Monday 16 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মে দিবস: একদিনের শ্রদ্ধা কি যথেষ্ট?

সুদীপ্ত শামীম
১ মে ২০২৫ ১৬:৪৯

প্রতিটি ইট, প্রতিটি শস্যদানা, প্রতিটি যান্ত্রিক সিঁড়ির নিচে কোনো এক শ্রমিকের নিঃশব্দ কণ্ঠ রয়েছে। ১লা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস—একটি দিন যেটি কেবল ক্যালেন্ডারের পাতায় নয়, বরং সংগ্রামের ইতিহাসে লাল অক্ষরে লেখা। এই দিনটি বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের সংগ্রাম, অধিকার এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে পালিত হয়। শ্রমিকদের অবদানকে সম্মানিত করার জন্য তাদের প্রতি সঙ্গতিপূর্ণ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের এই দিনটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তবে বাস্তবতা হল, এই দিনটি চলে যাওয়ার পর, শ্রমিকদের কথা আর কতটা উচ্চারিত হয়? সমাজে তাদের প্রতি কতটুকু সহানুভূতি থাকে? তাদের অধিকার নিয়ে কতটা সত্যিকারের কাজ করা হয়? আজও অনেক শ্রমিক ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত, নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাবে আহত বা নিহত হন। অথচ তাঁরাই আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য ভিত্তি। এই বাস্তবতাই আমাদের ভাবিয়ে তোলে—শ্রমিকদের জন্য কি যথেষ্ট করছি আমরা?

বিজ্ঞাপন

শ্রমিকরা আমাদের সমাজের অমূল্য রত্ন

শ্রমিকরা আমাদের সমাজের অমূল্য রত্ন। তাদের পরিশ্রমের ফলেই পৃথিবী তার চলমানতা বজায় রাখে। কৃষকরা জমিতে ঘাম ঝরিয়ে খাদ্য উৎপাদন করেন, যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে। নির্মাণ শ্রমিকরা তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে রেখে ভবন তৈরি করেন, গার্মেন্ট শ্রমিকরা অত্যন্ত কম মজুরিতে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরান, এবং রিকশাচালকরা আমাদের দৈনন্দিন যাত্রাকে সহজ করে তোলে। এরা প্রত্যেকেই তাদের কাজের মাধ্যমে সমাজের ভিত্তি শক্তিশালী করেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত, তাদের প্রচেষ্টা এবং শ্রমের ফল কখনোই যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয় না। তাদের পরিশ্রমের স্বীকৃতি এবং সম্মান প্রায়শই উপেক্ষিত থাকে। শ্রমিকরা যে সংগ্রাম করে প্রতিদিন, তাদের সম্মান, মর্যাদা এবং অধিকার কখনোই তেমনভাবে আলোচনায় আসে না। তাদের জীবনযাত্রা এবং কাজের শর্তে কোনো পরিবর্তন হয় না, এবং তাদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয় না।

১লা মে: একদিনের শ্রদ্ধা কি যথেষ্ট?

১লা মে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়। এই দিনটি আসে, আসে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে বক্তৃতা, আলোচনা এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একদিনের বক্তৃতা, আলোচনা এবং সমাবেশে কি শ্রমিকদের সমস্ত সমস্যা সমাধান হয়? তাদের অধিকার পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়?

আমরা যে প্রতিদিন শাক-সবজি, চাল, ডাল, মাছ এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য কিনে খাই, তা কিন্তু আসে শ্রমিকদের অদেখা পরিশ্রম থেকে। যাদের কঠিন কাজের কারণে আমরা আমাদের জীবনযাত্রা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারি, তারা কী কখনো নিজেদের অধিকার ভোগ করতে পারে? তাদের মজুরি কী যথাযথ? তাদের কাজের পরিবেশ কি নিরাপদ? তাদের সুরক্ষা কি নিশ্চিত? এর উত্তর, অধিকাংশ ক্ষেত্রে, নেতিবাচকই হয়ে থাকে।

এদের অবস্থা যদি খতিয়ে দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে, তারা অধিকাংশ সময় বেতন এবং সুবিধার অভাবে মানবিক সন্মানও হারিয়ে ফেলে। একদিকে, শ্রমিকরা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন, অন্যদিকে তাদের মৌলিক অধিকার প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। ১লা মে শ্রমিকদের জন্য শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হলেও, তাদের সমস্যাগুলির স্থায়ী সমাধান কখনোই আসেনি। তাদের প্রতি সমব্যথী মনোভাব এবং কার্যকরী পদক্ষেপ প্রয়োজন।

শ্রমিকদের মানবাধিকার এবং শর্ত

শ্রমিকদের কাজের শর্ত এবং তাদের মানবাধিকার প্রায়শই উপেক্ষিত হয়। বিশ্বের অনেক দেশে শ্রমিকদের শোষণ করা হয়। প্রায়শই দেখা যায়, গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাজের সময় সীমাবদ্ধ নয়, তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল, মজুরি খুবই কম। কৃষকরা ঋণের চাপে পড়ে, অতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের কৃষি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য কোনো স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নেই, অনেক সময় ঝুঁকি নিয়ে তাদের কাজ করতে হয়। এই সমস্যাগুলি শ্রমিক দিবসের সময় অনেক আলোচনা হলেও, বাস্তবে তা খুব কমই সমাধান হয়।

শ্রমিকদের জন্য শ্রম আইন থাকা সত্ত্বেও, বহু দেশে সেগুলির বাস্তবায়ন হয় না। এটা শুধু তাদের কর্মপরিবেশেরই বিষয় নয়, বরং তাদের সামাজিক নিরাপত্তা, চিকিৎসা সুবিধা, পরিবার-বাচ্চাদের জন্য সুরক্ষা, এবং শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কেও অনেক সমস্যা রয়েছে। তাদের কর্মঘণ্টা, মজুরি, কাজের ধরন—সবই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা সাধারণত উপেক্ষিত থাকে। তাছাড়া, অধিকাংশ শ্রমিকই ইউনিয়ন বা সংগঠনের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে পারেন না, কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে প্রায়শই অব্যবস্থা বা প্রতিকূলতা সৃষ্টি করা হয়।

শ্রমিকদের অধিকার: আমাদের দায়িত্ব

শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে ১লা মে বক্তৃতা দেওয়া এবং শোভাযাত্রা করা একদিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অন্যদিকে শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া আরো গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের, বিশেষ করে যারা শ্রমিক শ্রেণীর সাথে সম্পর্কিত, তাদের জন্য একটি সুস্থ, নিরাপদ এবং সুরক্ষিত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার। তাদের মজুরি আরও বৃদ্ধি করা, কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধি কার্যকর করা—এইসব বিষয়গুলো গুরুত্ব পেলে, শ্রমিকরা তাদের কঠিন পরিশ্রমের সঠিক মূল্য পাবে।

এছাড়া, শ্রমিকদের জন্য শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষা সেবা বৃদ্ধি করা জরুরি। তাদের জন্য বীমা, স্বাস্থ্য সেবা, পেনশন সুবিধা এবং অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করা তাদের জীবনযাত্রা উন্নত করার জন্য অপরিহার্য। যদি শ্রমিকদের জন্য উন্নত কাজের পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা হয়, তবে তা শুধু তাদের নয়, সমাজের সামগ্রিক উন্নতির জন্যও সহায়ক হবে। আমাদের সরকার, প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের প্রতিটি সদস্যের দায়িত্ব হলো শ্রমিকদের শোষণ বন্ধ করে, তাদের জন্য একটি মানবিক এবং সুরক্ষিত পরিবেশ তৈরি করা। এভাবে, আমরা শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবো এবং একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে পারবো।

শ্রমিকদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব

আমাদের দায়িত্ব শুধু ১লা মে শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো নয়, বরং প্রতিদিন তাদের অধিকার, মর্যাদা এবং সুরক্ষার বিষয়ে কাজ করা। সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে শ্রমিকদের জন্য একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের উচিত শ্রমিকদের কাজের মান এবং জীবনের মান উন্নয়নে যত্নশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তাদের সমস্যাগুলির প্রতি সচেতনতা বাড়ানো, তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের জন্য একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।

আমাদের সমাজে শ্রমিকরা যেভাবে তাদের অবদান রাখছে, তাদের জন্য তারা প্রাপ্য সম্মান এবং অধিকার অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। ১লা মে-এর পরেও তাদের সম্পর্কে ভাবনা ও উদ্যোগ নিতে হবে, যা তাদের উন্নতি এবং সম্মান প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর হবে। শুধুমাত্র বক্তৃতা বা একদিনের শ্রদ্ধা নয়, তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী, বাস্তবসম্মত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের সকলের উচিত, শ্রমিকদের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং কার্যকরী পদক্ষেপের মাধ্যমে একটি সমাজ গঠন করা, যেখানে শ্রমিকরা তাদের পরিশ্রমের সঠিক মূল্য ও সম্মান পাবে এবং একটি উন্নত জীবনযাত্রার অধিকারী হবে।

শ্রমিক মর্যাদার দাবি

শ্রমিকদের মর্মবেদনা এবং সংগ্রামের কথা আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে। একদিনের জন্য তাদের শ্রদ্ধা জানানো যথেষ্ট নয়। তাদের অধিকার ও মর্যাদার পক্ষে আমাদের কাজ করতে হবে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। তাদের জীবনমান উন্নয়ন এবং সুরক্ষার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নিলে, সমাজের সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব। শ্রমিকদের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ প্রয়োজন—একদিন নয়, প্রতিদিন। তাদের কঠোর পরিশ্রমের মূল্যায়ন করতে, তাদের জন্য নিরাপদ ও সুরক্ষিত কর্মপরিবেশ তৈরি করতে, এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা জরুরি। একটি উন্নত সমাজ গঠন করতে, শ্রমিকদের মর্যাদা ও অধিকারকে সম্মান জানানো আমাদের মূল দায়িত্ব। সুতরাং, প্রতিদিন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে আমরা একটি ন্যায্য এবং সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারব।

লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক

সারাবাংলা/এএসজি

মুক্তমত মে দিবস সুদীপ্ত শামীম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর