Wednesday 22 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নির্যাতন ও নারীর লড়াই

শিতাংশু ভৌমিক অংকুর
২২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:০১

নির্যাতন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ক্ষমতা, আইন বা সামাজিক কাঠামোর মাধ্যমে অন্যকে দমন, শোষণ বা নিরস্ত করার চেষ্টা করা হয়। এটি শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক—বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। নির্যাতন ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক হতে পারে এবং এটি বৈষম্য, অবিচার এবং দমনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।

নির্যাতনের ধরন নির্ভর করে সামাজিক কাঠামো, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর। এটি একদিকে যেমন সরাসরি শারীরিক নির্যাতন হতে পারে, তেমনি পরোক্ষভাবে সাংস্কৃতিক, মানসিক এবং সামাজিক নিপীড়ন হিসেবেও কাজ করতে পারে।

বিজ্ঞাপন

নারীরা মানব ইতিহাসের একটি বড় অংশ জুড়ে বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পারিবারিক কাঠামো, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক ধ্যানধারণা নারীদের জন্য একটি দমনমূলক পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে তারা প্রায়ই পুরুষতান্ত্রিক প্রভাবের অধীনে ছিল।

শারীরিক নির্যাতন নারীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের একটি প্রধান রূপ। এটি ধর্ষণ, গৃহনির্যাতন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে শারীরিক শাস্তি এবং অন্যায় কাজের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। নারী নির্যাতনের শারীরিক দিকটি শুধুমাত্র ব্যক্তির জন্য নয়, বরং সমগ্র সমাজের মানসিকতাকেও প্রতিফলিত করে।

অনেক সংস্কৃতিতে নারীদের নির্যাতনকে সামাজিকভাবে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের মাধ্যমে নারীদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। নারীকে প্রজননের মাধ্যমে কেবল একটি “উৎপাদনশীল যন্ত্র” হিসেবে দেখা হয়েছে। বিশেষত প্রাচীন সমাজে, নারীদের ভূমিকা শুধু পরিবারের কাজ ও সন্তান পালনেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের শিক্ষার সুযোগ সীমিত ছিল এবং তাদের কাজকে “অদৃশ্য শ্রম” হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

বিজ্ঞাপন

নারীদের উপর অর্থনৈতিক নির্যাতন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তারা পুরুষদের তুলনায় কম বেতন পায়, এমনকি একই ধরনের কাজের জন্য। তাদের আর্থিক স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করা হয় এবং তাদের সম্পত্তির অধিকারও প্রায়শই খর্ব করা হয়।

যৌন সহিংসতা নারীদের প্রতি নির্যাতনের সবচেয়ে নিষ্ঠুর এবং ধ্বংসাত্মক একটি রূপ। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি এবং শোষণের মাধ্যমে নারীদের মানসিক এবং শারীরিক ক্ষতি করা হয়। এটি কেবল একজন নারীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং তার পরিবার ও সামাজিক পরিবেশেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ধর্ষণ বা অবাঞ্ছিত যৌন সম্পর্ক নারীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে ফেলে। এটি কেবলমাত্র একটি অপরাধ নয়; এটি ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি পদ্ধতি। যুদ্ধকালীন সময়ে ধর্ষণ একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের অনেক সময় তাদের পরিবার ও সমাজের কাছেও বিচারহীনভাবে দোষারোপ করা হয়। এ ধরনের প্রতিক্রিয়া নারীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস হ্রাস করে এবং তাদের মানসিক যন্ত্রণাকে বাড়িয়ে তোলে।

ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রায়ই নারীদের নির্যাতনের একটি পটভূমি হিসেবে কাজ করে। কিছু ধর্ম ও সংস্কৃতিতে নারীদেরকে পুরুষের অধীনস্থ রাখা হয়েছে।

বিভিন্ন সংস্কৃতি নারীদের যৌনতা এবং প্রজনন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে নারীদের পোশাক এবং আচরণের উপর কড়া নিয়ম আরোপ করে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে নারীদের পর্দা ব্যবস্থায় রাখা হয়, যা তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সীমিত করে।

নারীদের প্রতি অনেক ধরনের প্রথাগত অত্যাচার বিদ্যমান, যেমন নারী যৌনাঙ্গ বিকৃতি (FGM), বাল্যবিবাহ এবং বিধবা পোড়ানোর মতো বর্বর প্রথা। এসব প্রথা নারীদের মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করে।

নারীবাদীরা দীর্ঘদিন ধরে নারীদের অধিকার এবং সমতার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তারা বিশ্বাস করেন যে সমাজে নারীদের নির্যাতনের মূল কারণ হলো পিতৃতন্ত্র।

১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকের নারীবাদীরা নারী নির্যাতনের বিষয়টি বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক পটভূমি থেকে বিশ্লেষণ করেন। সিমোন দে বোভোয়ার-এর “দ্য সেকেন্ড সেক্স” এবং মেরি উলস্টোনক্রাফট-এর “এ ভিন্ডিকেশন অফ দ্য রাইটস অফ ওম্যান” নারীবাদী আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে।

নারীবাদীরা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নারীদের নির্যাতন বিশ্লেষণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, উদারপন্থী নারীবাদীরা আইনি ও রাজনৈতিক সমতা অর্জনের দিকে মনোযোগ দেন, যখন র‌্যাডিক্যাল নারীবাদীরা পিতৃতন্ত্রের শিকড় উপড়ে ফেলার আহ্বান জানায়।

মার্কসবাদী তত্ত্বে নারীদের নির্যাতনকে অর্থনৈতিক কাঠামোর সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস তার বই “দ্য অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি, অ্যান্ড দ্য স্টেট” এ বলেছেন যে, শ্রেণি বিভাজন এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি নারীদের অধিকারহীনতার মূল কারণ।

এঙ্গেলস বলেছেন, নারীরা প্রথমে পরিবারের ভেতরে দাসত্বের শিকার হয়েছিল। পুরুষরা সম্পত্তির মালিকানা অর্জন করার পর নারীদের তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ব্যবস্থাগুলি জোরদার হয়।

মার্কসবাদীরা মনে করেন, কাজের লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন নারীদের উপর নির্যাতনকে আরও জটিল করে তুলেছে। এটি নারীদের শ্রমকে মূল্যহীন করে তোলে।

আধুনিক নারীবাদী তত্ত্বে আন্তঃসংযোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এটি দেখায় যে, নির্যাতন কেবল লিঙ্গের ভিত্তিতে হয় না; বরং বর্ণ, শ্রেণি, ধর্ম, যৌনতা, এবং শারীরিক সক্ষমতার মতো বিষয়গুলিও নির্যাতনকে প্রভাবিত করে।

একজন কালো নারী একজন শ্বেতাঙ্গ নারীর চেয়ে ভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, কারণ তিনি একই সময়ে বর্ণবাদ এবং লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হন।আন্তঃসংযোগ আমাদের দেখায় যে নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য একক সমাধান যথেষ্ট নয়। বরং, বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। নারীদের নির্যাতন একটি বৈশ্বিক সমস্যা যা অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন রূপে বিদ্যমান। এটি কেবল নারীদের ক্ষতি করে না, বরং সমাজের সার্বিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা, শিক্ষা এবং নীতি-নির্ধারণী পরিবর্তনের মাধ্যমে এই নির্যাতনের শেকল ভাঙা সম্ভব।

লেখক: সংবাদকর্মী

সারাবাংলা/এএসজি

নারী নির্যাতন মুক্তমত শিতাংশু ভৌমিক অংকুর

বিজ্ঞাপন

১২ ডেপুটি জেলারের বদলি
২২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৯:২৪

আরো

সম্পর্কিত খবর