পরিকল্পনার লাগামছাড়া কল্পনা করে কারা, কেন
৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:৫৭
এক বা একাধিক অভীষ্ট অর্জনের লক্ষ্যে সঠিক সময়ে সাশ্রয়ী ব্যয়ে সুষ্ঠুভাবে কোন কার্য সম্পাদন করতে পরিকল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। একথা ব্যাক্তিগত, পারিবারিক, সংগঠনের, দলের, গোষ্ঠীর, রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যার পরিকল্পনা যত তথ্যভিত্তিক, স্পষ্ট ও রেশনাল হবে তার পরিকল্পনা প্রনণয়, বাস্তবায়ন ও অভীষ্ট অর্জন ততবেশি সঠিক ও স্বতঃস্ফূর্ত হবে। পরিকল্পনা যৌক্তিক হলে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার সুযোগ থাকে না। আমাদের দেশে প্রচুর প্রকল্প পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। ভারি ভারি মাথা এর সাথে সংযুক্ত থাকে। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিভিন্ন কমিটি বসে সেগুলো পর্যালোচনা করে, শলাপরামর্শ করে। বাদানুবাদ করেন কিনা জানিনা। এরপর প্রকল্পসমূহ পাস হয়। কিছু তার খবরের কাগজে আছে, কিছু সরকারি মন্ত্রণালয়ের প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে পাবলিকের নজরে আসে। বেশিরভাগ প্রকল্পে পাবলিকের আগ্রহ থাকে না। তারা আগে থেকেই এগুলোকে বড়দের খাদ্য হিসেবে সিলেবাস বহির্ভূত করে রেখেছে। প্রকৃত অবস্থা হলো, এগুলো নিয়ে সচেতন পাবলিকের ধারণা নেগেটিভ। এ ব্যাপারে তাদের ধারণা খুব স্পষ্ট। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের সম্মতিতে, নির্ধারিত সি-িকেটের কথামত, আমলা ও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক কর্তাব্যাক্তিদের পূর্বনির্ধারিত স্বার্থ বহাল রেখে এসব প্রকল্পের আঁক কষা হয়। সব পক্ষের তৃপ্তির ঢেকুর একরূপ হলে তা আলোর মুখ দেখে। মেগা প্রকল্পের অভিজ্ঞতা আরো তিক্ত।
পাবলিক পারসেপশন বলে একটা কথা আছে। এটি হুট করে গুজব ইত্যাদি প্রসূত পাঁচ কান হয় না। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে জাত হয়। পাবলিক জানে প্রকল্প নেওয়া হয় প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে। প্রকল্পের খরচ হিসেবে প্রাথমিক ভাবে যা ধরা হয় প্রকৃত ব্যয় তার চেয়ে অনেক বেশি। পাবলিক এটাও জানে যে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প শেষ হবে না। রিভাইজড হবে। প্রাইস হাইক দেখিয়ে, বিভিন্ন অজুহাত তুলে প্রকল্প ব্যয় কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা হবে। সেই সাথে মেয়াদও। আরো তেলেসমাতি আছে। সেখানেও ঘুটু আছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জনবল দরকার। প্রকল্প শেষে এই সব জনবলের কর্মাবসান হবে এমনটাই লেখা থাকে প্রজেক্ট প্রপোজালে। পাঁচ-দশ বছর পর যখন প্রকল্প শেষ হয় তখন শুরু হয় রাজনৈতিক দরোজায় আনাগোনা। রাজস্ব বাজেটে আত্মীকরণের ফাঁকফোকর খোঁজা। বিলম্ব হলে প্রকল্পের সেই সব জনবল মানব বন্ধন করে, আলটিমেটাম দেয়, কঠোর কর্মসূচি প্রদানের হুমকি দেয়, প্রেস ক্লাবে গিয়ে বা প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করে তাদের দাবী-দাওয়া পেশ করে। তাতেও কাজ না হলে অনশনে বসে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রথমে কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করে। পরে অনশন ভাঙ্গাতেও যায়। আশ্বাস দেয়। দাবীকারীরা তাদের অনশন ভঙ্গ করে। এরপর সাংবাদিকদের সামনে এসে তাদের বিবৃতি প্রচার করে। এরপর কি হয় জানা যায় না। কেউ তার খবরও রাখে না।
গেলো কয়েক বছরের প্রকল্প সমূহের যৌক্তিকতা স্পষ্ট নয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে আর্থিক ব্যায়ের পরিমাণে কোন মাত্রা নেই। দফায় দফায় প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন সময়কাল বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রকল্প শেষ করার পূর্বেই রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য খণ্ডাংশ উদ্বোধন করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। পাবলিকের অভিজ্ঞতা হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের বালিশ কাণ্ডে। কিভাবে একটা বালিশ নিচতলা থেকে উপর তলায় উঠাতে হাজার হাজার টাকা লাগে? কিভাবে এক কেজি নাট-বল্টু কিনতে লক্ষাধিক টাকা লাগে। কিভাবে অধিগ্রহণের নামে একটা গাছের ক্ষতিপূরণ লক্ষাধিক টাকা নির্ধারণ করা হয়? এসব নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। দুদক সেই প্রকল্প পরিচালককে তলব করেছিলো। কাজ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের নজর এড়াতে তাকে ভোঁ দৌড় দিতেও চ্যানেল গুলোতে দেখা গেছে। এরপর কি হয়েছে? কেউ জানে না। সাংবাদিকরাও খবর করেনা।
সাম্প্রতিক জুলাই বিপ্লবকালীন মেট্রোরেলের কাজী পাড়া ও মিরপুর স্টেশনের ক্ষতি সাধিত হয়েছিলো। তখনকার কর্তাব্যক্তিরা তাতে এমন একটা ভাব করলেন যেন এ ক্ষতি অপূরণীয় ও দীর্ঘসময় সাপেক্ষ ব্যাপার। যে পরিমাণ কুম্ভাশ্রুপাত করা হয়েছিলো তাতে পাবলিক রীতিমত ঘাবড়ে গিয়েছিলো। তাদের শংকা ছিলো স্বপ্নের মেট্রোরেল বুঝি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়লো। কর্তাব্যক্তিরা জিগির তুললেন এই ক্ষতি পূরণ করতে লাগবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। আর সময় লাগবে এক বছরের মত। অথচ এর কয়েক দিন পরেই বিপ্লবোত্তর সরকারের লোকজন বললেন সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকা লাগবে। আর সময় লাগবে কয়েক মাস। পাবলিক দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলো। পরে দেখা গেলো মেরামতে লেগেছে ১৯ কোটি টাকা আর সময় নিয়েছে মাত্র দেড় মাস। এ থেকে পরিকল্পনার অভিসন্ধি অনুমান করা সহজ হয়। এটা কি পরিকল্পনা, নাকি নিছক অনুমান, নাকি ক্লেপ্টোক্রেসির ভাগবাটোয়ারার ফন্দি? তেমনি চিটাগাংয়ের কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প। এ প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে তখন কথা বলার সাহস তেমন কারো ছিলো না। কিন্তু এর উপযোগিতা যে ইকনোমিক ও ফিন্যান্সিয়াল এনালাইসিসে মোটেই সময়ানুগ ছিলো না তা প্রমানিত হতে বেশি সময় নেয় নি। শুধু জেঁকে বসা রেজিমের পতন হতে হয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে যে, এই টানেলের দৈনন্দিন আয় যা হচ্ছে তার কয়েক গুণ বেশি লোকসান হচ্ছে প্রতিদিন। এটাকে কি পরকল্পনা বলা যাবে, নাকি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বলতে হবে? নাকি গোষ্ঠী স্বার্থে রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাটের একটা শ্বেতহস্তী বলা যাবে? এরকম ভুড়ি ভুড়ি উদাহারন দেওয়া যাবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, ঋণ করে ঘি খাওয়ার প্রবণতা, সর্বোপরি পাবলিকের ঘাড়ে জনপ্রতি ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে দেশটার সর্বনাশ করা হয়েছে। এর দায় এখন পাবলিককেই দিতে হবে অনাগত কাল। কিন্তু কেন?
বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকার বিভিন্ন মেগা প্রকল্পগুলো আবার রিভিউ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে আমাদের দেশে সব সরকারই বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কিন্তু কমিটি গঠন পর্যন্তই সার। কোন কিছু বের হয় না। তাই, নতুন নতুন লুণ্ঠন প্রকল্পের জন্ম হয়, বিকাশ হয়। এভাবেই প্রজনন প্রক্রিয়া চালু থাকে। আশাকরি বর্তমান সরকারের কর্তাব্যাক্তিরা এরূপ কাজে সহযোগী হবেন না, পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করবেন না। উপরন্তু প্রকৃত তথ্য যাতে উদঘাটিত হয় সেরূপ ব্যবস্থা নেবেন। এগুলোকে ফলো আপে রাখবেন। লুটপাট আর অনিয়মে ঠাসা এরূপ প্রকল্প বাছাই করে এর সাথে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প প্রণয়ন, স্তরভিত্তিক অনুমোদন ও সুপারিশকারী এবং সর্বোপরি উপরস্ত সুপিয়র রেসপন্সিবিলিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনৈতিক ও আমলা গোষ্ঠীর লোকদেরকে চিহ্নিত করতে হবে। এদেরকে প্রয়োজনে আলাদা আলাদা করে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। একাজটি এককভাবে কাউকে দিয়ে করলে উদ্দেশ্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে বাধ্য। একটা যৌথ অনুসন্ধানী কমিটি এই দায়িত্ব পালন করবে। কমিটি এদের জবানবন্দি রেকর্ড করণ, সংশ্লিষ্ট তথ্যপ্রমাণ যাচাই বাছাইয়ান্তে উপস্থাপন, এদের ব্যক্তিগত সম্পদের অনুসন্ধান, ব্যাংক হিসাব একটা নির্দিষ্ট সীমার উর্ধে যাতে উত্তোলন যোগ্য না হয় সেরূপ নিষেধাজ্ঞা আরোপ ইত্যাদি কাজ করবে। মোটকথা এরূপ উদ্যোগের মাধ্যমে অনুরূপ কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক প্রভুদের কাছে যাতে কঠিন ম্যাসেজ পৌছায়। সঠিক প্রকল্প নির্বাচন, অনুমোদন, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যেন জবাবদিহিতার মধ্যে আসে।
সর্বোপরি কিচ্ছু হবে না সংস্কৃতি থেকে আমাদেরকে অতি আবশ্যিক ভাবে বের হয়ে আসতে হবে। সরকারের টাকা, তা দেশি হোক, বিদেশি হোক, ঋণের হোক, অনুদানের হোক, সফট হোক আর হার্ড হোক সবকিছুতেই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আসতে বাধ্য। শুধু প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ। বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবে কে- এই জুজু দেখিয়ে ৫৩ বছর পার হয়ে গেলো। এবার সাহস করে ঘন্টা বাধুন। নইলে বর্তমান সরকারের অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। অতএব সাধু সাবধান।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
আনোয়ার হাকিম পরিকল্পনার লাগামছাড়া কল্পনা করে কারা- কেন মুক্তমত