কর্মক্ষেত্রে হোক মানসিক স্বাস্থ্য সহায়ক পরিবেশ
১৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৭:৫৭
শারীরিক অসুস্থতার জন্য আমরা চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হয়ে থাকি। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে এখনও আমরা তেমন গুরুত্ব দেই না। অথচ সুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক উভয় সুস্থতাই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত সংজ্ঞানুযায়ী, ‘স্বাস্থ্য হলো এমন এক অবস্থা যা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতা- এই তিনটিকে একত্রিত করে সম্পূর্ণতা লাভ করে এবং শুধু অসুস্থতার অনুপস্থিতি নির্দেশ করে’।
আবার, ‘মানসিক স্বাস্থ্য বলতে এমন একটি অবস্থাকে বোঝায়, যেখানে ব্যক্তি তার নিজস্ব ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারে, জীবনের চাপমূলক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে, তার কার্যক্রমগুলো উৎপাদনমুখী ও কার্যকরী হয় এবং সে তার সমাজেও অবদান রাখতে সক্ষম হয়’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সম্পূর্ণ সুস্থ ব্যক্তি যেমন শারীরিক রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকবে, তেমনি মানসিকভাবেও চাঙ্গা থাকবে এবং সামাজিক মানুষ হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী ব্যক্তির মধ্যে যেমন নেতিবাচক দিকের অনুপস্থিতি থাকবে, একই সঙ্গে আবার ইতিবাচক দিকের উপস্থিতি থাকবে।তার মধ্যে প্রতিকূলতা ও বিপর্যয় মোকাবিলা করার ক্ষমতা থাকবে এবং ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এ ধরনের ব্যক্তিদের আইকিউ গড় মানের ওপরে থাকে অর্থাৎ ১০০-এর ওপরে হয়ে থাকে। মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে, আনন্দের সঙ্গে, শক্তি প্রয়োগ করে জীবন ও পৃথিবীর কাজ-কর্মে যুক্ত থাকে। প্রবহমান নদীর মতো যে সামনে এগিয়ে চলে, সমস্যা সমাধানে মনোযোগী থাকে, কাজে সম্পৃক্ত থাকে, দক্ষতাপূর্ণ আচরণ করে এবং নিজেকে রাখে প্রাণবন্ত।
কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মন ভালো না থাকলে ব্যক্তি কাজে মনোযোগী হতে পারে না। এতে প্রতিষ্ঠান তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ভ্রুম-এর মতে, ‘ব্যক্তির মানসিক ও শারীরিক প্রচেষ্টাকে উৎপাদনমুখী ও সেবামূলক উদ্দেশ্যে পরিচালিত করাকে কর্ম বলে’। কাজের ক্ষেত্রে যেমন দৈহিক শক্তি প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন মানসিক শক্তি। গবেষণার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, ব্যক্তির কর্মসম্পাদনের মাত্রা তার কর্মদক্ষতা ও প্রেষণার দ্বারা প্রভাবিত হয়। ব্যক্তির কার্যসম্পাদনের মাত্রা বাড়াতে হলে তার কর্মক্ষমতা ও প্রেষণা উভয়ের মাত্রা উঁচু হতে হবে।
কর্মপরিবেশ ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ, কারখানার বর্জ্য পদার্থ গর্ভবতী মায়ের ওপর প্রভাব ফেলে। যেমন, বস্ত্র-কারখানার কর্মীরা ধূলিকণা, রং, কীটনাশক ওষুধ, অগ্নিপ্রতিরোধ উপাদান এসবে আক্রান্ত হয়। গবেষণাগারের কর্মীরা এক্সরে, ক্যানসার উৎপাদনকারী বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের স্পর্শে আসে। কর্ম-পরিবেশ জীবাণুমুক্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কীটনাশক ওষুধ স্প্রে করার ফলে বাতাস ও পানির মাধ্যমে এসবের ক্ষতিকারক দিক মায়েদের দেহে প্রবেশ করে।
কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন-ডাই-সালফাইড, হাইড্রোকার্বন, সীসা প্রভৃতি গর্ভস্থ শিশু ও মায়ের সন্তান ধারণ অঙ্গের ক্ষতি করে। এর নেতিবাচক প্রভাব সন্তানের ওপর পরিলক্ষিত হয়। এক সময় মনে করা হতো, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন নির্ভর করে শ্রমিকদের পারিশ্রমিক ও কর্মপরিবেশের ওপর। পরবর্তীতে গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, সামাজিক ও মানসিক পরিবেশ উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন, উন্নত মানবিক সম্পর্ক, বন্ধুসুলভ সহকর্মী, সুষ্ঠু পরিদর্শন ব্যবস্থা, কাজ ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব, ইতিবাচক নেতৃত্ব এসবের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
মানসিক স্বাস্থ্য যে স্বাস্থ্যেরই একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সে বিষয়টি এখনও আমাদের কর্মক্ষেত্রে সেভাবে জোর দেওয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশে লক্ষাধিক মানুষ মানসিক ও মনো-সামাজিক সমস্যায় আক্রান্ত। তারা সঠিক স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে না। সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি ও কুসংস্কারের কারণে মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে সমাজ বা কর্মক্ষেত্রের মানুষ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে না। এতে ব্যক্তির জীবন আরও নেতিবাচক দিকে চলে যায়।
যুক্তরাজ্যে এক গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে প্রতি ৫ জনে ১ জন মানসিক চাপের দরুন ছুটি নিলেও ৯০ শতাংশ মানুষ তা লুকিয়ে রাখেন। আমাদের দেশে এ ধরনের গবেষণা না থাকলেও পত্রপত্রিকা ও প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানতে পারি, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়ই ব্যাপকভাবে মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকেন।
কেস স্টাডি একজন চিকিৎসকের নিকট মহিলা রোগী এসেছেন। তিনি গার্মেন্টসে চাকরি করেন। রোগীকে ২/৩ জন লোক কাঁধে তুলে নিয়ে এসেছেন। ভীষণ শাসকষ্ট, কথা গুছিয়ে বলতে পারছেন না। কিছু সময় পরে জানা গেল, ১১ বছর আগে কৈশোরে তার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের মাস ছয়েক পর স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেন। পরবর্তীতে তিনি চাকরি নেন। চাকরির এক পর্যায়ে গার্মেন্টসের সুপারভাইজারের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তাকে ঘিরে আবারও ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। কিছুদিন পর জানতে পারেন ঐ ব্যক্তি বিবাহিত। তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, সংসার আছে।একদিকে অন্ধ ভালোলাগা, ভালোবাসা ও আবেগ, অন্যদিকে সমাজের বাস্তবতা, নীতি-নৈতিকতা এসবই তার জীবনকে অস্থির করে তোলে। বুকে ব্যথা নিয়ে আসেন ডাক্তারের নিকট। ডাক্তার মনে করেন হার্টের সমস্যা। কিন্তু রিপোর্ট অনুযায়ী হার্টের সমস্যা নেই। সিদ্ধান্ত হলো, ক্লায়েন্টের মানসিক সমস্যা। তাকে সাইকোথেরাপি দিতে হবে। কর্মক্ষেত্রে এভাবে অনেক নারী-পুরুষ নানাবিধ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে।
মনোবিজ্ঞানী জর্জ ভ্যালিয়েন্ট গবেষণায় দেখেছেন যে, যারা দীর্ঘ দিন সুস্থ শরীর নিয়ে বাঁচেন, তাদের জীবনে মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোর পূর্ণতা ছিল। এগুলো হলো একটি সুন্দর বিবাহিত ও পারিবারিক জীবন, একা একা না থাকা অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে মিলে মিশে থাকা, পেশাগত ও কর্মজীবনে উন্নতি লাভ, মানসিক সমস্যা না থাকা, দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা না থাকা এবং নেশা না করা। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বার্নিম নিউগার্টেনের মতে, ব্যক্তি যদি তার প্রতিদিনের কাজে আনন্দ পায় এবং নিজের প্রতি ইতিবাচক ধারণা থাকে, তবে তিনি তার জীবনে সন্তুষ্ট রয়েছেন বলে ধরা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সমস্যা যত দ্রুত চিহ্নিত করা যাবে, তত দ্রুত সেবা দিয়ে সুস্থ করা যাবে। ফলে, ব্যক্তি স্বাভাবিক কর্মময় জীবন যাপন করতে পারবে। সাধারণত মানুষের শিক্ষা জীবন শেষে শুরু হয় কর্মজীবন। কর্ম পরিবেশ, সম্পর্কের অবনতি, দ্বন্দ্ব, হতাশা, অমানবিকতা এসব কারণে ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে।কর্মক্ষেত্রে হিংসাত্মক বা অবমাননাকর আচরণ দূর করতে কর্মীদের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরি। পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ় করতে দলগত কাজের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। কর্মীদের সাফল্যকে উৎসাহিত করতে তাঁদের কাজের স্বীকৃতি প্রদান করা উচিত। আয়োজন করা যেতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, যেখানে কর্মীদের অবদানকে সবার সামনে তুলে ধরা হবে।
তাই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিপর্যয়ে মানসিক সহযোগিতা ও সমর্থন জরুরি। শারীরিক অসুস্থতার ন্যায় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে পারিবারিক ও কর্মজীবনে অগ্রাধিকার দিতে পারলে কর্মক্ষেত্রে যেমন সফলতা আসবে, তেমনি এগিয়ে যাবে দেশ ও জাতি। আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে এই হোক প্রত্যাশা।
সারাবাংলা/এসবিডিই
অমিত বণিক কর্মক্ষেত্রে হোক মানসিক স্বাস্থ্য সহায়ক পরিবেশ মুক্তমত