রেলক্রসিংয়ে মৃত্যুফাঁদ: দুর্ঘটনার লাগাম টানবে কে?
১২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:১৭
দেশের রেলপথকে উন্নয়নের অন্যতম শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হলেও ক্রসিংগুলোর নিরাপত্তাহীনতা আমাদের উন্নয়নের এই অঙ্গটিকে একধরনের মৃত্যুফাঁদে পরিণত করেছে। ফরিদপুর জেলার মুন্সিবাজার রেলক্রসিংয়ে ৮ জানুয়ারি ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এ সমস্যার ভয়াবহতাকে আরও সামনে নিয়ে এসেছে। মধুমতী এক্সপ্রেস ট্রেন ও মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে নিহত হন নারায়ণগঞ্জের একই পরিবারের পাঁচজন। এমন করুণ মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো জাতির জন্যই দুঃখজনক। এই দুর্ঘটনা নতুন নয়; এর আগে এবং পরে প্রতিনিয়তই দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
রেলক্রসিংয়ের বর্তমান চিত্র
বাংলাদেশে রেলক্রসিং সংখ্যা প্রায় ২,৯৪১টি, যার মধ্যে অনুমোদিত ১,৪১১টি এবং বাকি প্রায় ১,৫৩০টি অবৈধ। অনুমোদিত ক্রসিংগুলোর একাংশেও সঠিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। বেশির ভাগ রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান নেই, নেই আধুনিক সিগন্যালিং সিস্টেম। যেসব স্থানে গেটম্যান রয়েছেন, তাদেরও অনেকেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ বা সরঞ্জাম ছাড়া কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েই চলছে।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর রেলক্রসিং দুর্ঘটনায় বহু মানুষের মৃত্যু ঘটছে। কিন্তু এর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, কারণ অনেক দুর্ঘটনার খবর স্থানীয় পর্যায়েই থেকে যায়।
মূল কারণসমূহ
১. অবৈধ রেলক্রসিং
অবৈধভাবে রেলপথের ওপর রাস্তা নির্মাণ ও পারাপারের প্রবণতা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এসব রেলক্রসিংয়ে কোনো সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেই। স্থানীয় মানুষের অনিয়ন্ত্রিত পারাপার এবং ট্রেন চলাচলের সময় অজ্ঞতা মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
২. আধুনিক প্রযুক্তির অভাব
আধুনিক দেশগুলোতে রেলক্রসিং ব্যবস্থাপনায় স্বয়ংক্রিয় গেট এবং উন্নত সিগন্যালিং সিস্টেম ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও এই খাতে পিছিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে ম্যানুয়াল পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে, যা পুরনো এবং ত্রুটিপূর্ণ।
৩. গেটম্যানের অভাব ও অবহেলা
অনুমোদিত রেলক্রসিংয়ের এক বড় অংশেই গেটম্যান নেই। যেখানে আছেন, তাদেরও কাজের প্রতি সঠিক নজরদারি নেই। অনেক সময় গেটম্যান উপস্থিত থাকলেও দায়িত্বে অবহেলা এবং সঠিক সরঞ্জামের অভাবে কাজ করতে পারেন না।
৪. জনগণের সচেতনতার অভাব
রেলক্রসিং পারাপারের সময় সঠিক নিয়ম না মেনে পথচারী ও চালকদের অনিয়ন্ত্রিত আচরণও বড় কারণ। গেট বন্ধ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই দ্রুত পার হওয়ার চেষ্টা করেন।
৫. বাজেটের অভাব ও প্রশাসনিক উদাসীনতা
রেলপথ নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। এছাড়া যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়, সেগুলোর বাস্তবায়নে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং দীর্ঘসূত্রিতা কাজকে বাধাগ্রস্ত করে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয়
১. আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
প্রতিটি অনুমোদিত রেলক্রসিংয়ে স্বয়ংক্রিয় গেট এবং উন্নত সিগন্যালিং সিস্টেম স্থাপন করতে হবে। এসব ব্যবস্থা চালু করা গেলে দুর্ঘটনার হার অনেকাংশে কমবে।
২. প্রশিক্ষিত গেটম্যান নিয়োগ
যেসব রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান নেই, সেখানে দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে। পাশাপাশি গেটম্যানদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সজ্জিত করতে হবে। তাদের কাজ পর্যবেক্ষণের জন্য একটি নির্দিষ্ট তদারকি দলও গঠন করা উচিত।
৩. অবৈধ রেলক্রসিং বন্ধ করা
অবৈধ রেলক্রসিংগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দ্রুত বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি, যেখানে মানুষের যাতায়াত বেশি, সেখানে আন্ডারপাস বা ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা যেতে পারে।
৪. সচেতনতা বৃদ্ধি
রেলক্রসিং ব্যবহার সম্পর্কিত সচেতনতা বাড়াতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো দরকার। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় এই প্রচারণা কার্যকর করা সম্ভব। স্কুল-কলেজে এ বিষয়ে নিয়মিত কর্মশালার আয়োজনও হতে পারে।
৫. আইনের কঠোর প্রয়োগ
রেলক্রসিং সংক্রান্ত সড়ক ও রেলপথ আইন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। গেট ভেঙে পার হওয়ার প্রবণতা রোধে জরিমানা এবং শাস্তির ব্যবস্থা কার্যকর করা উচিত।
৬. নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণ
রেলক্রসিং ব্যবস্থাপনা নিয়মিত তদারকি করা দরকার। এজন্য একটি স্বতন্ত্র এবং দক্ষ তদারকি সংস্থা গঠন করা যেতে পারে।
সরকারি উদ্যোগ: কতটুকু সফল?
বিগত বছরগুলোতে সরকার রেলপথ উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে রেলক্রসিং নিরাপত্তার বিষয়টি এখনও যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। বাজেট বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও অনেক প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন হয়নি।
বিশেষ করে দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সেই প্রতিবেদনের সুপারিশ কার্যকর করার প্রবণতা কম। বরং এসব সুপারিশ প্রায়ই ফাইলবন্দি থেকে যায়।
রেলক্রসিংয়ে মৃত্যুর মিছিল আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে। প্রতিটি দুর্ঘটনা শুধু একটি পরিবারের শোক নয়, বরং জাতির জন্যও বেদনার। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে উন্নত প্রযুক্তি, দক্ষ ব্যবস্থাপনা, এবং জনসচেতনতার সমন্বয় ঘটাতে হবে।
দেশের উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হবে, যখন প্রতিটি মানুষের জীবন সুরক্ষিত থাকবে। রেলপথ নিরাপদ হলে কেবল যাত্রীদের আস্থা বাড়বে না, বরং সামগ্রিক পরিবহন ব্যবস্থায় নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।
শেষ কথা
আমরা আর কোনো প্রাণহানি দেখতে চাই না। এই সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। একসঙ্গে কাজ করলেই রেলক্রসিংকে মৃত্যুফাঁদ থেকে মুক্ত করা সম্ভব।
লেখক: মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এএসজি