Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মহামানবের পথে অবিচল জীবন্ত কিংবদন্তি

বিপ্লব বড়ুয়া
১৪ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:০১
বাংলাদেশী বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয়গুরু জীবন্ত কিংবদন্তি ড. জ্ঞানশ্রী মহাথের’র জন্মশতবর্ষ মহাসাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে। ১৯২৫ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে একটি সম্ভ্রান্ত বৌদ্ধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই বর্ণাঢ্য তিনি জীবনে লাভ করেছেন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশ পদকসহ দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার স্মারক সম্মাননা ও সংবর্ধনা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যে এই শতবছরেও তিনি একেবারে খালি চোখে চশমা ছাড়াই পড়তে পারেন। তাকে দেখিনি কখনো চশমা পড়তে। আজ আমি সত্যিই অভিভূত আনন্দিত এই কারণে যে, আমার জীবনে একজন শতবর্ষী মহামনীষিকে স্বচোখে দেখার এবং তার বাণী শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি একজন অসাধারণ গুণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী জ্ঞানভানক, পণ্ডিত। তার মানবিক দর্শন বাংলাদেশকে গৌরান্বিত করেছে। তার চরণে জানাই ভক্তিপূর্ণ শ্রদ্ধা।
একবিংশ শতাব্দীর আলোকিত পূণ্যপুরুষ মহান জ্ঞানসাধক পণ্ডিতপ্রবর বাংলাদেশি বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয়গুরু, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সমাজসেবায়  একুশে পদকে ভূষিত (২০২২ খ্রি.), মহামান্য (ত্রয়োদশ) সংঘরাজ ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথের।  যার নামের আগে ইতিপুর্বে দেশি-বিদেশী অনেক সম্মানসূচক উপাধি যুক্ত হয়েছে। সবকিছু ছাপিয়ে জ্ঞানশ্রী হয়ে উঠেছেন জ্ঞানের প্রতীক, মানব হিতৈষী, দেশ ও সম্প্রদায়ের আলোকবর্তিকা  এবং বৌদ্ধ ইতিহাসের সার্থক উত্তরাধিকার। পাহাড় থেকে সমতল জনপদে ধর্ম ও শিক্ষা বিস্তারে যে, ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন তা এক বিরল দৃষ্টান্ত শুধু নয়, ইতিহাসের অংশ হয়ে তিনি যুগ যুগান্তর বৌদ্ধ শিল্প-সংস্কৃতির সম্ভারে উজ্জ্বলতর হয়ে থাকবেন। মহাথের’র জীবন গবেষনায় তা সহজে অনুমেয়। মহাথের’র কর্মকাণ্ড আজ সমগ্র দেশকে করেছে গৌরবান্বিত।
জন্ম দিয়ে কখনো বিচার হয় না তার কর্ম কি হবে। এই জন্ম আর কর্ম নিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে রয়েছে ব্যাপক বিশ্লেষণ। তবে এই বিষয় নিয়ে মনিষীরা একমত হয়েছেন যে, জন্ম যেখানে বা যেভাবেই হোক না কেন কর্মগুণে মানুষ তার জীবনকে সুপরিচালিত করে। তাই ‘জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো’ এই চরণটির যথার্থতা কমবেশি আমরা সকলে উপলদ্ধি করতে পারছি। প্রত্যেক ধর্মেই বর্ণিত আছে সৃষ্টির সেরা জীব ‘মানুষ’। মানব জীবনে মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়া হচ্ছে এক দুর্লভ ঘটনা। কিন্তু এই দুর্লভ জীবনকে আমরা কতখানি দুর্লভ করে তুলতে পারছি সে বিষয ভাবনাদিতে আমাদের মনোযোগ থাকা জরুরি। আজকে এমন এক মহান ব্যক্তিকে নিয়ে দু’চার লাইন কথা লিখতে বসেছি। যিনি এই দুর্লভ মানব জীবনকে ভেবেছেন একটি স্বপ্ন হিসেবে। আর সেই স্বপ্নকে তিনি ধরেছেন হাতের মুঠোয়। মানব জীবনে যা কিছু অর্জন করেছেন তা মানুষের সেবায় উৎসর্গ করে চলেছেন। এখানেই একজন মানুষের মহত্ত্বতা, সার্থকতা। যুগে যুগে কালে কালে মহাথের’র মতো ব্যক্তির কদাচিত দেখা মেলে। আমি এবং আমাদের অনেকের সৌভাগ্য যে, এরকম একজন পূণ্যপুরুষের নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। নামের সাথে তার কর্ম প্রতিভার যে যোগসূত্র লক্ষ করেছি তা গুটি কয়েক মানুষের জীবনে ঘটে। বিদর্শন সাধনা, স্বধর্ম প্রচার, প্রসার এবং অনাথ শিশুদের প্রতি তার যে উদার্য্য চেতনা সীমাহীনভাবে বিস্মিত করেছে। তার সংস্পর্শে যাওয়া ভক্ত অনুরাগীদের উদ্দেশ্যে তিনি প্রায়শই বুদ্ধের ভাষায় একটি কথা বলেন, ‘কর্মের অধীন কেউ নন, নিজস্ব কর্মগুণে জীবনকে পরিচালিত করতে হবে। হিংসা, বিদ্বেষ, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কখনো মানুষ সুখি হতে পারেনা।’ মহামান্য সংঘরাজ বাঙালি তথা বৌদ্ধ জাতি-সম্প্রদায়ের অহংকার। বৌদ্ধধর্ম দর্শন সম্পর্কে তার জ্ঞানের সীমা অসীম। বৌদ্ধ দর্শনের অন্যতম পণ্ডিত। ধর্মচর্চা ভাষণ, বলনে, চলনে রয়েছে আভিজাত্য। একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ ড. প্রনব কুমার বড়ুয়া তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন- ‘তিনি থাকেন শান্ত সমাহিত, ধীরে ধীরে কথা বলেন, যুক্তির মাধ্যমে জটিল বিষয়ে সমাধান দেন। তিনি জ্ঞানের খনি, আমাদের উচিত সেই খনি থেকে মণি সংগ্রহ করা। তিনি পরশ পাথর তার সংস্পর্শে এলে লোহাসদৃশ জীবন পাথরও সোনা হয়ে যায়। অর্থাৎ অজ্ঞানী জ্ঞানী হয়, বিপথগামী সত্যের পথের সন্ধান পায়, মানুষ মৈত্রী পরায়ন হয়, আয়ু-বর্ণ-সুখ-বল বৃদ্ধি পায়।’
তিনি এই দীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবনে বিভিন্ন মেয়াদে প্রায় ১৪টি বিহারে অবস্থান করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অনাথালয়সহ অসংখ্য জনহিতকর কর্মের স্বাক্ষী হয়েছেন। সর্বশেষ তিনি ২০০৩ সাল থেকে উপমহাদেশের শতাব্দীর প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান বৌদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্যের অনন্য স্মারক চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে মানব জাতির কল্যাণে সাধনে কাজ করে চলেছেন। দেশে-বিদেশে তার রয়েছে অসংখ্য ভক্ত শিষ্যমন্ডলী। গুরুর নির্দেশে তাদের অনেকে মানবতার কল্যানে কাজ করে চলেছেন।
পূজনীয় মহাথের’র এতটুকু আসা কখনো কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এ জন্য প্রচুর কাটখড় পোড়াতে হয়েছে। ত্যাগী ভিক্ষু হয়েও অপদস্ত হতে হয়েছে তথাকথিত ভিক্ষুদের হাতে। সবচাইতে দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, তিনি চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারে অধ্যক্ষ হিসেবে বরিত হওয়ার পর এমন একজন ভিক্ষু তাকে অপদস্ত ও কুৎসা রটালেন সে একজন তথাকথিত ভিক্ষু। আহা- কোথায় শিক্ষা, কোথায় গুরুপূজা- লোভ মানুষকে কি পরিমান ধ্বংস করতে পারে বিগত ক’বছরে বৌদ্ধ সমাজ দেখেছে। ঐ একজন ভিক্ষুর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, বিনয় বিরোধী কর্মকাণ্ডে সমাজ-সম্প্রদায়কে অসহনীয়, অসহিষ্ণু করে তুলেছে। সম্প্রদায়ের জন্য এই ঘটনা এখন অশনি সংকেত!  সম্প্রদায়ে যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা আগামী একশত বছরেও পূরণ হবে কিনা সমাজ বিশ্লেষকরা আশংকা প্রকাশ করেছেন। আপনারা প্রত্যেকে একটি বিষয় অনুধাবন করুন, এই বৌদ্ধ ভিক্ষু কোত্থেকে কোথায় উঠে এসেছেন। তিনিও তো এক অভাবগ্রস্থ অসচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন শিশুকালেই মা’কে হারিয়ে ঠাকুরমা’র লালিত স্নেহে বড় হওয়ার স্বপ্ন গুনেছেন শিশু লোকনাথ। মাত্র ১৯ বছর বয়সে শান্তির পথে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। ১৯৪৪ সালে প্রব্রজ্যা ও ১৯৪৯ সালে ভিক্ষুত্ব (উপসম্পদা) লাভ করেন। আজ তিনিই হয়ে উঠেছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মহামান্য সংঘরাজ সম্মানে সম্মানিত। ভাবতে গায়ে শিহরণ জাগে। বাবা পুলিশে কর্মরত থাকলেও পরিবারের সকলকে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে রাখা সম্ভব ছিলনা। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়ে কর্মকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেই বেছে নিলেন নিজের মুক্তির পথ। যে পথ তিনি আবিস্কার করেছিলেন সেই পথেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। সেটি হলো বুদ্ধের নির্দেশিত মানুষের কল্যাণের পথ, ধর্ম পথ, সংঘ পথ। তিনি প্রমাণ করলেন মানুষ-মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। যে জীবন পরের কল্যাণে নিবেদিত সেই জীবনের মূল্য অপরিসীম। তিনি এতে নিঃস্ব হননি, বরং ঋদ্ধ হয়েছেন। এই কুশল কর্ম আনন্দের এবং অনুকরণীয়। স্বার্থ ও ভোগের নিগড় থেকে যারা বেরিয়ে আসতে পারে তাদের জন্ম সার্থক, জীবন ধন্য।
যে যার অবস্থান থেকে সম্মান-শ্রদ্ধাবোধ,স্বধর্মের উন্নয়ন, কুশল কর্ম সম্পাদনে নিজেদেরকে সর্বদা ব্যস্ত রাখতে হবে। কোনো বৃক্ষ যেমন তড়িৎ গতিতে ফল দিতে পারে না, তেমনি যেকোনো ধরণের মহৎ কর্ম ও কর্ম সাধনার ফল কোনো সময় বৃথা যায় না। তাড়াতাড়ি ফলের জন্য যে বা যারা হা-পিত্যেশ করতে করতে বিচলিত হয় তারা একসময় দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে যন্ত্রণা ভোগ করে। বুদ্ধবাণীর এ কথাগুলো কখনো বিফল হয়নি, আর হবেও না। আজকে আমাদের সময় এসেছে ত্রয়োদশ সংঘরাজ ড. জ্ঞানশ্রী মহাস্থবিরের জীবনাচরণ পর্যালোচনা করার, অনুসরণ-অনুকরণ করার। এমন একজন কর্মযোগী, ধ্যানী সাধকের আবির্ভাবের কারণে শাসন-সদ্ধর্মের আজ প্রভূত উন্নত ও মঙ্গল সাধিত হয়েছে। তিনি নির্মোহ জীবন-যাপনের মধ্যে দিয়ে বুদ্ধবাণীকে বয়ে নেওয়ার কারণে সকলের কাছে স্মরণী-বরণীয় হয়েছেন। তার মূল্যায়ন করেছেন খোদ রাষ্ট্র। রাষ্ট্র থেকে স্বীকৃতি পাবেন সে চিন্তা নিয়ে তিনি মানবিক কাজগুলো কখনো করেননি। একেবারে নিজের ইচ্ছা ও মনের তাগিদে কাজগুলো করতে করতে তিনি আজ বটবৃক্ষের রূপ ধারণ করেছেন। তিনি আজ সর্বমহলে প্রশংসিত এবং নমস্য। আজ তিনি শতবছর অতিক্রম করছে এ সংবাদ শুধু বৌদ্ধ জাতীর জন্য সমগ্র দেশের জন্য এ এক বড়ো আশির্বাদ। এই বয়োঃবৃদ্ধ কালেও তার দৃষ্টি জুড়ে আছে দেশ ও মানুষের কল্যাণ। স্বল্প ভাষিতা, মিতাহারী, মানবিক ধ্যান-জ্ঞান আর প্রজ্ঞাগুণে সবকিছুকে ছাপিয়ে তিনি আজ মহামানবের পথে অবিচল, এখানেই তার জীবনের অনন্য সার্থকতা।
জ্ঞান এমন এক সম্পদ যা কোনোদিন বিনষ্ট হয় না। একজন জ্ঞানী চিরদিনের জন্য জ্ঞানী। কিন্তু একজন ধনী চিরদিন ধনী নাও থাকতে পারে। অর্জিত সম্পদ যেকোনো সময় হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। অর্জিত জ্ঞান কখনোই হারানোর ভয় থাকে না। জ্ঞান মানুষকে অমরত্ব দান করে, সম্পদ তা পারে না। মহামানব গৌতম বুদ্ধ, সক্রেটিস, আইনষ্টাইন, প্লেটো, নিউটনরা বহু শতাব্দি আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তাদের জ্ঞান সভ্যতাকে এখনো পথ দেখাচ্ছে। এটাই চিরন্তন সত্য। সবশেষে বলি আসুন, আমরা প্রকৃত মানুষ হয়ে জ্ঞানের চর্চায় নিমগ্ন হই, মানবের কল্যাণে উৎসর্গ করি নিজেকে, তবেই হবে মানব জীবনের সার্থকতা। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

বিপ্লব বড়ুয়া মহামানবের পথে অবিচল জীবন্ত কিংবদন্তি মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর