Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: নাম নিয়ে অপরাজনীতি বন্ধ হোক

মাহবুব নাহিদ
১ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৬

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নিয়ে নতুন করে আলোচনা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি, ছাত্রশিবিরের ৩৫ বছর পর প্রকাশিত কমিটি, বাম সংগঠনের প্রতিবাদ মিছিল করা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, যা আরো ঘনীভূত হয়েছে বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় জেনারেল সেক্রেটারি জাহিদুল ইসলামের ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, “এই ভূখণ্ডে বিভিন্ন নাম থেকে ‘ইসলাম’ ও ‘মুসলিম’ শব্দ মুছে দেওয়ার অন্যতম ভিকটিম ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’“—এই বক্তব্যটি দ্রুত সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় এবং মানুষকে চিন্তা করতে বাধ্য করে। এই আলোচনার আগুনে তুষ ঢেলেছে বিখ্যাত ইসলামী স্কলার মিজানুর রহমান আজহারীর ফেসবুক পোস্টে। তিনি লিখেছেন “জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়” আমাদের অনেক কিছুতে কোনো কিছুই হয় না, আবার কোনো কিছুতে অনেক কিছু হয়ে যায়, বড্ড আজব দেশ আমাদের! নাম তার বাংলাদেশ কিন্তু এখানকার অনেক মানুষই নিজেদের বাংলাদেশী না বলে বাঙালি বলতে ভালোবাসে, চেতনায়! আবেগে!

বিজ্ঞাপন

দেখে নেয়া যাক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নিয়ে কোনো ইতিহাস কী বলছে। ঐতিহাসিক সূত্রে যানা যায়, ১৯৭০ সালের ২০ আগস্ট তৎকালীন সরকার এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার পূর্বনাম জাহাঙ্গীরনগরের সঙ্গে মিলিয়ে জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়নামকরণ করেন। মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নামে এটি ছিল দেশের প্রথম ও একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। ১৯৭৩ সালে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির নামকরণ হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা শহরের মুঘল আমলের নাম ‘জাহাঙ্গীরনগর’ থেকে এই নামকরণ হয়।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে, ধর্মীয় নামের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় যুক্ত করা একটি জটিল বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। ইসলামী আলোচক মিজানুর রহমান আজহারীর বক্তব্য সেকুলার চিন্তাধারার মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করেছে এবং ধর্মীয় পরিচয়ের গুরুত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সেকুলার চিন্তাধারার সমর্থকরা ধর্মীয় নাম ব্যবহারকে বিভাজনকারী হিসেবে বিবেচনা করেন, যা সমাজে একীকরণে বাধা দেয়।

মুক্তিযুদ্ধের পর মুসলিমশব্দটি বাদ দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছিল, কিন্তু মুসলিম নামকে মুছে ফেলা মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার আদর্শের প্রতিফলন নয়। কথিত সেক্যুলাররা মুক্তিযুদ্ধকে ইসলাম ও মুসলিম আদর্শের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। অনেকে বলছেন যে দেশটি রিপাবলিক অব বাংলাদেশনামে গঠিত, এবং ইসলামিক নামের ব্যবহারকে তারা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কিন্তু বাস্তবে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীরা পড়ছে, এবং নাম নিয়ে রাজনীতি করা কোনো সমাধান নয়। আবার মিশিগানে ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভার্সিটিতে ধর্মতত্ত্ব, স্পোর্টস, লিবারেল আর্টস পড়ানো হয়।

নাম নিয়ে রাজনীতি এদেশ বহু দেখে ফেলেছে। এই ক্লিশে একগুঁয়ে গল্প দেশের মানুষ আর দেখতে চায় না। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়, শেখ হাসিনা তাঁর বাবার নামের জোরে মুজিববাদের প্রচার করতে চেয়েছিলেন, যা মানুষের কাছে তেতো হয়ে গেছে। ইসলামী ভাবধারাকে পাকিস্তানি ভাবধারার সাথে একত্রিত করা ভুল; ইসলামের সাথে পাকিস্তানের কোনো সম্পর্ক নেই। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সকলের ভালোবাসার জায়গা, এবং এতে বিভেদ তৈরি করা সঠিক নয়।

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ মানে ইসলামকে দূরে সরিয়ে রাখা নয়; বরং এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বী মানুষের আবেগকে সম্মান করা। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নামক আওয়ামী ব্যবসা নয়। স্বাধীনতা বৈষম্যের বিরুদ্ধে এসেছে, এবং আমরা যে নতুন স্বাধীনতা পেয়েছি, তা আবারও অন্য একটি বৈষম্যের বিরুদ্ধে। জনগণের কণ্ঠরোধ করা হলে তারা প্রতিবাদ জানাবে, এবং সেটাই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। তাই আমাদের উচিত আবেগের সাথে যুক্ত হয়ে আলোচনা করা, যাতে আমরা একটি সমন্বিত সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে সকল পরিচয়ের মূল্যায়ন হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, ধর্মীয় নামের ব্যবহার সেকুলার আন্দোলনের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। যেখানে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সামাজিক চিহ্ন হয়ে ওঠে, সেখানে বাংলাদেশে এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসলামবিদ্বেষী মনোভাবের বিরুদ্ধে বিরোধিতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ধর্মের নামে বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেমন ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভার্সিটি, মিশিগান, আমেরিকা; ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভার্সিটি, উগান্ডা; ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ, ভেলোর, ভারত; এবং দিল্লির হিন্দু কলেজ। ভারতের কলকাতা ও অন্যান্য স্থানে হিন্দু স্কুল ও কলেজের সংখ্যা অনেক, আর পশ্চিমা সেকুলার দেশে ক্রিশ্চিয়ান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও প্রচুর। বাংলাদেশেও মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ রয়েছে, যেমন চট্টগ্রামের মুসলিম হাইস্কুল ও ফজলুল হক মুসলিম হল।

তবে বঙ্গদেশের সেকুলারিজম বিশেষভাবে ইসলামের নাম থাকলেই বিরোধিতা করে, যা বিশ্বব্যাপী সেকুলারিজমের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এই প্রবণতা আসলে এন্টিইসলামিক সেকুলারিজম হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, যা বাংলাদেশের সেকুলার চিন্তাধারায় ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়কে এক ধরনের হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি একটি বিশেষ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রতিফলন, যা দেশের সামগ্রিক সেকুলারিজমের নতুন রূপকে তুলে ধরছে।

অনেকেই নিজেদের মুক্তমনা বলে দাবি করে, এবং এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা তখন শুরু হয় যখন মুক্তমনা হওয়ার নামে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মকে আক্রমণ করা হয়। এটা বোধগম্য নয় কেন তাদের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু শুধুমাত্র ইসলাম? তাদের কাজ, ধ্যান, এবং চিন্তা সবকিছুর মধ্যে কেন ইসলামকে অপমান করা অন্তর্ভুক্ত হতে হবে? এর পিছনে ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে, যা মার্কেটিংয়ের মতো।

মার্কেটিং মূলত দুইভাবে করা যায়: পজিটিভ এবং নেগেটিভ। পজিটিভ মার্কেটিংয়ে ভালো কাজ করে, পণ্যের মান বজায় রেখে এবং কাস্টমারের প্রয়োজন মেটাতে হয়—যা সহজ নয়। অন্যদিকে, নেগেটিভ মার্কেটিং সহজে অর্জন করা যায়। কোনো ভালো কাজ, গোষ্ঠী, বা ব্যক্তিকে নিয়ে বাজে কথা বললেই সেটা হয়ে যায়। ফুটবলারদের মধ্যে যেমন কেউ মেসি বা রোনালদোকে খারাপ বললে সে সহজেই আলোচনায় আসতে পারে। এই পরিস্থিতি আমাদের দেশে খুবই প্রচলিত—একটা বাজে গানও বাজে মন্তব্যের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।

মুক্তমনারা এইভাবে কাজ করে। অনেকে নিজেদের দর্শন সম্পর্কে সচেতন নয়; এটি তাদের জন্য যেন একটি ফ্যাশন। ইসলাম নিয়ে মন্তব্য করলেই তারা সহজে আলোচনায় আসতে পারে, এবং তাদের মার্কিং বেড়ে যায়। তাদের সবচেয়ে বড় দর্শন হচ্ছে মানবতা। কিন্তু, কি সত্যিই মানবতা মানুষের ধর্ম হতে পারে? মানুষের জীবন পরিচালনায় মানবতা যথেষ্ট নয়; আরো গুণ ও যোগ্যতা প্রয়োজন। মানবতা জীবনের একটি অংশ হলেও ইসলাম একটি পূর্ণ জীবনব্যবস্থা।

উদাহরণ হিসেবে, যদি কেউ অভাবে পড়ে আপনার বাড়ি থেকে কিছু চুরি করে, আপনি মানবতা দেখিয়ে তাকে ছেড়ে দিলেন। কিন্তু এতে তো তার জন্য ক্ষতি হচ্ছে—কারণ অপরাধ হয়েছে, এবং যথাযথ শাস্তি প্রয়োজন। ইসলাম কর্মক্ষমতা শেখায়, কাজ করে খাওয়ার গুরুত্ব দেয়। তাই শুধু মানবতা দিয়ে জীবন চলতে পারে না; আরো অনেক কিছু প্রয়োজন।

আচমকা নাম পরিবর্তনের প্রশ্ন কেন আসবে, তা নিয়ে ভাবলে একাধিক দিক দেখতে হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যদি জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়রাখা হয়, তাহলে আমরা কী লাভ করব এবং কী হারাব? দীর্ঘদিন ধরে এই নাম রয়েছে; হঠাৎ করে পরিবর্তন করলে বিভ্রান্তি এবং ফ্যাসাদের সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়।

আমরা যে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের কঠিন সময় পার করেছি, তা আমাদের স্মৃতিতে এখনও তাজা। ইতিহাসের সেই অধ্যায় থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের উচিত সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি না করা। মুসলিম নামটি আগে থেকেই ছিল, তাই এ বিষয়টি অনেকের কাছে আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ধর্মীয় মূল্যবোধ বাংলাদেশে অত্যন্ত স্পর্শকাতর—অনেকেই নামাজকালাম না পড়লেও, ধর্ম নিয়ে আলোচনা হলে আবেগে ভেসে যান। এই আবেগকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই; এটি দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আবেগের গুরুত্ব বুঝতে না পারলে আমাদের সমাজে নতুন কোনো ফ্যাসিবাদের জন্ম নিতে পারে। তাই আলোচনা ও বিতর্কে সতর্কতা অপরিহার্য। আমাদের উচিত এই আবেগকে সম্মান করে একটি সমন্বিত সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে সকল পরিচয় ও মূল্যবোধকে যথাযোগ্য গুরুত্ব দেওয়া হয়। সামাজিক ঐক্যের লক্ষ্যে, আমাদের আবেগের ওপর ভিত্তি করে আলোচনার ক্ষেত্রে সংবেদনশীলতা বজায় রাখতে হবে।
এছাড়া, নাম হঠাৎ পাল্টানোর মধ্যে কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমরা এখন বাকস্বাধীনতার এক নতুন পরিবেশে আছি; সবাই মন খুলে কথা বলতে পারছে এবং এই পরিবেশ আমাদের গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তাই সবাইকে এই চমৎকার পরিবেশ উপভোগ করতে দেওয়ার সময় এসেছে। প্রত্যেকে নিজেদের বক্তব্য প্রকাশ করুক—এটাই তো গণতন্ত্রের প্রকৃত সার্থকতা!

সুতরাং, আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এবং সমঝোতা তৈরি করে আলোচনার পথই হতে পারে সঠিক পদক্ষেপ। নাম পরিবর্তনের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে সচেতনতা ও সংবেদনশীলতার প্রয়োজন রয়েছে, যেন সমাজের সকল স্তরের মানুষের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা যায়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এজেডএস

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মাহবুব নাহিদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর