হেলাল হাফিজ: দুঃখ ও নিঃসঙ্গতার যাত্রী
১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৩২ | আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ২১:০৪
হেলাল হাফিজ বাংলা সাহিত্যের অনন্য একজন কবি। তিনি কবির পাশাপাশি মানুষ হিসেবেও অসাধারণ চমৎকার। একদম নিজের মতো করে তিনি একটা জীবন খরচ করে গেছেন। সেখানেই হেলাল হাফিজের সাথে পার্থক্য অন্য আট-দশজন কবির। তিনি একদম নিজের উপর নির্ভরশীল একজন মানুষ ছিলেন। যা ভেবেছেন, তাই করেছেন। জীবন-যাপনও করেছেন নিজের মতো করে।
মানুষ হিসেবে কবি হেলাল হাফিজ খুব স্বল্পভাষী ও মিষ্টভাষী। আস্তে আস্তে কথা বলতেন হেলাল হাফিজ। তিনি আন্তরিকতায় অনন্য একজন মানুষ। ব্যাক্তিগতভাবে হেলাল হাফিজের চাহিদাও ছিলো না। না থাকার মাঝে সবচেয়ে বেশি যেটা ছিলো না- সেটা হচ্ছে অহংকার। হেলাল হাফিজ একজন নিরহংকার এবং শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন। একাকিত্বকে ভালোবেসে জীবন-যাপন করার এমন উদাহরণ খুবই কম। সেখানে কবি হেলাল হাফিজ জীবনের শেষ সময়টাতেও ছিলেন একা।
হেলাল হাফিজের বিখ্যাত দুইটি কবিতার লাইন- এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়; এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়- এখনও তুমুল জনপ্রিয়। এই দেশ, সমাজ, পৃথিবীতে যতদিন অন্যায়, অনাচার, শোষন, স্বৈরাচার থাকবে ততদিন হেলাল হাফিজের এই দুটি লাইন প্রাসঙ্গিক থাকবে। লড়াইয়ে, সংগ্রামে, প্রেমে-বিরহে, দ্রোহে যাপিত জীবনের পরতে পরতে হেলাল হাফিজ স্পর্শ দিয়ে যান। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র মতো ‘অগ্ন্যুৎসব’ কবিতাও শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আগুন জ্বেলে দেয়। কেবল মুক্তিযুদ্ধ কিংবা গণ-অভ্যুত্থানের মতো প্রেক্ষাপটে নয়, যেকোনো অন্যায়ে-অবিচারে হেলাল হাফিজের কবিতা আমাদের সবার স্লোগান হয়ে উঠবে।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ দিয়েই মানুষের হৃদয়ে আসন করে নেন হেলাল হাফিজ। আড়াই দশক পর ২০১২ সালে তিনি পাঠকদের জন্য আনেন দ্বিতীয় বই ‘কবিতা ৭১’। তার তৃতীয় এবং সর্বশেষ বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।
হেলাল হাফিজ, এক স্বল্পভাষী কবি, যার শব্দে ঝরে পড়ে এক নিঃসঙ্গ কবির কষ্টের আর্তি। তার কবিতায় প্রেম আছে, কিন্তু তা সুখের নয়; তা বরং অভিমানের, ব্যথার আর অপূর্ণতার। এই দুঃখ শুধু ব্যক্তিগত নয়, এই দুঃখের বিস্তার রয়েছে সমাজের প্রতি, ইতিহাসের প্রতি, সময়ের প্রতি।
কবি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের বড় অংশটাই গেছে একাকিত্ব আর সংগ্রামে। আমি দুঃখে ভেঙে পড়িনি; বরং সেই দুঃখকে বুকে ধারণ করেছি।’
হেলাল হাফিজের কবিতা প্রেমের কথাও বলে, কিন্তু সেই প্রেম কখনোই পূর্ণতার দিকে যায়নি। তার বহু কবিতায় ভালোবাসার গভীর আকাক্সক্ষা থাকলেও তা যেন কোনো এক ব্যর্থতার অতলে তলিয়ে গেছে। ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কবিতায় তিনি প্রেমিকাকে বলেছেন:
‘প্রতিটি ভোরে প্রেমিকারা রক্তাক্ত সকাল নিয়ে আসে/প্রতিটি সন্ধ্যায় ফিরে যায় রক্তাক্ত পায়ে’ -এই লাইনগুলো তার প্রেমের ব্যর্থতা আর ব্যথারই প্রকাশ।
হেলাল হাফিজের দুঃখের আরেকটি দিক হলো তার সময়ের স্বপ্নভঙ্গ। তিনি ছিলেন সেই প্রজন্মের একজন, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর তিনি দেখলেন, সমাজে সেই আশার প্রতিফলন ঘটেনি। তার কবিতায় সেই হতাশার সুর পাওয়া যায়:
‘যে জলে আগুন জ্বলে, সে জলে আর ফিরে যাব না/মৃতস্বপ্নের কাছে আমি নত হতে পারি না।’
কবির জীবনের একটি দীর্ঘ সময় কেটেছে নিঃসঙ্গতায়। তার পরিবার ছিল না, ভালোবাসার মানুষ ছিল না, বন্ধু ছিল না। কবি একাকী একটি ভাড়াবাড়িতে থেকেছেন বছরের পর বছর। মানসিক ও শারীরিক নানা সমস্যার সঙ্গে লড়াই করেছেন। হেলাল হাফিজ নিজেই বলেছিলেন, ‘জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মনে হয়, দুঃখই আমার সবচেয়ে বড় সঙ্গী।’
তার দুঃখ গভীর, কিন্তু সেই দুঃখে থমকে যাননি তিনি। দুঃখকে শক্তিতে পরিণত করেছেন। কবিতায় তিনি কখনো হেরে যাওয়ার কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, ‘দুঃখকে ভালোবেসে ফেললে, তা তোমার শক্তি হয়ে যাবে’।
হেলাল হাফিজের দুঃখ যেন বাংলা কবিতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা পাঠককে বারবার আবেগমথিত করে তোলে। তার জীবনের এই দুঃখগুলো শুধু ব্যক্তিগত নয়; এগুলো আমাদের প্রজন্মের, আমাদের সময়ের প্রতিচ্ছবি।
কেবল কবিতার পাঠকের নিরিখে নয়, যে ব্যক্তি অতটাও সাহিত্যের খোঁজখবর করেন না, এমন অনেকের হৃদয়েও দোলা দিয়েছে হেলাল হাফিজের । তার কবিতায় প্রেম, দ্রোহ এবং স্বাধীনতার এক অনন্য মিশ্রণ দেখা যায়। তিনি ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন।
কবি হেলাল হাফিজের ব্যক্তিগত জীবন বেশ সংগ্রামী। দীর্ঘদিন তিনি নানা ধরনের আর্থিক, শারিরীক ও মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছেন। তা সত্ত্বেও কবিতা থেকে দূরে যাননি। তিনি চেষ্টা করেছেন তার কবিতা দিয়ে মানুষকে সাহস যোগাতেন। চেষ্টা করেছেন তার কবিতা দিয়ে এই সমাজ, এই দেশকে পরিবর্তন করতে। এভাবেই তিনি গত ১৩ ডিসেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
বাংলা সাহিত্যে হেলাল হাফিজ এমন একজন কবি, যিনি খুব কম লেখার মধ্য দিয়েই চিরস্থায়ী স্থান অর্জন করেছেন। তার কবিতা স্বল্পসংখ্যক হলেও, তা যুগে যুগে পাঠকদের মনে দাগ কাটবে। কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এএসজি