Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কেউ বলছে না কৃষকের কথা

এম আর লিটন
১৪ অক্টোবর ২০২৪ ১৭:৩৯

দেশের কৃষি খাত দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলিত। প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা বারবার বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। সাম্প্রতিক বন্যা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে তছনছ করে দিয়েছে। এটি আবারও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, কৃষকরা কতটা অসহায়। তাদের দুঃখ-দুর্দশা কতটা গভীর। কিন্তু কৃষকের কথা কেউ বলছে না।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। নতুন করে দেশ পুনর্গঠনের বিভিন্ন দাবি উঠলেও, দুঃখজনকভাবে কৃষকদের অধিকারের প্রশ্ন অনেকাংশেই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বন্যায় কৃষকদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা জাতির সামনে জ্বলন্ত বাস্তবতা।

বিজ্ঞাপন

গত আগস্ট মাসে পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় দেশের ২৩টি জেলার ২ লাখ ৮ হাজার ৫৭৩ হেক্টর ফসলি জমির ক্ষতি হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৪ লাখেরও বেশি কৃষক বন্যার কারণে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতে, বন্যায় সরাসরি আক্রান্ত জমির পরিমাণ ৩৭ লাখ ২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর, যার কারণে কৃষিতে ৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এদিকে অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তরাঞ্চলের শেরপুর, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহসহ কয়েকটি জেলার কৃষিখাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই বিপুল ক্ষতি কৃষকের জীবনের ওপর যে আঘাত হেনেছে, তা পুষিয়ে নেওয়া সহজ হবে না।

কৃষকরা বরাবরই দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। তাদের শ্রম আর ঘামে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কৃষকদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয় না। সমাজে শিক্ষিত, প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন কিংবা শহুরে পেশাজীবীদের কথাই বেশি গুরুত্ব পায়। অথচ যাদের হাতে দেশের খাদ্য উৎপাদন নির্ভর করে, তারা বঞ্চিত থেকে যায় নানা ভাবে। রাষ্ট্রের উন্নয়ন নীতিমালা কৃষকদের কল্যাণের দিকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। যার প্রমাণ পাওয়া যায় কৃষি খাতে প্রয়োজনীয় সহায়তার ঘাতটি ও সঠিক পুনর্বাসন পরিকল্পনার অভাবে।

বিজ্ঞাপন

বন্যায় কৃষি খাতে যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে, তার একটি বড় অংশই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের ওপর আঘাত হেনেছে। আউশ, আমন, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এটি সরাসরি দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলবে। সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনীসহ পূর্বাঞ্চলের অনেক জায়গায় কৃষকরা ফসল হারিয়ে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কারণ ক্ষতির মাত্রা এতটাই ব্যাপক যে সাময়িক সাহায্য দিয়ে কৃষকদের পূর্ণ পুনরুজ্জীবন সহজ হবে না।

এখন প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র কি কৃষকদের এই দুর্দশা থেকে উদ্ধার করতে যথাযথ ভূমিকা পালন করছে? কৃষি মন্ত্রণালয় পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় কিছু ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যেখানে ৮০ হাজার কৃষককে বিনামূল্যে বীজ ও সার দেওয়া হবে। যদিও এটি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ, তবে দেশের মোট ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখের বেশি। এই সংখ্যা বিবেচনায় নিলে, পুনর্বাসন কর্মসূচির এই উদ্যোগ খুবই সীমিত।

দেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ হিসেবে কৃষকদের ভূমিকা অপরিসীম হলেও তাদের প্রতি রাষ্ট্রের মনোযোগ ক্রমশ কমছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, ও অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে বাজেটের বিশাল অংশ বরাদ্দ করা হলেও কৃষিখাতে বরাদ্দ তেমন বাড়েনি। আর সঠিক ক্ষতিপূরণের অভাবে কৃষকরা ধার-দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন।

অন্যদিকে উজানে পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা দেশের জন্য নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে দীর্ঘমেয়াদী কোনো নীতি ও কার্যকর পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। সময়মতো বাঁধ নির্মাণ, নদী ড্রেজিং ও বন্যা পূর্বাভাস ব্যবস্থার উন্নয়ন করা না হলে কৃষি খাত পুনঃপুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে থাকবে। রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা ও দুর্বল বন্যা ব্যবস্থাপনার কারণে কৃষকদের দুর্ভোগ আরও বাড়ছে।

কৃষকদের প্রকৃত সহায়তা, তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষকদের জন্য কৃষি ঋণ সহজলভ্য করা, বন্যা প্রতিরোধে সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গ্রহণ করা ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য পর্যাপ্ত পুনর্বাসন সহায়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শুধু অর্থনৈতিক সহায়তা নয়, কৃষি প্রযুক্তির উন্নয়ন, ফসল সংরক্ষণ পদ্ধতি ও দুর্যোগ পূর্বাভাস ব্যবস্থায় কৃষকদের সম্পৃক্ত করতে হবে, যাতে তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে সক্ষম হন।

দেশের কৃষকরা বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে তাদের স্বপ্ন, শ্রম ও সম্পদ হারাচ্ছেন। অথচ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা কৃষকদের ওপর নির্ভরশীল। তাই রাষ্ট্রের উচিত তাদের প্রতি আরও মনোযোগী হওয়া, তাদের জন্য পর্যাপ্ত ও টেকসই সহায়তা নিশ্চিত করা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসন ও তাদের জীবনের মানোন্নয়ন কেবল একটি আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি দিয়ে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

সারাবাংলা/এসবিডিই

এম আর লিটন কেউ বলছে না কৃষকের কথা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর