Saturday 04 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫: প্রত্যাশা পূরণে চাই আন্তরিকতা

মো. শাহিন রেজা
১ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:২৮

এই বছরের ৫ আগষ্টের পটপরিবর্তনের পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকার গঠনের পরপরই তিনি ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা তাদের নিয়োগকর্তা এবং প্রতিটি সেক্টরে সংস্কার করে একটি সুখী সমৃদ্ধ দেশ গঠনে কাজ করবে তার সরকার। বিগত সরকারের আমলে মানুষকে নানা ভাবে অবহেলিত, হয়রানি ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ রয়েছে। ফলে দাবি আদায়ে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন চলছে। এর মধ্যে একটি চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা ৩৫ বছর করার পক্ষে চলমান আন্দোলনটি দীর্ঘ কয়েক বছরের এবং আন্দোলনকারীরা সবসময় বলে আসছেন তাদের ন্যায্য দাবিটি বিগত সরকারের আমলে মানা হয়নি। নতুন সরকার গঠনের পর ১২ বছর ধরে চলা আন্দোলনটি আশার আলো দেখবে এমনটা প্রত্যাশা করেছিলেন ৩৫ বছর প্রত্যাশিরা। কারণ সরকার প্রধান, উপদেষ্টামণ্ডলী সহ সবাই বারবার বলেছে মানুষের প্রত্যাশা পূরণের মাধ্যমে একটি ন্যায় ভিত্তি সমাজ গঠন করা হবে। কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ করে প্রজ্ঞাপন জারি করার মাধ্যমে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গভীর খাদে ফেলা হলো। প্রশ্ন উঠেছে দীর্ঘ দিন যারা আন্দোলন করলো তারা কি পেলো? কারণ আন্দোলনকারিদের অনেকের বয়স ইতোমধ্যে ৩২ পার হয়ে গেছে। ফলে বয়স বৃদ্ধির সুবিধা তারা পাচ্ছেন না।

বিজ্ঞাপন

প্রধান উপদেষ্টা একটি ইংরেজি দৈনিকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার লক্ষ্য একেবারেই সৎ, উদ্দেশ্য দারিদ্র্য দূরীকরণ। দারিদ্র্যের দুর্দশা থেকে বের হয়ে আসতে হলে কর্মের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা হতে পারে সরকারি বেসরকারি চাকরি, ব্যবসা বা উদ্যোক্তা তৈরি করা। চাকরির বাজার ছোট কিন্তু প্রতি বছর কয়েক লক্ষ তরুণ তরুণী চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন। ফলে সব মহল থেকে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু উদ্যোক্তা হওয়ার মতো পরিবেশ তো এদেশে নেয়-ই বরং প্রতি পদে পদে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে চাকরির নিরাপত্তা, নিশ্চিত ভবিষ্যত ও সুযোগ সুবিধা বেশি থাকায় সবার আগ্রহ থাকে এদিকেই। তবে এটাও ঠিক সবাইকে যে সরকারি চাকরি করতে হবে এমন না। যে যে সেক্টরে পারদর্শী সে সেখানে কর্মের ব্যবস্থা করবে। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা ও চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। একই সাথে ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার ও উদ্যোক্তা তৈরি এবং বেসরকারি সেক্টরকে ঢেলে সাজাতে হবে।

বিজ্ঞাপন

ড. ইউনূস দীর্ঘদিন ধরে আর্থসামাজিক উন্নয়নে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সামাজের পরিবর্তন আনতে কাজ করছেন। তার ‘থ্রি-জিরো তত্ত্ব’ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। থ্রি জিরোর মধ্যে (জিরো দারিদ্র্য-Zero Poverty, জিরো বেকারত্ব-Zero Unemployment ও জিরো নেট কার্বন নিঃসরণ- Zero Net Carbon Emission) দুইটি পয়েন্টকে সরাসরি চাকরিতে বয়স বৃদ্ধির আন্দোলনের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করা যায়। কারণ জিরো দারিদ্র্য ও বেকারত্ব চাকরি বা যে কোনো যায়গায় কর্মের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। ফলে আন্দোলনকারীরা ভেবে নিয়েছিলেন এবার তারা যৌক্তিক সমাধান পাবেন। কিন্তু তা আর হলো না।

দেশে দীর্ঘদিন চলা আন্দোলন গুলোর মধ্যে চাকরিতে বয়স বৃদ্ধির আন্দোলন একটি। ফলে এটির ইতি টানা জরুরি। কারণ সময় ও অর্থ ব্যয়, পুলিশের হামলা, মামলা ও জেলখাটা লোকজন বলতে পারবে কতটা কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে এতোদিন আন্দোলন চালিয়ে আসতে হচ্ছে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বর্তমান সরকার কমিটি করে দেন যৌক্তিক সমাধানের। তারা ছেলেদের ৩৫ ও মেয়েদের ৩৭ বছরের সুপারিশ করলেও ৩২ বছর করে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করার পর থেকে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এখন কমিটির সুপারিশ না মানলে কেনো কমিটি গঠন করা হলো এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এভাবে চলতে থাকলে অন্যান্য সংস্কার কমিটির মতামত নিয়ে সমাজে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। মনে রাখতে হবে সরকারের কাজ নাগরিকদের সেবা দেওয়া, তাদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা। প্রতিটি নাগরিকের ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ করা হলো কিন্তু যারা দীর্ঘসময় ধরে আন্দোলন করলো তারা তো বঞ্চিত হচ্ছেন কারণ তারা অনেকে ৩২ বছর বয়স অতিক্রম করেছেন। এই শিক্ষার্থীদের কথা সরকারকে ভাবতেই হবে। করোনা, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, সেশন জট, সারা পৃথিবীতে চাকরির প্রবেশের বয়স সীমা, রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিত হওয়া সহ নানা কারণে বয়স বৃদ্ধির যৌক্তিকতা রয়েছে। কিন্তু ৩২ বছর কে দাবি করেছিলেন? না এটা নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, না গঠিত কমিটি ৩২ সুপারিশ করেছেন। তবে কেনো করা হলো এর ব্যাখ্যা সহ আন্দোলনকারীরা এখন যে অসুবিধায় পড়লো তার যৌক্তিক সমাধানের দায়িত্ব সরকারের নয় কি?

স্বাধীনতার পর থেকেই এদেশের মেহনতি, খেটে খাওয়া ও দূর্বল শ্রেণীর মানুষ শোষিত হচ্ছেন। পদে পদে হচ্ছেন বঞ্চনার স্বীকার। ২৪ এর পটপরিবর্তনের পর মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখেছিল। তবে কি আগের মতো হতাশা ছাড়া কিছুই জুটবে না তাদের কপালে? নিজের বা একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে আগের সরকারগুলো সবসময় সুবিধা দিয়ে এসেছেন। কিন্তু এদেশের অর্থনীতি টিকে আছে কৃষক, দিনমজুর, গার্মেন্টস কর্মী ও প্রবাসিদের কষ্টে উপার্জিত অর্থের উপর। তবে, সবসময়ই তারা ও তাদের পরিবার সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয়। রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে তাদের মতামতের গুরুত্ব থাকে না কিন্তু তাদের উপার্জিত অর্থ খরচ করে ভোগ বিলাশে লিপ্ত হতে দেখা গেছে নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সুবিধাভোগী শ্রেণীদের। বিছিয়ে পড়া বা সমাজের তুলনায়মূলক আর্থিক ভাবে খুব স্বচ্ছল না বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তানেরা সরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং তারা একটি চাকরি চাই মেধা ও যোগ্যতার বিচারে। কিন্তু বয়সের সীমারেখা দিয়ে থামিয়ে দেওয়ার কি নিদারুণ চেষ্টা রাষ্ট্রের। অন্যদিকে রাজনীতিবিদ, অফিসার, শিল্পপতি ও সমাজের উচ্চ শ্রেণীর ক্ষমতাবান মানুষ রাষ্ট্র থেকে ইচ্ছে মতো সুবিধা গ্রহণ করে দেশ বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছেন। দেশের সম্পদ লুট করে সন্তানদের বিদেশি পড়াশোনা ও স্বপরিবারের স্থায়ী বসবাসের বন্দোবস্ত করেন। এদের না আছে দেশ প্রেম না আছে জনগণের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা। কিন্তু এরাই সবধরনের সুবিধা ভোগ করেন। তাদের ইচ্ছে অনিচ্ছায় দেশের আইন তৈরি বা পরিবর্তন হয়। আর যাদের পরিবারের মানুষ হাড়ভাংগা খাটুনি খেটে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করছেন তাদের নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো চিন্তা নেই। বরং তাদের বেলায় নানা আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি দেখানো হয়। এসব দেখে মনে হয় সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ বা তাদের সন্তানদের জন্য রাষ্ট্রের মানবিকতার বড়ই অভাব!

এদিকে, দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য ৩৫ আন্দোলনকারীরা দুটি গুরুতর অভিযোগ এনেছেন। সমন্বয়কারী ও একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাদের অভিযোগের তীর। বিষয়গুলো সত্যি হলে মনে রাখতে হবে সবাইকে নিয়েই দেশ। সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। ফলে বিশেষ কোনো শ্রেণীকে গুরুত্বপূর্ণ না ভেবে সমষ্টিগতভাবে মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করতে হবে। একজন মানুষ যদি ৩৫ বছর বয়সে চাকরি করতে শারীরিক ভাবে সক্ষম হয় তবে বয়সের বেড়াজালে আটকিয়ে দেওয়া বৈষম্য নয় কি?

চাকরি হবে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। চাকরির বিজ্ঞাপনে কাজের ধরণ, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও বিশেষ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার বিষয় উল্লেখ থাকবে। এখন এইসব শর্ত পূরণ করতে পারলে একজন মানুষ কেনো ৩২ বছর পার হলে সরকারি চাকরি করতে পারবে না? আমার এক বন্ধু আছে সে জিওগ্রাফি ও জিআইএস বিষয়ে দক্ষ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে বাইরের দেশ থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি করেছেন। এখন তার বয়স ৩২ পার হয়ে গেলে সে তো কোনো সরকারি চাকরি পাবেন না। কিন্তু তার কি যোগ্যতা কম? তাহলে কেনো এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হবে?

তবে, এখন চাকরিতে বয়স উন্মুক্ত বা ৩৫ করা যদি সম্ভব না হয় তাহলে আন্দোলনকারীদের সাথে সরকারকে বসতে হবে এবং কেনো ৩৫ বছর করা সম্ভব হচ্ছে না তার বিস্তারিত জানাতে হবে। একই সাথে অন্তত অস্থায়ী ভাবে আগামী ৩ বছরের ব্যাকডেট দিলে আন্দোলনরতদের সাথে কিছুটা হলেও ন্যায্য আচরণ করা হবে। পরবর্তীতে সম্ভব হলে স্থায়ী ভাবে ৩৫ বছর করে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। এতে অনতত তারা শূন্য হাতে ফিরবে না। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কষ্ট করলেন আন্দোলনকারিরা, আর ফল ভোগ করবেন অন্যরা।

সরকার একটি যৌক্তিক সমাধানের পথে না হেটে যদি এটা নিয়ে রূঢ় আচরণ করেন তবে পূর্বের সরকারের সাথে এই সরকারের আচরণগত পার্থক্য থাকবে না। মনে রাখতে হবে তারা পরীক্ষা বিহীন চাকরি চাইনি চেয়েছে বয়স বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসার সুযোগ। এতোটুকু সুযোগ কি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের দিতে পারে না? এদিকে নিত্য পণ্যের বাজারে আগুন, আইন শৃঙ্খলার সন্তোষজনক উন্নয়ন না হওয়ার সাথে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা নানা মহল থেকে উচ্চারণ হচ্ছে। ফলে সবার মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতে হবে। মানুষের প্রত্যাশাগুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে যাতে অসন্তোষ সৃষ্টি না হয়। তবে এটাও সত্য সবার ইচ্ছে পুঙ্খানুপুঙ্খ পূরণ করা সম্ভব না কিন্তু আন্তরিকতার ঘাটতি রাখা যাবে না। বয়স বৃদ্ধি বা ব্যাক ডেটের বিষয়টি আবারো বিবেচনায় নিয়ে এমন কিছু উদাহরণ তৈরি করুন যা পূর্বের সরকারের থেকে এই সরকারের জনগণের প্রত্যাশা পূরণের আন্তরিকতার পার্থক্য বোঝাতে সক্ষম হবে।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

সারাবাংলা/এএসজি

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ মুক্তমত মো. শাহিন রেজা