কন্যাশিশুর অধিকার এবং আমাদের দায়িত্ব
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৪৫
দক্ষিণ এশিয়ার, আফ্রিকা এবং বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কন্যাশিশুর একজন পূর্ণাঙ্গ নারী হয়ে ওঠার পেছনে বহুমুখী সামাজিক বাধা কাজ করে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ের পেছনের কারণগুলো হলো দারিদ্রতা,সামাজিক বিশৃঙ্খলা,নারী উন্নয়নের প্রতিকূল পরিবেশ, অভিভাবকের অসচেতনতা প্রভৃতি। ছেলে সন্তানের মতো সমান দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বড় হওয়ার সুযোগ পায় না কন্যা সন্তান। একটি মেয়েশিশু লেখাপড়া শুরু করার পরেও মাধ্যমিক পাস করতে করতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। ফলে সেই মেয়েটির চোখে যে স্বপ্ন ছিল তা স্বপ্নেই থেকে যায়। আবার প্রাথমিকেও বিয়ে হওয়ার ঘটনা ঘটছে। দেখা যায় পিইসি, জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষায় যেসব মেয়ে পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে তাদের অনেকেই বিয়ে জনিত কারণে। অনেকটা গোপনেই এই বিয়ের কাজটা সম্পন্ন হয়। মাঝে মধ্যে বাল্য বিয়ে বন্ধ হওয়ার খবরও পাওয়া যায়। কিন্তু কতদিনে মন থেকে মেয়েদের বাল্যবিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিটি অভিভাবক একমত হবেন তা আমাদের অজানা। অভিভাবকদের অসচেতনতা এবং বহুকাল ধরে কন্যাশিশু নিয়ে যে ধারণা রয়েছে তার পরিবর্তন আজও হয়নি। করোনা মহামারীতে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় এই প্রবণতা আরও বেড়েছে এবং অনেকেই বিয়ে দিয়ে দেওয়াই সর্বোত্তম বলে বিবেচনা করছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জরিপের তথ্যে জানা যায়, দেশে করোনার প্রকোপে বাল্য বিয়ের হার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
কন্যা সন্তান বা ছেলে সন্তান জন্ম দেওয়া একজন মায়ের বা বাবার ইচ্ছাকৃত কোন বিষয় নয়। কিন্তু অবাক বিষয় হচ্ছে এই নারীদেরকেই কন্যাশিশু জন্ম দেওয়ার কারণে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হয়। অতীতকাল থেকেই এটা আমাদের সামজে দোষারপ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য বড় ধরনের দুর্ভাগ্য। আজ আমরা যারা শিক্ষিত, যারা প্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছি তাদের তো একটাই কথা- ছেলে হোক মেয়ে হোক সে তো একই কথা। যেখানে প্রতি পদক্ষেপে তাকে মোকাবেলা করতে হবে বাধা বিপত্তি। একটু বড় হলেই রাস্তাঘাটগুলো তার একাকী চলার জন্য ক্রমেই বিপদসংকুল হয়ে ওঠে। রাস্তায় লুকিয়ে থাকে মুখোশ পরা হিংস্র মানুষের বিপদ। এরকম পশু সম মানুষ দিয়ে আমাদের সমাজটা ভরে উঠছে। ছেলেকে যেমন মানুষ করার শিক্ষিত করার লক্ষ নিয়ে বাবা মা বড় করে মেয়েকেও ঠিক একই চিন্তা ভাবনায় মানে মানুষ করার চিন্তা ভাবনায় বড় করা উচিত। ছেলে বা মেয়ে না বরং সন্তান মানুষ করা, তাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করাই বড় কথা। কিন্তু আমাদের সমাজে প্রচলিত বিশ্বাসে ছেলে বড় হলে চাকরি করবে আর মেয়ে বড় হলে বিয়ে দিয়ে শশুড়বাড়ি পাঠাতে হবে এই চিন্তা চেতনা থেকে কি আজও আমরা বের হতে পেরেছি। আমাদের উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে যদিও ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক পরিবারেই বিয়ে দিয়ে দেওয়াই যেন মেয়ের চূড়ান্ত পরিণতি একথা জন্মের পর থেকেই মনে মনে ঠিক করে রাখা হয়। এই অবস্থারও পরিবর্তন ঘটছে কিন্তু তা খুব ধীর গতিতে।
এক সময় ছেলে আর মেয়েতে ছিল বিস্তর বিভেদ। অনেক পরিবারে মেয়ে জন্ম হলে যেন পরিবারে আনন্দিত হবার বদলে কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা যেত। কন্যাশিশু জন্ম হওয়াতে পরিবারের সবার কপালে এই ভাঁজ পরতো। মেয়েদের ক্ষেত্রে ছিল পদে পদে নিষেধাজ্ঞা। তাদের পৃথিবী ছিল ছোট। মেয়েদের এটা করা যাবে না ওটা করা যাবে না। এখানে মেয়েদের থাকা ঠিক না বা মেয়েরা এ কাজ করতে পারে না। তাদেরকে নানাভাবে ছোট করা হয়েছে, বানানো হয়েছে পুতুল। কতশত নিয়মের বেড়াজালে ছিল বন্দি ছিল মেয়েদের জীবন। মেয়েদের ঘরের বাইরে বের হওয়াই ছিল প্রায় নিষেধ। একটা সময় ছিল না লেখাপড়া করার মত সুযোগ ছিল কম। নারীরা পুরুষের সাথে সমানভাবেই এগিয়ে চলেছে কিন্তু কন্যাশিশু থেকে নারী হয়ে ওঠার পরেই সে প্রতিযোগীতার সুযোগ পাচ্ছে। যে কন্যাশিশুরা নির্দিষ্ট বয়সের অনেক আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসছে তারা সন্তান জন্ম দেওয়া এবং স্বামী-সংসার দেখাশোনা ছাড়া আর কিছুই করছে না।
প্রযুক্তির উৎকর্ষে পৃথিবী এগিয়েছে। সেই সাথে এগিয়েছে মানুষের ধ্যান ধারণা চিন্তা চেতনা। চেতনার উৎকর্ষে আজ নারী পুরুষের বিভেদ, হিনমন্যতা সমাজ থেকে কমছে। কিন্তু আজও আমরা পারিনি সমাজ থেকে ছেলে মেয়ের সমান অধিকার সমভাবে নিশ্চিত করতে। পারিনি কন্যাশিশুদের যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে। আজও সমাজের অনেক জায়গায় কন্যা শিশু জন্ম নেওয়ার কারণে স্ত্রীকে লাঞ্চনার শীকার হতে হয়। আজও কন্যা শিশু জন্ম নিলে অনেকে হীন মানসিকতায় ভোগে। এটা আমাদের অনেকের হীন মানসিকতার ব্যাপার। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে ৩০ তারিখে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য কন্যা শিশুর বড় হয়ে ওঠার পরিবেশ বাধামুক্ত করা। আজকের কন্যা শিশু এরা একটা শক্তি যাদের বাদ দিয়ে কোন ক্ষেত্রেই সফলতা আসবে না।
আমাদের শহরের বাল্য বিয়ের অবস্থা কিছুটা পাল্টালেও গ্রামের চিত্র কিন্তু ভাল নয়। গ্রামের মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায় ক্লাস সেভেন, অষ্টম থেকেই বিয়ে দেবার তোড়জোড় শুরু করে অভিভাবকরা। কোথাও কোথাও পঞ্চম শ্রেণি থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়। এসব অভিভাবকদের বেশীর ভাগই কিন্তু নিরক্ষর বা অক্ষরজ্ঞান সম্পুন্ন। বাল্যবিয়ে আজও আমাদের দেশের উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় একটি বাধা। কেবল আমাদের দেশেই নয় অনেক উন্নয়নশীল দেশরই সমস্যা বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ে আমাদের উন্নয়নের গতি তরান্বিত ব্যাহত করছে। বাল্যবিয়ে একজন কন্যাশিশুর অধিকার ও সুযোগকেই হরণ করে না বরং তার নারী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি করে। আমাদের মত অনেক দেশেই কন্যা শিশু ভ্রণ অবস্থাতেই ঘৃণার শিকার হয়। পার্শ্ববর্তী ভারতে নিষিদ্ধ হলেও কন্যা শিশুর ভ্রুণ হত্যার হার অনেক বেশি। এর সাথে জড়িত যেমন কিছু অসাধু ডাক্তার তেমনি সেই ভ্রুনের অধিকারি মা ও তার পরিবার রয়েছে। সেখানে এমন অনেক রাজ্যই রয়েছে যেখানে বিয়ের উপযুক্ত পাত্রীর সংখ্যা হাতে গোণা। অন্য রাজ্য থেকে রীতিমত দালাল ধরে মেয়ে আনতে হয়। এটা প্রকৃতির ভারসাম্যকে নষ্ট করে দিচ্ছে। মেয়েদের বোঝা হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা আজও তারা ত্যাগ করতে পারেনি। ফলে অনেক মেধাবী কন্যাশিশুকেই অসময়ে বিয়ের পিড়িতে বসে মেধা বিকাশের সুযোগটাই হত্যা করা হয়। দেশের উন্নয়ন করতে হলে নারীর উন্নয়ন আবশ্যক আর আজকের কন্যাশিশু আগামী দিনে একজন প্রতিষ্ঠিত মহিয়সী নারী। দেশ উন্নয়ন করতে হলে কন্যাশিশুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টানোর কোন বিকল্প নেই। সেটা পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। কারণ নিজে না বদলালে অন্যকে বদলানোর উপদেশ দিতে নেই। একটি পরিবারে সেক্ষেত্রে মা বাবার দায়িত্বই সর্বাধিক। পরিবারের অন্য সদস্যদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে রক্ষা করার জন্য তাকে বেড়ে ওঠার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য প্রথমে মা বাবাকেই এগিয়ে আসতে হবে। সম সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বাল্যবিয়েমুক্ত সমাজ গঠন কন্যাশিশুর বড় হয়ে ওঠার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই