Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিশ্ব খাদ্যদিবস ও কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তা

ড. মিহির কুমার রায়
১৬ অক্টোবর ২০২৪ ১৩:৪০

প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলাদেশের জন্য বিশ্ব খাদ্য দিবসের তাৎপর্য আরও গুরুত্বপূর্ণ। এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যে উন্নত জীবন ও উন্নত ভবিষ্যতের কথা বলা হয়েছে। যে উন্নত জীবনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সভ্যতার প্রচেষ্টা নিরন্তর, সেই উন্নত জীবনের জন্য প্রধান শর্তই হচ্ছে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও নিরাপদ খাবারের অধিকার নিশ্চিত করা। বাতাস ও পানির মতো খাদ্যও বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। ক্ষুধার্থ পেটে বিশ্বশান্তি ও সমৃদ্ধির কোনো তন্ত্রমন্ত্র আর মডেলই কাজ করে না। গত ৪০ বছর খাদ্য উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হলেও চরম জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশটির আগামীর খাদ্য নিরাপত্তা অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে। বর্তমান ফসলি জমি ৭ দশমিক ২৯ মিলিয়ন হেক্টর হলেও খাদ্য নিরাপত্তার পরিকল্পনা করতে হবে ৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি নিয়ে। আগামীর খাদ্য নিরাপত্তায় ‘রাইস সিকিউরিটি’ ইস্যুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ২০৫০ সালে বাংলাদেশে ৪৫ মিলিয়ন টন চাল উৎপাদন করতে হবে। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় সভ্যতার শুরু থেকেই। এত জমি, এত পানি, এত প্রযুক্তির পরও ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিশ্বে এখনও বড় সমস্যা। পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতি, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদের সর্বব্যাপী প্রভাব আর বৈশ্বিক বাণিজ্য নৈরাজ্য খাদ্য নিরাপত্তাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করছে। বিশ্বায়ন ও পুঁজিবাদের বর্ণিল হাতছানিতে মানুষ যখন শুধুই মুনাফা খোঁজে, তখনও লাভ-লোকসানের হিসাব না করে কৃষক উন্নয়নের মহাকাব্য রচনা করে যায় তার ঘাম-শ্রম ঢেলে দিয়ে। ছোট্ট এক টুকরো জমি থেকে অধিক ফসল ফলাতে ওরা ঢেলে দেয় জীবনের নির্যাস, শরীরের নোনাজল, ভক্তি আর ভালোবাসা।

বিজ্ঞাপন

বিভিন্ন গবেষণা পেপার, মডেল ও বিশ্লেষণ ধান চাষের আওতায় জমি ও মোট উৎপাদন কমে যাওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছে। এ ছাড়া গত দুই দশক ধান চাষির সীমাহীন বঞ্চনার কারণে তারা বেরিয়ে আসছেন ধান চাষ থেকে। শুকনো মৌসুমে নদীর পানি প্রবাহ হ্রাস, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, উপকূলে লবণাক্ততা, হাওরে আকস্মিক বন্যা ও উত্তরে খরার কারণে চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হতে পারে। ডাল, তৈলবীজ ফসল, ভুট্টা, আলু, শাকসবজি, ফল-ফুল ও মসলা জাতীয় ফসলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোও বড় চ্যালেঞ্জ। ২০৫০ সালে মাংসের চাহিদা হবে ১২ মিলিয়ন টন, যা বর্তমান চাহিদার তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি। পশুখাদ্য, হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবারও চাপ সৃষ্টি করবে ফসলি জমির ওপর।

বিজ্ঞাপন

জাতিসংঘের এসডিজি লক্ষ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী। ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক স্কোর কমেছে ৭ দশমিক ২ পয়েন্ট (২৬ দশমিক ২ থেকে ১৯)। বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫টি দেশের মধ্যে ৮১তম। বাংলাদেশ এখন মধ্যম স্কোরের দেশ। ভারত (২৮ দশমিক ৭), পাকিস্তান (২৬ দশমিক ৬) ও আফগানিস্তানের (৩০ দশমিক ৬) চেয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভালো। বাংলাদেশের নিম্ন স্কোরের (৯ দশমিক ৯) দেশ হতে হলে এখনও ১০ পয়েন্ট স্কোর কমাতে হবে। জলবায়ু ঝুঁকি ও ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমির মতো বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ২০৩০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজ নয়।

বিশ্বে প্রতি বছর অনিরাপদ ও ভেজাল খাদ্য খেয়ে ৬০ কোটি লোক অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে ৪ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) আয়োজিত গবেষণার প্রাক-অবহিতকরণ সেমিনারে এসব তথ্য উঠে আসে। খাদ্যে ভেজাল, খাদ্যে বিষক্রিয়ার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি এর ব্যাপ্তি যে হারে বাড়ছে, তাতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। দেশি-আন্তর্জাতিক সব গবেষণায় দেশে খাবারের বিষক্রিয়ার বিষয়টি বারবার উঠে আসছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত হোটেল, রেস্টুরেন্ট বা নামিদামি ব্র্যান্ডের পণ্যও এখন নিরাপদ নয় জনসচেতনতা ও প্রশাসনিকভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন ব্যতীত ভেজালের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা অসম্ভব। বিএফএসএ তথ্য বলছে, দেশে ৭০ ভাগ মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগে। তার মধ্যে ডায়রিয়ার কারণে মৃত্যু রয়েছে ৪ নম্বরে। মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিকের ব্যবহারের মাত্রা এমন পর্যায়ে গেছে, তা নদী ও সাগরে ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের সাধারণ মানুষের তথা নিম্ন আয়ের মানুষের অন্যতম পছন্দের খাবার পাঙ্গাশ ও তেলাপিয়া মাছে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মাত্রা এত বেশি যে, শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। খাদ্যে ভেজাল দেয়া কিছু মানুষের চরিত্রগত বদঅভ্যাস। এটা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি খাদ্যে ভেজালের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা দরকার।

বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় ভেজাল বা বাসি খাবার বা পচা খাবার সরবরাহের অভিযোগ অহরহ আমরা শুনে আসছি। এ ব্যাপারে নাগরিকদের সচেতন হতে হবে। ভেজালবিরোধী অভিযান আমরা প্রায় দেখি। কোনোভাবেই যেন এই চক্রকে দমন করা যাচ্ছে না। খাদ্যপণ্যে নকল ও ভেজাল আমাদের দেশের খাদ্য ব্যবসায়ীদের প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ক্ষতিকর রং এবং অস্বাস্থ্যকর উপকরণের ব্যবহার অহরহ ঘটে। এসব খাবার খেয়ে সাধারণ মানুষ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন এক গবেষণায় বলছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দেড় লাখ, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এই পরিসংখ্যানটি আমাদের ভাবিয়ে না তুলে পারে না। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক চাহিদা। এর মধ্যে খাদ্য একটি প্রধান ও অন্যতম মৌলিক চাহিদা। জীবনধারণের জন্য খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রত্যেকটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। আর এ বিশুদ্ধ খাদ্যই যদি অখাদ্যে রূপান্তরিত হয়, তা গ্রহণের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। ২০১৫ সালে গঠন করা হয়েছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। ভেজালবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি তারা কাজ করছে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা ।

কৃষকরা এত বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় কেন ভুগছেন এ প্রশ্নে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন বলেন কৃষকরা খাদ্য সরবরাহ করেন। বিশেষ করে এখন যে উচ্চ মূল্যের কৃষিপণ্য এসেছে তারা সেগুলো উৎপাদন করে বিক্রি করে ফেলে। তারা নিজের খাবারের জন্য যা রাখেন সেগুলো খুবই সামান্য, অপুষ্টিকর। কাজেই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তাদেরই বেশি হবে। যেমন তারা দুধ বিক্রি করে ফেলেন, নিজের জন্য রাখেন না। দুধ পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় খাবার হওয়া সত্ত্বেও নিজের জন্য রাখেন না। তারা দুধ বিক্রি করে খাদ্য, কাপড়সহ অন্য কিছু কেনেন। তিনি বলেন, কৃষির ওপর নির্ভরশীল মানুষের আয় কম। সে হিসেবে তারা মাছ-মাংস কিনে খেতে পারেন না। তারা যেসব শাকসবজি খায় সেগুলো একেবারেই নিম্নমানের, সব বিক্রি করার পর যা থাকে। এটি তো স্বাস্থের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তারা খাদ্য সরবরাহ করলেও পুষ্টি নিয়ে তাদের শিক্ষা কম। সেজন্য তাদের খাদ্য নিরপত্তাহীনতা বেশি। তাদের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা মোট কৃষি উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর প্রভাব কৃষকদের একটি অংশের ওপর তো পড়বেই। এজন্য তাদের খাদ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।দেশের কৃষি উৎপাদন বাড়লেও কৃষকরা খুব কমই উপকৃত হচ্ছেন। বিশেষ করে আলু উৎপাদনের মৌসুমেও প্রয়োজনীয় তদারকির অভাবে দেশে আলু আমদানি করতে হচ্ছে। ডিমের উৎপাদন যথেষ্ট থাকার পরও আমদানি করা হচ্ছে। এ ছাড়া পেঁয়াজ, চাল, মরিচসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি নির্ভরতার দিকেই ঝুঁকেছে বেশি।বাংলাদেশে ফসল সংগ্রহের পর বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ৩০ শতাংশ ফসল ও খাদ্য নষ্ট এবং অপচয় হয়। খাদ্য নষ্ট ও অপচয় কমাতে পারলে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে।রাষ্ট্রের নীতি কাঠামো ও পরিকল্পনায় কৃষক, গ্রামীণ মানুষ ও দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ কোনো কিছু চিন্তা করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আসনে আমলা, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের প্রতি মমতাবিহীন রাজনীতিকরাই মুখ্য ভূমিকায়। সে দেশে কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে আলাদা কোনো গুরুত্ব পাবে কীভাবে?

লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ

সারাবাংলা/এসবিডিই

ড. মিহির কুমার রায় বিশ্ব খাদ্যদিবস ও কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর