খেটে-খাওয়া মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন কি হয়
৯ অক্টোবর ২০২৪ ১৭:২৩
আদিম সামন্ত সমাজ থেকে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা পর্যন্ত পৃথিবীতে দুই শ্রেণির মানুষের বসবাস করে। মালিক শ্রেণি এবং শ্রমিক শ্রেণি। মালিক শ্রেণি অর্থাৎ পুঁজিবাদীরা তার পুঁজি বিনিয়োগ করে শ্রমিকের শ্রমের দ্বারায় পুঁজির পাহাড় গড়ে তুলে। তাদের উদ্দেশ্য থাকে মুনফা করা এবং যত অল্প মূল্যে শ্রমিকদের শ্রম কিনে নেওয়া যায় তার জন্য চিন্তা স্থির রাখে। আর সেই সাথে শ্রম দাস হিসেবে যতদিন ব্যবহার করা যায় তার নতুন কৌশল অবলম্বন করে। পুঁজিবাদ ধর্ম বিভেদ সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে। সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করে দেশকে কোলানি রূপান্তরিত করে শিল্প-বাণিজ্যের নামে জনগণকে শোষণ করে। পুঁজিবাদ সমাজের দ্বন্দ্ব তৈরি করে মানুষকে চিন্তাদাস বানায় রাখে।
মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে অমানবিক তৈরি করে পুঁজিবাদ। যার কারণে পারিবারিক বন্ধন গুলো ভেঙ্গে যায়। পুঁজির সঠিকভাবে ব্যবহার না কারণে শোষিতরা বেশি শোষিত হচ্ছে। পুঁজিবাদীরা পুঁজির পিরামিড তৈরি করছে। পুঁজিবাদ নিয়ে লেখার শুরুর আগে আমার এক প্রিয় কবি সাথে আলোচনা হয়েছিল। ওনাকে বললাম, পুঁজিবাদের ভয়াল গ্রাসে গোটা জাতি। তাৎক্ষণিক ভাবে তাঁর কবিতার শব্দে ছন্দ মিলিয়ে বললেন, “একদিকে পুঁজিবাদ আরেক দিকে খুঁজি ভাত” তাই আজকে লেখার শিরোনাম কবির ছন্দখানি দিলাম। অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকটভাবে ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের দেশে।
১৯৭১ সালে জন্ম নেওয়া সবুজ শ্যামল সোনালি রূপসী বাংলাদেশ। পুঁজিবাদীদের রূপের নেই শেষ! সেই রূপের চিত্র স্পষ্ট হয়েছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার। গত ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছে, সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিনজন জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্সসহ আটজনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আসামিদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ গ্রহণ এবং সরকারি ওষুধ ও চিকিৎসার সরঞ্জাম বিক্রি করে হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে।
ফলে এরকম চুনোপুঁটি ধরতে গিয়ে পুঁজিবাদের একেকটা রাঘববোয়ালদের আগমন ঘটছে। লুটপাট আর দুর্নীতির মাধ্যমে পুঁজিবাদীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে চলছে। ক্ষমতা পরিবর্তনের রাজনীতিতে পুঁজিবাদীরা ক্ষমতার সুযোগ সুবিধা ভালো পেয়ে থাকে। তবে একটা প্রশ্ন ঘোরপ্যাঁচ খাচ্ছে, বিশ্বের অন্যন্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু নিম্ম আয়ের শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যের অগ্রযাত্রা কি এগিয়ে যাচ্ছে? সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ থেকে শুরু রাতে বিছানায় শোয়া পর্যন্ত যতগুলো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র ব্যবহার করি কিংবা খাবার হিসেবে গ্রহণ করি তার প্রত্যেকটি শ্রমিকের শ্রমের ফলে পাই। অথচ রাষ্ট্রযন্ত্রের এক অবহেলিত শ্রেণির নাম শ্রমিক শ্রেণি।
তবে আশ্চর্যের বিষয় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠন করা হয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকারের শাসনামলে ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়ায় তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা দীর্ঘদিন কারখানাগুলোতে তীব্র শোষণ-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বহু কারখানায় নতুন মজুরি কাঠামোও বাস্তবায়ন হয়নি। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে বর্তমান মজুরিতে শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। শ্রমিকদের সংকট নিরসন না করে শ্রমিক ছাঁটাই, নির্যাতন, পুলিশ দিয়ে আশুলিয়ায় শ্রমিক কাওসার হোসেন খানকে হত্যা করা হয়েছে।
ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন দম করা কিংবা পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারীকে হত্যা শেখ হাসিনা সরকার শিখে গেছে। এখনও যদি এই সংস্কৃতি চালু থাকে তাহলে পার্থক্য কোথায়? শ্রমিক কাওসারের মৃত্যু হলো কিন্তু তার পরিবারের সদস্যদের ডাল, ভাতের জন্য আয়-রোজগার করবে কে? রাষ্টযন্ত্রের শোষণের সংস্কৃতি সংস্কার করতে না পারলে পুঁজিবাদীদের জাঁতাকলে শোষিত হবে শ্রমজীবী মানুষ।
জুলাই-আগস্টের স্বৈরাচার পতনের যে আন্দোলন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেই আন্দোলনে শ্রমিকরা জীবন দিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে বৈষম্য এখনও চলমান। হাসিনা সরকার আমলে দেখা গেছে ব্যাংক থেকে লাখ লাখ কোটি কোটি টাকা তুলে তারা পরিশোধ করে না, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অর্থ চুরি করেছিল, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করেছিল এবং বর্তমানেও চলছে, ঠিকাদাররা এক টাকা পণ্যের খরচ ১০০ টাকা দেখিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য থেকে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচজন। তিন বছর পর ১৯৭৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনে। পাঁচ বছর পর ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে কোটিপতি ছিলেন ৯৮ জন। সর্বশেষ ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রক্ষেপণ ধরে ওয়েলথ-এক্স’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩ কোটি ডলারের বেশি সম্পদের মালিকদের সংখ্যা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। দেশ স্বাধীনের পর যত যুগ অতিক্রম করছে ততো কোটিপতিদের সংখ্যা পিরামিড আকারে বাড়তে থাকে। ফলে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। অন্য দিকে গরিবরা আরও গরিব হচ্ছে। কেউ খাবার না পেয়ে অপুষ্টিতে ভোগে আবার কেউ অতিরিক্ত খাবার পেয়ে রোগ নিয়ে দেশবিদেশে ঘুরে। এজন্য শিরোনাম ‘একদিকে পুঁজিবাদ আরেক দিকে খুঁজি ভাত’
উদ্বিগ্নতার জায়গা হলো বাংলাদেশে ভূমিহীনদের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে এক শ্রেণির মানুষ রাতারাতি পুঁজির সম্রাট হয়ে ওঠে। আরেক শ্রেণির মানুষ সর্বহারা হয়ে রুটি রুজির সংগ্রাম করে। তবে লড়াই সংগ্রামের নতুন ইতিহাস তৈরি করলো আমাদের দেশের ছাত্র জনতা। ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ নতুন এক দিগন্তের নব সূচনা। বাংলাদেশের মানুষের পুঞ্জীভূত দুঃখ-দুর্দশা মোচনের আশায় নেমেছে রাজপথে। মৃত্যু অথবা মুক্তির নেশায় ধরেছে স্লোগান। তবে আমাদের দেশের মানুষের পুঞ্জীভূত দুঃখ-দুর্দশা বিশ্লেষণ করলেই শাসকের চরিত্র আর পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠবে।
সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার পণ্যে পরিনত করা হয়েছে। চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করতে না পেয়ে অনেকেই অকালে মৃত্যুবরণ করে। স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশার কারণে সরকারি হাসপাতাল গুলো সেবা না পেয়ে সাধারণ প্রাইভেট ক্লিনিক গুলোতে চিকিৎসা করে ভিটেমাটি পর্যন্ত বিক্রি করে জীবন রক্ষা করে। তাহলে চিকিৎসা ব্যবস্থা পুঁজিবাদীদের হাতে জিম্মি আছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান দিক কৃষি। বছরের পর বছর কাঠামোগত সহিংসতার শিকার হয় কৃষকরা। কৃষকের কৃষি ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে যখন দিনের পর দিন ঋণগ্রস্ত হয়ে যায় তখন ঋণের চাপে অনেকেই আত্মহত্যা করে আবার কেউ জমি বিক্রি করে সর্বহারা হয়ে যায়। এর মধ্যে বাজার সিন্ডিকেটের কারণে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায়। পুষ্টি গুণ এবং ক্যালোরি সমৃদ্ধ খাবার না পেয়ে অনেক মানুষ পুষ্টিহীনতা ভোগে। বিশেষ করে দেশে অধিকাংশ শিশু পুষ্টিহীনতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কাঠামোগত সহিংসতা যদি বন্ধ করা না হয় তাহলে সমাজের বৈষম্য কেমন করে দূর হবে?
অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন না করে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করছে। তবে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে সংস্কার করতে হবে। গণতন্ত্রের একটা অংশ হচ্ছে নির্বাচন পদ্ধতি। প্রথাগত নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কৃতি পাল্টাতে হবে। কালো টাকা পেশি শক্তির মাধ্যমে মানুষকে চিন্তার দাস বানায় রেখে কালোটাকার মালিকরা জনপ্রতিনিধি হয়ে ক্ষমতাকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিনত করে। যার ফলে সাধারণ জনগণ তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
সাধারণ জনগণের কীভাবে অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে, শোষিতের গণতন্ত্র কোন পথে যাবে? এমন হাজারো প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মাঝে গিজগিজ করছে। একদিকে পুঁজিবাদ আরেক দিকে যেন না খুঁজে হয় ভাত। তার জন্য রাষ্ট্র সংস্কার কাজ ভালো ভাবে করতে হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যক্তি মালিকানা শিল্পকারখানা কমিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দিতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জুলাই ‘২৪ গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় বাংলাদেশ হোক একটি কল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকবে। দেশের জনগণ মানবসম্পদে পরিনত হবে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই