বাংলাদেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৯:৩২
আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস প্রতি বছর ১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়, যা প্রবীণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, তাদের অধিকার ও অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে গণ্য হয়। জাতিসংঘ ১৯৯০ সালে এই দিবসটি পালনের ঘোষণা দেয়, যার লক্ষ্য প্রবীণদের প্রতি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কার্যকর নীতি গ্রহণ এবং তাদের প্রতি পরিবারের পাশাপাশি সমাজের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা। ২০২৪ সালে এই দিবসটি আরও বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে, কারণ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই জনমিতিক পরিবর্তনের ফলে বয়স্ক জনসংখ্যার সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭ শতাংশেরও বেশি প্রবীণ, এবং আগামী দশকগুলোতে এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং প্রজনন হারের নিম্নগতি দেশের জনসংখ্যার গঠনকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করছে। এর ফলে প্রবীণদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন বাড়ছে।
বাংলাদেশে প্রবীণদের প্রধান সমস্যা হলো সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। দেশে খুব কম সংখ্যক প্রবীণরা পেনশন বা কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা পান। বিশেষ করে গ্রামের প্রবীণদের অবস্থা আরও করুণ, যাদের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রায় অনুপস্থিত। অনেক প্রবীণ ব্যক্তি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করছেন, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এছাড়াও, দেশের অনেক প্রবীণ নারী বিধবা হিসেবে একাকিত্ব এবং আর্থিক অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। এই সকল সমস্যা মোকাবিলায় বিশেষভাবে প্রবীণদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সম্প্রসারণ এবং প্রবীণ নারীদের জন্য নির্দিষ্ট সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা জরুরি।
বাংলাদেশ বর্তমানে একটি জনমিতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে দেশের জন্য গভীর প্রভাব ফেলবে। গত কয়েক দশকে স্বাস্থ্যসেবা, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, যার ফলে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এই পরিবর্তন দেশের জনস্বাস্থ্যের অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি ইতিবাচক প্রতিফলন হলেও এটি কিছু জটিল চ্যালেঞ্জও বয়ে আনছে। বাংলাদেশের বয়স্ক জনসংখ্যা সমাজ এবং অর্থনীতিতে বহুমুখী প্রভাব ফেলছে, যা টেকসই উন্নয়ন এবং প্রবীণদের সুষ্ঠু জীবনযাপনের জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে।
বাংলাদেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হলো গড় আয়ুর উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। ১৯৭১ সালে যেখানে মানুষের গড় আয়ু ছিল প্রায় ৪৬ বছর, ২০২৩ সালে তা প্রায় ৭৩ বছরে পৌঁছেছে। এতো অল্প সময়ে আয়ু বৃদ্ধির পেছনে স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি, চিকিৎসা সুবিধার প্রসার এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশের প্রজনন হার দ্রুত হ্রাস পেয়েছে, ১৯৭১ সালে প্রতি মহিলার ৬.৩ সন্তান থেকে কমে ২০২৩ সালে এটি দাঁড়িয়েছে ২.১-এ। ফলে, দেশের জনসংখ্যার গঠনেও পরিবর্তন ঘটছে এবং বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
এই জনমিতিক পরিবর্তনের সামাজিক প্রভাব ব্যাপক। ঐতিহ্যগতভাবে, বাংলাদেশে প্রবীণদের যত্নের দায়িত্ব মূলত পরিবারের উপর নির্ভর করে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রবীণরা তাদের সন্তান বা বৃহত্তর পরিবারের সাথে বসবাস করে এবং সেখানে তারা যত্ন এবং সমর্থন পান। তবে, নগরায়ন এবং অভিবাসনের ফলে এই পরিবারভিত্তিক যত্ন ব্যবস্থায় চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক তরুণ চাকরি বা উন্নত জীবিকার সন্ধানে শহরে বা বিদেশে চলে যাচ্ছে, ফলে বয়স্ক ব্যক্তিরা সামাজিক সহায়তার অভাবে পড়ছেন। এই পরিবর্তিত সামাজিক কাঠামো বয়স্কদের জন্য আনুষ্ঠানিক যত্নসেবা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা বাড়াচ্ছে, যা বাংলাদেশের অনেক এলাকায়, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে, এখনও সীমিত।
স্বাস্থ্যসেবার চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রভাবও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কর্মক্ষম বয়সের মানুষের সংখ্যা হ্রাসের সাথে সাথে বয়স্ক মানুষের ওপর নির্ভরশীলতার হার বাড়বে। ফলে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে গেলে বয়স্কদের সমর্থনের চাপ আরও বাড়বে। অনেক উন্নত দেশে পেনশন এবং সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে বয়স্কদের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়, কিন্তু বাংলাদেশের পেনশন ব্যবস্থা খুব সীমিত, যা শুধুমাত্র সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য প্রযোজ্য। দেশের অধিকাংশ প্রবীণ নাগরিকদের কোনো আনুষ্ঠানিক অবসরকালীন সঞ্চয় নেই এবং তারা তাদের পরিবারের উপর নির্ভরশীল।
বয়স্ক নাগরিকদের জন্য একটি শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার অভাব বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক প্রবীণ ব্যক্তি এখনও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, যেমন কৃষি বা ছোট ব্যবসায় জড়িত, কারণ তাদের কাছে আর্থিক নিরাপত্তার জন্য কোনো বিকল্প নেই। তাদের শারীরিক সামর্থ্য কমে আসার সাথে সাথে তাদের দারিদ্র্যের ঝুঁকি বাড়ছে। প্রবীণদের আর্থিক দুর্বলতা দূর করতে পেনশন ব্যবস্থা এবং বৃদ্ধভাতা সম্প্রসারণ করা অত্যন্ত জরুরি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি চালু করেছে, কিন্তু এর কাভারেজ এবং সুবিধার পরিমাণ বর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়।
অর্থনৈতিক দিক থেকে বয়স্ক জনসংখ্যার একটি অন্যতর প্রভাব হলো, জনগণের চাহিদা পূরণে সরকারি ব্যয়ের চাপ বৃদ্ধি। বয়স্ক মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ার কারণে সরকারকে স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, শিক্ষা এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ কমাতে হতে পারে। এজন্য প্রবীণদের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সঠিক নীতিমালা তৈরি করা অপরিহার্য হবে।
তবে বয়স্ক জনসংখ্যা কিছু সুযোগও বয়ে আনছে। বাংলাদেশের অনেক বয়স্ক মানুষ এখনও কর্মক্ষম এবং সমাজের জন্য তাদের মূল্যবান দক্ষতা, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা দিতে সক্ষম। প্রবীণদের অবদান স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে দেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, প্রবীণরা তরুণদের জন্য পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করতে পারে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে। বয়স্কদের জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের জন্য নমনীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে, যা তাদের কর্মক্ষম রাখতে সহায়তা করবে এবং তরুণ প্রজন্মের উপর নির্ভরশীলতার চাপ হ্রাস করবে।
তাছাড়া, প্রজন্মের মধ্যে সংহতি বৃদ্ধিও একটি বৃদ্ধিশীল সমাজের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পরিবার ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত করে প্রবীণদের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব। বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ, যেমন তরুণদের প্রবীণদের সাথে বন্ধুত্ব ও সেবা প্রদানের কর্মসূচি, উভয়ের জন্যই উপকারী হতে পারে। তরুণরা প্রবীণদের থেকে জীবনদর্শন এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে, অন্যদিকে প্রবীণরা সমাজে ইতিবাচক সামাজিক সম্পর্ক ও সহায়তা পান।
প্রবীণ সমাজের চাহিদা মেটাতে নারীর বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি দিন বাঁচেন এবং নারীদের মধ্যে বয়স্কদের সংখ্যা বেশি। তবে, নারীরা প্রায়ই দারিদ্র্যের শিকার হন কারণ তারা কর্মজীবনে পুরুষদের তুলনায় কম সুযোগ পান এবং তাদের সঞ্চয়ও কম থাকে। এছাড়াও, অনেক প্রবীণ নারী বিধবা হয়ে একা বসবাস করেন, যা তাদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং আর্থিক অনিশ্চয়তার ঝুঁকি বাড়ায়। এজন্য প্রবীণ নারীদের জন্য নির্দিষ্ট সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের বয়স্ক জনসংখ্যার এই বাস্তবতা মোকাবিলায় সরকার, বেসরকারি খাত, এবং নাগরিক সমাজকে একসাথে কাজ করতে হবে। প্রবীণদের জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করে একটি টেকসই সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সারাবাংলা/এজেডএস
বাংলাদেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব মো. বজলুর রশিদ