Sunday 23 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রতিদিন একই পোশাক পরিধানে সফলতার রহস্য

প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন
২২ মার্চ ২০২৫ ১৮:৫৬

মানব মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (PFC) এবং হিপ্পোক্যাম্পাস সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট। মানব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া চারটি ধাপে সম্পন্ন হয়। গড়ে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মস্তিষ্ক প্রতিদিন প্রায় ৩৫,০০০টি সিদ্ধান্ত নেয়, যার মধ্যে সচেতন এবং অবচেতন উভয় ধরণের সিদ্ধান্তই অন্তর্ভুক্ত। একজন মানুষকে তার দৈনন্দিন জীবনে সকালের নাস্তায় কী খাবেন? কখন বের হবেন? কী শার্ট পরবেন? কী রঙের পরলে ভালো হয়? কোন প্যান্ট পরবেন? কোন জুতা পরবেন? কোন রাস্তা দিয়ে যাবেন? কোথায় খাবার খাবেন? এরকম অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ছোট-খাট বিষয়ে যদি মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে এত দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয় তাহলে একজন মানুষের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ফলপ্রসু সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় খুঁজে বের করা দু:সাধ্য হয়ে পড়ে।

বিজ্ঞাপন

এমন ছোট ছোট সিদ্ধান্তের বিষয়ে উদ্বিগ্নতা বাড়তে থাকলে দিন যত এগিয়ে যাবে ততই তিনি মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। দিনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও মানসিক শক্তি দিনব্যাপী বজায় রাখার জন্য এ সকল কাজের সিদ্ধান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। সিদ্ধান্তগুলোকে স্বয়ংক্রিয় করতে হবে যাতে সেগুলো নিয়ে ক্রমাগত চিন্তা করতে না হয় কিংবা মস্তিষ্কের শক্তি নষ্ট করতে না হয়। মস্তিষ্কের শক্তি সঞ্চয় করার একটি সহজ উপায় হল প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের সংখ্যা কমানো।

বিজ্ঞাপন

বিখ্যাত ও অত্যন্ত সফল অনেক ব্যক্তিদের মধ্যে একটি প্রচলিত অভ্যাস লক্ষণীয়, তা হচ্ছে প্রায় নিয়মিতই একই ধরনের পোশাক পরিধান করা। অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস প্রতিদিন একই পোশাক পরতেন, আর তা হচ্ছে, কালো টার্টলনেক, নীল জিন্স এবং নিউ ব্যালেন্স স্নিকার্স। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ধূসর বা নীল স্যুট বেশি পরেন। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ বেশিরভাগ সময়ই তার আইকনিক ধূসর টি-শার্ট পরেন। ফিল্ম ডিরেক্টর ক্রিস্টোফার নোলান একটি নীল শার্টের উপর কালো, সরু-ল্যাপেল জ্যাকেট এবং কালো ট্রাউজারের সঙ্গে প্রতি দিন পরার মতো জুতা ব্যবহার করেন। ডক্টর ড্রে নামে পরিচিত বিখ্যাত সংগীত শিল্পী আন্দ্রে ইয়াং জানান তিনি প্রতিদিন একই জুতা পরেন। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন একই ধূসর স্যুটের বিভিন্ন প্রকরণ ব্যবহারের জন্যে পরিচিত ছিলেন। ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ব্রিটিশ বিলিওনিয়ার রিচার্ড ব্র্যানসন প্রতিদিন একই জিন্স পরেন। এছাড়া সনি মিউজিকের ক্রিয়েটিভ হেড মাতিলদা কাহল, হাফিংটন পোস্টের কো-ফাউন্ডার আরিয়ানা হাফিংটন, বিলিওনিয়ার জন পল ডিজোরিয়াসহ অনেকের মধ্যেই এই একই ধরনের পোশাক পরিধানের অভ্যাসটি লক্ষ্য করা যায়।

স্টিভ জবসও প্রায় প্রতিদিনই একই পোশাক পরতেন। কালো রঙের একটি লম্বা গলাযুক্ত গেঞ্জি, নীল রঙের জিন্স এবং নিউ ব্যালেন্স কোম্পানির স্নিকার জুতো। এটি ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক স্টাইল। স্টিভ জবস মনে করতেন, পোশাক নিয়ে প্রতিদিন চিন্তা করে সময় নষ্ট করার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে সেই সময় দেওয়া উচিত। প্রতিদিন একই পোশাক পরার কারণে পোশাক নির্বাচনের মতো ছোটখাটো সিদ্ধান্ত থেকে তিনি মুক্তি পেতেন এবং এর মাধ্যমে তিনি নিজের একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি তৈরি করেছিলেন। স্টিভ জবসের এই পোশাক পরিধানের ধারণাটি মূলত সনি কোম্পানির চেয়ারম্যান আকিও মোরিতার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত। আকিও মোরিতা সনি কোম্পানির কর্মীদের জন্য একই ধরনের পোশাক চালু করেছিলেন যা তাদের মধ্যে একতা ও পরিচয় তৈরি করেছিল। স্টিভ জবসের এই সাধারণ পোশাক পরিধানের বিষয়টি তার সরল জীবনযাপনের একটি প্রতীক হিসেবেও দেখা হয়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রতিদিন একই ধরনের পোশাক পরতেন, এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন- বারাক ওবামা একবার বলেছিলেন, তিনি তার পোশাকের সিদ্ধান্ত কমানোর চেষ্টা করতেন। কারণ তার আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হতো। তিনি তার মূল্যবান সময় এবং মনোযোগ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে দিতে চেয়েছিলেন। প্রতিদিন পোশাক নির্বাচনের ঝামেলা এড়ানোর মাধ্যমে তিনি তার মানসিক শক্তি সংরক্ষণ করতেন। এতে তিনি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে আরও বেশি মনোযোগী হতে পারতেন। প্রতিদিন অসংখ্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে ‘ডিসিশন ফ্যাটিগ’ দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ, ক্রমাগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে মানসিক ক্লান্তি তৈরি হয়। একই ধরনের পোশাক পরার মাধ্যমে বারাক ওবামা এই ক্লান্তি এড়াতে চেয়েছিলেন। প্রতিদিন একই ধরনের পোশাক পরার মাধ্যমে তিনিও তার একটি নিজস্ব পরিচয় তৈরি করেছিলেন যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল।

জাকারবার্গ মনে করেন পোশাক নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করা সময়ের অপচয়। তিনি তার মূল্যবান সময় আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যয় করতে চান। প্রতিদিন একই ধরনের পোশাক পরার কারণে তাকে পোশাক বাছাইয়ের ঝামেলা পোহাতে হয় না, যা তার সময় বাঁচায়। জাকারবার্গ বিশ্বাস করেন প্রতিদিন একই ধরনের পোশাক পরা তার মানসিক শক্তি সংরক্ষণ করে। পোশাক নিয়ে চিন্তা না করার ফলে তিনি তার মনোযোগ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দিতে পারেন। জাকারবার্গ বলেন, তিনি প্রতিদিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। তাই পোশাকের মতো ছোটখাটো বিষয়ে তিনি সময় নষ্ট করতে চান না। তিনি চান তার কমিউনিটির জন্য সর্বোচ্চ সুবিধা দিতে। একই ধরণের পোশাক পরার জন্য তার অতিরিক্ত পোশাক কেনার প্রয়োজন পরে না এবং এতে তার অর্থ সাশ্রয় হয়।

মনোবিজ্ঞানী ও ইউসি বার্কলে হাসের ভিজিটিং অধ্যাপক ব্যারি শোয়ার্টজ বলেন, যুক্তিটি বেশ সহজ। এটি তাদের দৈনিক ভিত্তিতে নেওয়া সিদ্ধান্তের সংখ্যা হ্রাস করে। ভ্যানিটি ফেয়ারের প্রতিবেদন অনুসারে, বারাক ওবামা, স্টিভ জবস এবং অন্যান্য সফল ব্যক্তিরা প্রায়শই সিদ্ধান্তের ক্লান্তি কমাতে এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে তাদের মনোযোগকে সুসংহত করার জন্য প্রতিদিন একই ধরণের পোশাক পরেন। ব্যারি শোয়ার্টজ বলেন, প্রতিদিন আমাদের মস্তিষ্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে শক্তির একটি সীমিত অংশ নির্দিষ্ট থাকে। আমরা প্রতিদিন হাজার হাজার সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে সেই সীমিত অংশটি ব্যবহার করতে থাকি। আর যখন তা মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে তখনই আমাদের মধ্যে ডিসিশন ফ্যাটিগ দেখা দেয়।

আইনস্টাইন একটি সরল জীবনযাপনে বিশ্বাস করতেন। তার মতে পোশাকের মতো ছোটখাটো বিষয়ে সময় নষ্ট করা অপ্রয়োজনীয়। তিনি তার জীবনকে সহজ এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে নিবেদিত রাখতে চেয়েছিলেন। আইনস্টাইন তার গবেষণায় এতটাই নিমগ্ন থাকতেন যে পোশাক তার কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তিনি তার মূল্যবান সময় বিজ্ঞান ও গবেষণার কাজেই ব্যয় করতে চাইতেন। তিনি পোশাক নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। প্রায়ই একই ধরনের পোশাক পড়তেন। জুতো নিয়ে তিনি একদমই চিন্তা করতেন না। একবার তিনি বলেছিলেন, জুতো নিয়ে চিন্তা করাটা সময়ের অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।

রিচার্ড ব্র্যানসন প্রতিদিন একই জিন্সের প্যান্ট পরেন কারণ তিনি তার দৈনন্দিন জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সংখ্যা কমাতে চান। তিনি বিশ্বাস করেন যে, পোশাক নিয়ে চিন্তা করার পরিবর্তে, তিনি তার সময় এবং শক্তি আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যয় করতে পারেন।

যারা একই ধরণের পোশাক পরিধান করে তারা তাদের সময়কে আরও বেশি উৎপাদনশীল কাজে ব্যয় করতে পারে। যারা একই ধরণের পোশাক পরেন তারা জানিয়েছেন যে তাদের খরচ কম হয় এবং প্রতিদিন কী পরবেন তা নিয়ে তাদের চিন্তা করতে হয় না। তাদের মানসিক চাপ কম থাকে, কারণ তাদের ভাবতে হয় না যে পোশাকটি ভালোভাবে মানাবে কিনা, রঙটি তাদের জন্য উপযুক্ত কিনা, এটি খুব ছোট কিনা ইত্যাদি। কম শক্তি ব্যয় হয়। পোশাক নির্বাচন করা নিজেই একটি চ্যালেঞ্জ এবং একজন ব্যক্তি কখনো কখনো ধৈর্য্য শক্তি হারিয়ে ফেলে। যখন আমাদের অনেক পোশাক থাকে, তখন আমরা বিভ্রান্ত হই এবং এতে কালক্ষেপন হয়।

শতকরা কতজন মানুষ একই ধরণের পোশাক পরিধান করে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই্ । তবে বিখ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের এরকম হতে দেখা যায়। সেনাবাহিনী, নার্স, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অন্যান জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা কাজে যারা নিয়োজিত থাকেন তাদেরকে একই ধরণের পোশাক পরিধান করতে হয়। এতে তাদের মধ্যে একতাবোধ ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধের নিবিড় বন্ধন সৃষ্টি হয়। পবিত্র হজের সময় সকল হাজীদের একই রকম সাদা পোশাক বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের ঐক্যের বন্ধন হিসেবে বিবেচিত।

আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ব্যারি শোয়ার্টজ (Barry Schwartz) The Pardox of Choice : Why More is Less নামে একটি বই লিখেন যা ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়। বইটিতে তিনি কোনো জিনিষের অত্যধিক সহজ লভ্যতা বিকল্পতার মনোভাব কিভাবে আমাদের ফলপ্রসু চিন্তা চেতনাকে অসার করে দিতে পারে তা তুলে ধরেছেন। যখন কারো সামনে অনেক বিকল্প থাকে তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খান। অনেকগুলো বিকল্প থেকে একটি বেছে নেওয়ার পর প্রায়ই সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তুষ্টিতে ভুগে এবং মনে করে অন্য বিকল্পগুলো মনে তুলনামূলক আরো ভালো ছিল। অতিরিক্ত বিকল্পের কারণে ‘পারফেক্ট’ সিদ্ধান্ত গ্রহণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই ‘পারফেক্ট’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা ব্যক্তির মাঝে হতাশা এবং উদ্বেগ তৈরি করে। ফলে আমাদের সামগ্রিক সন্তুষ্টি কমে যায়। সহজভাবে বলা যায়, বেশি বিকল্প সবসময় ভালো নয়। এটি আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে দুর্বল করে এবং অসন্তোষ তৈরি করে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে কোনো ব্যক্তিকে যদি ২০ ধরণের খাবার দেয়া হয় সেক্ষেত্রে মস্তিষ্কের Prefrontall Cortex (যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করে) অতিরিক্ত বিকল্প বিশ্লেষণ করতে যেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ ব্যক্তি হয় তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেয় অথবা একেবারেই সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। গবেষণা বলছে যদি খাবারের সংখ্যা কমিয়ে ৪-৬টির মধ্যে রাখা হয় তাহলে খাবার গ্রহণকারি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং ক্ষুধা নিবারণের পাশাপাশি মানসিক সন্তুষ্টিও বেশি হয়। বিকল্প বেশি হলে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও মস্তিষ্ক ভাবে যে অন্য কোন বিকল্প হয়তো আরও ভালো হতে পারত। এই ভাবনা মানুষের সন্তুষ্টি কমিয়ে দেয়। এই অবস্থাকে বলে ‘Eater’s Remorse’ বা ‘Choice Regret’।

শীনা আইয়েঙ্গার তার The Art of Choosing বইয়ে সহ-গবেষক মার্ক লেপারসহ ২০০০ সালে করা একটি গবেষণা তুলে ধরেন। তারা একটি সুপারমার্কেটে দুটি আলাদা দোকানে জ্যাম বিক্রির স্থান নির্ধারণ করেছিলেন। একটিতে ২৪টি ভিন্ন ধরনের জ্যাম (Jam) রাখা হয়েছিল। অন্যটিতে মাত্র ৬টি জ্যাম রাখা হয়েছিল। ফলাফলে দেখা গেছে, ২৪টি ভিন্ন ধরণের জ্যামের দোকানে ৬০% ক্রেতা ভিড় করে কিন্তু ক্রয় করে মাত্র ৩% ক্রেতা। অপর পক্ষে ০৬ টি রাখা জ্যামের দোকানে ভিড় করে ৪০% মানুষ আর ক্রয় করে ৩০% ক্রেতা। উক্ত ফলাফল থেকে বলা যায় বেশি বিকল্প থাকলে মানুষ আকৃষ্ট হয়, কিন্তু তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে যায়। সীমিত বিকল্প থাকলে তারা সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সন্তুষ্টও থাকে।

শীনা আইয়েঙ্গার একটি হৃদয়বিদারক উদাহরণ দেন যেখানে ব্রিটেন এবং আমেরিকাতে থাকা পিতামাতাদের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। পরীক্ষার ধরন: দুটো দেশেই শিশুদের লাইফ সাপোর্ট বন্ধ করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে পিতামাতার মনস্তত্ত্ব পরীক্ষা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে পিতামাতারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয় (বিকল্পের স্বাধীনতা)। যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেয় (বিশেষজ্ঞের ওপর নির্ভরশীলতা)। ফলাফলে দেখা যায় যাহাই ঘটুক না কেন ব্রিটিশ পিতামাতারা বেশি সন্তুষ্ট ছিল কারণ তারা মনে করত বিশেষজ্ঞের সিদ্ধান্তই সঠিক। আমেরিকান পিতামাতারা দুঃখ বোধ করত কারণ তারা মনে করত, যদি অন্য বিকল্প বেছে নিত, তাহলে হয়তো তাদের সন্তান প্রাণে বেঁচে যেত। সব ক্ষেত্রেই বিকল্পের স্বাধীনতা মানুষের জন্য সুখ নিয়ে আসে না। কখনো কখনো বিশেষজ্ঞের উপদেশ গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত।

গবেষণা দেখিয়েছে যে যখন মানুষকে কম বিকল্প দেওয়া হয়, তখন তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। বিপরীতে বেশি বিকল্প পাওয়া মানে মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত কাজ করানো, যা মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তি সৃষ্টি করে। মস্তিষ্ক যখন অনেকগুলো বিকল্প নিয়ে বিশ্লেষণ করে তখন কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স হলো মস্তিষ্কের সেই অংশ যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিকল্পনা এবং যৌক্তিক চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে। বেশি বিকল্পের ক্ষেত্রে এই অংশ অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ওভারলোড হয়ে যেতে পারে। ফলস্বরুপ মানসিক চাপ বৃদ্ধি, দ্বিধা এবং সিদ্ধান্তহীনতা দেখা দেয়। মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা অংশ মানুষের ভয় এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। বিকল্পের সংখ্যা বেশি হলে অ্যামিগডালা অত্যধিক সক্রিয় হয়ে ওঠে, কারণ মস্তিষ্ক সম্ভাব্য ভুল বা নেতিবাচক ফলাফল থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করে এবং উদ্বেগ ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয় ফলে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হয়।ডোপামিন হলো মস্তিষ্কের একটি নিউরোট্রান্সমিটার, যা আনন্দ এবং পুরস্কারের অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত। যখন অনেক বিকল্পের মধ্যে সেরা কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয় তখন ডোপামিন লেভেল কমে যায়। ফলে অসন্তুষ্টি, আনন্দহীনতা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও খুশি না থাকার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্ক প্রতিটি বিকল্প বিশ্লেষণ করার জন্য গ্লুকোজকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। বিকল্পের সংখ্যা বেশি হলে বেশি গ্লুকোজ ব্যবহৃত হওয়ায় মস্তিষ্কের ওপর চাপ পড়ে এবং শক্তি দ্রুত ক্ষয় হতে থাকে। এমতাবস্থায় ক্লান্তি, বিভ্রান্তি এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

মানুষ জন্মগত ও স্বভাবগতভাবে চিন্তাশীল প্রাণী এবং দৈনন্দিন জীবনে তাকে নানারুপ জটিল কিংবা বহুমাত্রিক সমস্যা ও পরিস্থিতি সমাধান বা নিয়ন্ত্রণ করে চলতে হয়। এ সকল সমস্যার শ্রেণীবিভাগ করে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ আবার কোনটি অধিকতর জরুরী তা বিবেচনা করলে অনেক কম সময়ে স্বল্প সংখ্যক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে তা সমাধান করা য়ায়। আমেরিকার ৩৪তম প্রেসিডেন্ট Dwight D. Eisenhower সিদ্ধান্ত গ্রহণে মানসিক চাপ কমাতে সময় ব্যবস্থাপনার একটি চমৎকার মডেল উদ্ভাবন করেছেন যা ‘The Eisenhower Matrix নামে পরিচিত। ১৮৯৭ সালে ইতালীয় অর্থনীতিবিদ Vilfredo Pareto একটি তত্ব আবিস্কার করেন যা পেরেটোর ৮০/২০ নীতি, পেরেটো নীতি, কম পরিশ্রমের নীতি, ৮০/২০ নীতি ইত্যাদি নামে পরিচিত। এতে মানুষের কম পরিশ্রমে কিভাবে তার লক্ষ্য অর্জন করা যায়, একই সাথে কিভাবে কয়েকটি কাজ সম্পাদন করা যায়, কিভাবে কাজগুলোকে গুরুত্বের বিচারে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে করে ফেলা যায় এ নিয়ে পেরেটো বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। সময় বাচিয়ে জটিল পরিস্থিতির সহজ সমাধানে কিভাবে বিস্ময়কর সাফল্য লাভ করা যায় তার কৌশল ও উদাহরণসহ বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া আছে বিখ্যাত গবেষকদের কয়েকটি বইয়ে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- Chip Heath & Dan Heath এর বিখ্যাত বই Decisive How To Make Better Choices In Life And Work w÷‡fb †Kvwfi The 7 Habits of Highly Effective People বইটিতে সময় ব্যবস্থাপনা এবং অগ্রাধিকার নির্ধারণের বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে আইজেনহাওয়ার ম্যাট্রিক্সের মতো জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ডেভিড অ্যালেনের Getting Things Done বইটিতে কাজগুলোকে কীভাবে কার্যকরভাবে সংগঠিত এবং সম্পন্ন করা যায়, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। মার্ক ফোর্স্টারের Do It Tomorrow and Other Secrets of Time Management বইটিতে সময় ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ফ্রান্সেসকো সিরিলোর The Pomodoro Technique কৌশলটিতে কাজগুলোকে ছোট ছোট বিরতিতে ভাগ করে, মনোযোগ ধরে রাখার মাধ্যমে কাজ সম্পন্ন করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। গবেষণাপত্র Time Management Strategies for Students এ শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন সময় ব্যবস্থাপনা কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। The Effects of Time Management on Work Productivity গবেষণাপত্রে কর্মক্ষেত্রে সময় ব্যবস্থাপনার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কার্যকর সময় ব্যবস্থাপনা কর্মীদের উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে, অগ্রাধিকার নির্ধারণ, চাপ কমানো, কাজের মান উন্নত করা এবং কর্মজীবনের মধ্যে একটি উন্নত ভারসাম্য তৈরি করে, যা পরিণামে আরও দক্ষতা এবং সাফল্যের দিকে পরিচালিত করে।

লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম

সারাবাংলা/এএসজি

পোশাক পরিধান প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

বহুগুণে গুণান্বিতা
২৩ মার্চ ২০২৫ ১৩:৪০

আজ বায়ু দূষণে ৩ নম্বরে ঢাকা
২৩ মার্চ ২০২৫ ১৩:২৫

আরো

সম্পর্কিত খবর