চাটুকারিতা একটি সামাজিক ব্যাধি
২৭ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:১৯
চাটুকারিতা একটি সূক্ষ শিল্প যা উচ্চ বুদ্ধিভিত্তিক শক্তি, কল্পনা এবং চিন্তাভাবনা ও আবেগের উপর নিয়ন্ত্রন করার মতো বিশেষ দক্ষতা। নিজের স্বার্থসিদ্বির জন্য সত্য, মিথ্যা এবং কপটতার মিশেলে অন্যকে তুষ্ট করার অনৈতিক প্রয়াসকে চাটুকারিতা বলে। চাটুকারিতা ও প্রশংসার মধ্যে পরিমাপের ন্যানো মাত্রার পার্থক্য আছে। চাটুকারিতা আসে মুখ থেকে আর প্রশংসা আসে মন থেকে; চাটুকারিতা অপবিত্র আর প্রশংসা পবিত্র। অতি প্রশসংসাও চাটুকারিতার রুপ নেয়। চাটুকারিতা চুইংগামের মত-এটাকে উপভোগ করা যায়, কিন্তু গিলতে নেই। চাটুকারিতা সুগন্ধির মতো- এটার সুঘ্রান নেয়া চলে, কিন্তু গলাধঃকরন করতে নেই। বিশুদ্ধ বাংলায় চাটুকারিতাকে বলা হয় স্তূতিবাক্য, অতিরঞ্জন ইত্যাদি যার সমার্থক শব্দ তোষামোদ, মোসাহেবি বা তৈলমর্দন, খয়ের খাঁ, পদলেহী, আজ্ঞাবহ, হীনস্থাবক, তোয়াজকারী, জোহুজুর, পরাশ্রয়ী, পরগাছা ইত্যাদি। ফার্সিতে বলা হয় খোশামোদ, তোশামোদ ইত্যাদি। চাটুকারিতার ইংরেজি হলো- Psycophant , flatterer, apple-polisher, yes-man, bootlicker, brown-noser, suck-up ইত্যাদি।
চাটুকারেরা এতটাই বর্ণচোরা ধূর্ত বুদ্ধিমান যে, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাডারের ক্ষমতা ব্যবহার করেও তাঁদের চিহ্নিত করা কঠিন। ভাইরাস/ব্যকেটেরিয়া যে জীবাণু প্রতিরোধক ছাকুনীর ভিতর দিয়ে যেতে পারে না এরা তারও ভিতর দিয়ে যেতে পারে। ইলেকট্রন অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও এদের দেখা যায় না বা বোঝা যায় না।চাটুকাররা চাটুকারিতা দিয়ে অপরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায়। কিন্তু তার পরও তাঁদের হাতে কাঁঠালের বিন্দুমাত্র কষটুকুও লাগেনা- দেখতে প্রত্যেককেই ধোয়া তুলসীপাতা মনে হয়। কথায় বলে গছি (গতা) মাছ বা বাইন মাছ কাঁদায় থাকে কিন্তু তাদের গায়ে কাঁদা লাগে না, বিজ্ঞান বলে কাঁদা ও পানি মিশ্রিত থাকলেও হাঁস সেখান থেকে শুধু পানি টুকুই পান করে, কাঁদা নয়। কচুর পাতায় সারাদিন বৃষ্টির পানি পড়লেও এক ফোটা পানি সেখানে আটকায় না। চাটুকারদের বৈশিষ্ট্য এমনিই বলে সকলের জানা।
চাটুকারিতার উদাহরণ হিসেবে কাঁক ও শিয়াল একটি গল্প তুলে ধরা যেতে পারে। এক বোকা ক্ষুধার্ত কাক অতি কষ্টে এক টুকরা পনির খুজে পায়। পনিরের টুকরা ঠোঁটে নিয়ে সে গাছের ডালে বসে খাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করে। এমন সময় এক ধূর্ত শিয়াল গাছের নিচ থেকে সেটি দেখতে পেয়ে খাবার জন্য তার প্রচন্ড লোভ জাগে। কিন্তু সে খাবে কি ভাবে? তাই নিয়ে ভাবনার মাঝে সে চাটুকারিতার আ্শ্রয় নেয় এবং কাককে সুন্দর পাখি বলে প্রশংসা করে। সে কাকের মিষ্টি কন্ঠে গান শুনতে চায় এবং কাককে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। বোকা কাক শিয়ালের প্রশংসায় মুগ্ধ হয়ে গান গাইতে শুরু কারা মাত্র তার মুখ থেকে ফসকে পনির মাটিতে পড়ে যায় আর শিয়াল সেটি খেয়ে চম্পট দেয়। বোকা কাক ক্ষুধার্ত অবস্থায় মরনাপন্ন অবস্থায় উপনীত হয়। এ রকম চ্টাুকাররা সমাজে তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য নানা রকম ফন্দি আঁটতে অনেক অভিজ্ঞ ও পারদর্শী।
মহাকবি শেখ সাদী (রহ.) তার যুগের রাজদরবার সম্পর্কে একটি সত্যভাষণ রেখে গেছেন। তিনি বলেছেন: ‘আগার শাহ রোজরা গুয়াদ শবাস্তইঁ,/বে বায়াদ গুফত ইঁনক মাহও পারভিঁ।’ অর্থাৎ বাদশাহ যদি দিবসকে রজনী বলেন, তখন দরবারের সবাই বলে উঠে, ‘এই তো, আকাশে তারকারাজি ঝক ঝক করছে। ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন একবার তার এক সহযোগীকে বলেছিলেন, ‘আমাকে কেউ চাটুকারিতা দিয়ে পরাস্ত করতে পারবে না। তদুত্তরে সহযোগী বললেন, ‘আমি আগামীকাল সকালে এসে এর জবাব দেব’। পরদিন সকালে এসেই তিনি বললেন, ‘স্যার, আমি কাল সারা রাত বসে বসে চিন্তা করেছি- সত্যিই আপনার মতো ব্যক্তির সামনে কেউ চাটুকারিতা করতে পারবেনা’। নেপোলিয়ন তখন হেসে ফেলে বললেন, ‘নাউ আই অ্যাম ফ্লায়াটারড। প্রশংসনীয় সব কিছুই সব মানুষের মধ্যেই আছে, সেটি খুঁজে বের করতে হবে আগে। তবেই প্রশংসাটা কাজে লাগবে। যে জিনিসের অস্তিত্ব নেই সে জিনিসের প্রশংসা হাস্যকর, সেটাই চাটুকারিতা।
খনা বচন দিয়ে গেছেন, ‘তেলা মাথায় ঢালো তেল, শুকনো মাথায় ভাঙ্গো বেল। খনার বচনকে অব্যর্থ করতে আমরা তেলা মাথায় তেল দিয়েই যাচ্ছি। আর যে অসহায়, তার মাথায় বেল ভাঙার চেষ্টা করছি। কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর সাহেব ও মোসাহেব কবিতায় বলেছেন-সাহেব কহেন, ‘চমৎকার! সে চমৎকার!’/মোসাহেব বলে ‘চমৎকার সে হতেই হবে যে! হুজুরের মতে অমত কার?’ ইংরেজ কবি স্পেনসার তার ‘দ্য ফেয়ারি কুইন’ কাব্য রচনা করেছিলেন রানী প্রথম এলিজাবেথকে তোষামুদি করে। তেমনি আবার ইংরেজ নাট্যকার শেক্সপীয়ার জুলিয়াস সীজার নাটক রচনা করেছিলেন রাজা প্রথম জেমসকে উদ্দেশ্য করে।
তেল বা তৈল মর্দনের কোন আলোচনা করতে গেলে সবার আগে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের কথা বলতেই হয়। কারন তিনি অনেক আগেই তৈল মর্দনের অভাবনীয় সাফল্যের বর্ণনা অত্যন্ত সুন্দরভাবে দিয়ে গেছেন। তাঁর বর্ণনায় তৈল মর্দনের স্তুতিগাথা কেমন ছিল? ঊদ্ধৃতি দিচ্ছি, ‘বাস্তবিক তৈল সর্বশক্তিমান, যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যায় অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য- তাহা কেবল তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে।’ পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সেই কবেই বলে গেছেন, মানুষকে তৈলের ন্যায় ঠান্ডা করিতে আর কিসে পারে? হর প্রসাদ শাস্ত্রী তার তৈল প্রবন্ধে সর্বশেষ বাক্যে লিখেছেন এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মনও ফেরে। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে কথা শতভাগ সত্য। তেল মানুষের মাথা যেমন ঠান্ডা করে, এর চাইতে বেশি ঠান্ডা করে মন।
তেল ছাড়া মোঘলাই থেকে ভর্তা, ভাজি, মুড়ি মাখা কোনো খাবারই সুস্বাদু হয় না। তবে সব রান্নাতেই মাত্রাতিরিক্ত তেল ব্যবহার করলে, সেগুলোতে আর সুখাদ্য ও স্বাস্থ্যকর খাবারের মান বজায় থাকেনা। আবার একই তেল দিয়ে বার বার রান্না করলে সেটি ট্রান্সফ্যাটে পরিণত হয় এবং তা শরীরে হৃদরোগ ডেকে আনে এবং কার্সিওজেনিক উপাদান সৃষ্টি করে যা ক্যান্সারের জন্য অন্যতম দায়ী উপাদান। তেমনি চাটুকারিতার তেলে মানুষ বার বার সিক্ত হতে থাকলে ব্যক্তি তথা সমাজ ক্যান্সার আক্রান্ত হয়। একইভাবে শিক্ষা,অর্থ,ক্ষমতার কেন্দ্রের মানুষগুলোও সুবিধাবাদী চাটুকারিতার খপ্পরে পড়ে সঠিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা প্রাপ্ত হন যা ব্যক্তি বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর।অন্যদিকে তেল ছাড়া কলকব্জা চলে না, গাড়ির চাকা ঘোরে না, চুল চকচকে হয় না। কিন্তু সবখানেই তেল ব্যবহারের পরিমিাপ আছে। স্বাস্থ্য, কর্মক্ষেত্র কিংবা কোথাও বাড়তি তেল মোটেই ভালো না। তোষামোদি মিথ্যা স্তুতিগাথা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য মোটেও কল্যাণকর নয় বরং খুবই ক্ষতিকর। সমাজের, রাষ্ট্রের সকল স্তরে কর্মকর্তা কর্মচারী এমনকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিগণ শেষ পরিনতিতে অনেক সময় মর্মান্তিক বিপদের সম্মুখীন হন এবং তাদের এ সর্বনাশের জন্য তোষামোদকারী বা চাটুকাররাই দায়ী।
যশোরের ক্ষিতীশ বাবু জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে বেড়াতে এসেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পায়ে তেল মালিশ করার কাজ পেয়ে গেলেন। সে সাথে ‘তেলেই লক্ষ্মী’ এটা বুঝতে পেরে তিনি দেশীয় ভেষজ দিয়ে সুগন্ধি চুলের তেল বানাতে শুরু করলেন। বোতলে ভরে তাতে চুল খোলা নারীর লেবেল এঁটে ঝাকাভর্তি করে মাথায় নিয়ে ফেরি করতে বের হতেন। ক্রমেই তিনি বুঝতে পারলেন তেলের বাজারে প্রচারেই প্রসার। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে হাজির হলেন এবং তার তেলের নামধাম ও গুণাগুণ তাকে শুনিয়ে বাণিজ্যিক কারণে সার্টিফিকেট চাইলেন। ব্যবসায়িক পণ্যের জন্য রবীন্দ্রনাথ আগেও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েছেন। তিনি অমনি লিখে দিলেন ‘অলকানন্দা তৈল সামান্য মাখিলেই চুল ওঠে, শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ খুশিতে আটখানা হয়ে ক্ষিতীশ ছুটলেন। বাজারে তেল বিক্রয় করতে। আর এই বিজ্ঞাপনেই তার বিক্রি অনেকগুণে বেড়ে গেল।
চাটুকারিতার বৃত্ত থেকে বের হতে হলে সবার আগে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি। পরিশুদ্ধ কোনো ব্যক্তি অযাচিত চাটুকারকে কোনোভাবে প্রশ্রয় দেন না। উপরস্থ কর্মকর্তার কাছে তার অধীনস্থের মূল্যায়ন হতে হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, তেল মারার ওপর নয়। এক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিত্ববোধকে জাগ্রত করতে হবে। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়াতে হবে। মনে জাগ্রত করতে হবে দেশপ্রেম। তবেই সর্বস্তরে চাটুকারিতার বিস্তার রোধ সম্ভব। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ‘‘আপন ভালো তো জগৎ ভালো’’। অতএব সবার আগে নিজের চরিত্র বদলাতে হবে। কারণ মানুষ হিসেবে আমরা কেউ দোষ-ত্রুটির উর্ধ্বে নই।
ছোট এক টুকরো স্বচ্ছ কাঁচের আয়না আমাদের পরম বন্ধু। আয়না কারো মনগড়া কিছু করতে অক্ষম। আমরা নিজেকে যতই হ্যান্ডসাম ভাবি না কেন, আয়নার সামনে গেলে আমরা দেখতে যে রকম ঠিক সেরকমই ছবি আমরা দেখতে পাই। সে কেবল সত্য জানান দেয়। আয়না ছাড়া জীবন প্রায় অসম্ভব। সব সময় আমাদের নিরাপদ রাখতে সহায়তা করছে আয়না। এমনকি নিজের চেহারা পছন্দ না হলেও আয়নার প্রতি কোন রাগ নেই আমাদের। অসুন্দর মানুষটিও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে না যে, ‘না, এটা কোনোভাবেই আমি নই। আমরা যত সুন্দর পোশাকই পরিধান করি না কেন আয়নার সামনে দাড়িয়ে তার অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত বাইরে যাই না। আর রঙ্গিন আয়নায় আমরা নিজে যা তা কখনও দেখতে পাই না। তেমনি চাটুকারিতার রঙ্গিন আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে কখনও নিজের আসল চেহারা নিরুপণ করা সঠিক নয়। কোন ভুল শোধরাতে, কোনো ত্রুটি দুর করতে আমাদের স্বচ্ছ আয়না লাগবে। সে আমাদের বলবে, ‘এগিয়ে যাও, ভালো থাকো।’ একটি বীজ থেকে যখন চারা গাজায় তখন সেটি নি:শব্দে অংকুরিত হয় আর একটি গাছ যখন ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে তখন প্রচন্ড শব্দ হয়। তেমনি চাটুকারিতা নয়, প্রশংসা বা আত্মপলব্ধির নীরব ভাবনাই বিশ্বের সকল সৃষ্টিকে এগিয়ে যাবার প্রেরণা যোগায়।
লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ
সারাবাংলা/এসবিডিই
চাটুকারিতা একটি সামাজিক ব্যাধি প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মুক্তমত