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল/ফুটে থাকে হিম সাদা রঙ আশ্বিনের আলোর মতোন;আকন্দ ফুলের কালো ভীমরূল/এইখানে করে গুন্জরণ।’
শরৎ উৎসবেরও ঋতু। শিউলির মিষ্টি সুবাস আর কাশফুলের দুলোনিতে যেন দেবী দুর্গার আগমনকে ইঙ্গিত দিতে থাকে। শরতের মূল আকর্ষণ দুর্গাপূজা। যা বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব। সমগ্র বাংলাজুড়ে পালিত হয় এ উৎসব। শরৎকালে এ পুজো হয় বলে দুর্গাপূজাকে শারদীয় উৎসব বলা হয়। এ ঋতুতে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে। দেবী দুর্গার আগমনের জন্য তারা সারাবছর অপেক্ষায় থাকে। সেই অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে দেবী দুর্গা শরতের আশ্বিনে নিয়ে আসেন অনাবিল আনন্দ। বাংলার আকাশে বাতাসে মুখরিত হয় দেবী দুর্গার আগমনধ্বনি। উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে বাংলার মানুষজন।বাংলার প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা ছাড়াও এসময়ে লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা উদযাপিত হয়। পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গার আরাধনা ও বিসর্জন শেষে আগমন ঘটে ধনদাত্রী দেবী লক্ষ্মীর। কিছুদিন পরই রাতের আকাশে আতশবাজির ঝলকানি নিয়ে আসে দীপাবলি উৎসব কালীপূজা। ভাইফোঁটা, জগদ্ধাত্রী পূজা সবই শরতের উপহার। শরতের নানা উৎসব এসময় মানুষের মনকে আনন্দে ভরিয়ে রাখে।
শরতের রুপ আর আগের মতো নেই।ইট কংক্রিটের শহরে শরতের রুপ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।কাশবনে গড়ে উঠছে বড় বড় অট্টালিকা।
তবুও শরৎ বাঙালির প্রেমের ঋতু। ভালোবাসার ঋতু। উৎসবের ঋতু। সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ঋতু। প্রকৃতি পরিবেশকে মায়াময় আর স্নিগ্ধ করার ঋতু।শরতের নীলাকাশের মতো কাশফুলের মতো শুভ্র এবং প্রকৃতির মতো শান্ত কোমল হোক আমাদের মন।
লেখক: সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মী
সারাবাংলা/এজেডএস