ঢাকা: ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’— রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার এই লাইনটির মতোই এদেশের মা, মাটি ও মানুষের জন্য জন্মেছিলেন এক মহীয়সী নারী। তার জন্ম ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য আশীর্বাদ। তিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে বার বার পতনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এ জন্য তাকে অসংখ্যবার জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। সর্বশেষ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগেও তিনি কারান্তরীণ ছিলেন। কথা ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ফের বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় শামিল হবেন। কিন্তু এবার আর জীবনের সঙ্গে পেরে উঠলেন না তিনি। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আপসহীন নেত্রী, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে, পৃথিবী ছেড়ে।
মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোরে মৃত্যুবরণ করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বেশকিছু দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। তবে সর্বশেষ অবস্থা তাকে তার ফিরতে দিল না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার ভূমিকা জনগণ কখনোই ভুলতে পারবে না। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে অসংখ্য মামলা, জেল জুলুমেও তিনি দেশ ত্যাগ করেননি, শত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কোন আপস করেননি। তিনি দেশেই ছিলেন, দেশের মানুষের পাশে ছিলেন। আপসহীন অবস্থা থেকে সরে আসেননি। তার ওপর যত নির্যাতন হয়েছে, ততই তার প্রতি জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা বেড়েছে। তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন। জুলাই অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতনের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তিনি জাতির ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হন।
দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব থাকা বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে সারাবিশ্বের গণতান্ত্রিক ও স্বাধীনতাকামী জনগণের কাছে। তিনি আজীবন লড়েছেন স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চা, বহুদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিস্তার, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই এবং জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এক অনন্য নাম বেগম খালেদা জিয়া। জীবন সায়াহ্নে বেগম জিয়া ছিলেন দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও আস্থার প্রতীক। জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের এই সন্ধিক্ষণে তার প্রয়াণ জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
গৃহবধূ থেকে বিএনপির মতো বৃহৎ দলের নেতা, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আপসহীন নেতৃত্ব, দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, তিন তিনবার সরকার পরিচালনায় দলকে নেতৃত্ব দেওয়া, দেশের সার্বিক অগ্রগতি বিশেষ করে নারী শিক্ষার প্রসারে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন এবং লড়াই-সংগ্রামের জীবনে গণতন্ত্র আর তিনি যেন সমার্থক হয়ে উঠেন। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। দল-মত সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন তিনি। দেশের জনগণের হৃদয়ে তিনি যে স্থান করে নিয়েছেন তা কখনোই ম্লান হবে না। আজ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে যে সংগ্রাম চলছে, সেখানে তিনি আদর্শ হয়ে থাকবেন।
খালেদা জিয়ার জন্ম ও বেড়ে ওঠা
১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের জলপাইগুঁড়িতে বেগম জিয়া জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম রাখা হয় ‘শান্তি’। পরে মেজো বোন সেলিমা ইসলাম তার নাম রাখেন ‘পুতুল’। পরবর্তী সময়ে তার পরিবার দিনাজপুরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তার বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ও মা তৈয়বা মজুমদার। তাদের আদি বাড়ি ছিল ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে।
রাজনৈতিক যাত্রা শুরু যেভাবে
১৯৮১ সালের ৩০ মে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রামে কিছু বিপথগামী সেনা অফিসার হত্যা করে। ওই সময় খালেদা জিয়া ছিলেন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। তখন তিনি দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুতে মাত্র কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি একেবারেই বিপর্যস্থ। বিশেষ করে দলটির হাল কে ধরবেন- এ নিয়ে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। তখন ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। তার বয়স তখন আনুমানিক ৭৮ বছর।
তখনকার রাজনীতিতে সাত্তারকে একজন বৃদ্ধ এবং দুর্বল চিত্তের ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হতো। দলের একটি অংশ চেয়েছিল কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্বের কাঠামো ঠিক করা হোক। আর একটা অংশ চাইছিল বেগম খালেদা জিয়া দলের হাল ধরুক। একদিকে স্বামী হারানোর শোক, অন্যদিকে রাজনীতিতে তার অনভিজ্ঞতা এই কারণে তিনি দলের দায়িত্ব নিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। এছাড়া দুই সন্তানের ভবিষ্যৎও তাকে চিন্তায় রাখতে হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে ফেরদৌস আহমদ কেরেশীসহ অনেক নেতা তাকে দলের হাল ধরার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করেন। একদিকে তার ব্যক্তিগত জীবন অন্যদিকে স্বামীর হাতে গড়া দলের অনিশ্চিত যাত্রা।
১০ বছরে গৃহবধূ থেকে আপসহীন নেত্রী
খালেদা জিয়া সব পিছুটান ফেলে রাজনীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ১৯৮২ সালের ১৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হওয়ার মাধ্যমে ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ রাজনীতিতে পা রাখেন তিনি। একই বছর ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে খালেদা জিয়া প্রথম বক্তব্য দেন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন। সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের কয়েকমাস পরেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এ সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। ১৯৮৪ সালের ১০মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশজুড়ে খালেদা জিয়া আপসহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিতি পান। গণঅভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিএনপি জয়লাভ করে। ১০ বছরের সংগ্রাম তিনি গৃহবধু থেকে আপসহীন নেত্রীতে পরিণত হন। একই সঙ্গে হন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।
১৯৮২ সালে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনের সূচনা করেন। তার নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে গঠিত সাত দলীয় জোট গঠন করা হয়। তিনি ১৯৮৬ সালে স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে প্রহসনের নির্বাচনের বিরোধিতা করেন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এরশাদের অবৈধ সরকারকে বৈধতা দিতে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন শাসনের অধীনে নির্বাচনে যোগ দিয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়া এক মুহূর্তের জন্যও স্বৈরাচারের সাথে আপস করেননি। এরশাদ ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য নির্বিচারে ছাত্র হত্যার পথ বেছে নেয়। তিনি এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতবার আটক করা হয় তাকে। এ সময় দেশের জনগণ তাকে ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধি দেন।
রাজনীতি ও কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতিনিধিত্বকারী
নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমাদের সার্বিক অগ্রগতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। বর্তমানে সাংবাদিকতা, শিক্ষা, আইন-আদালতসহ দেশের সব সেক্টরে নারীরা দাপটের সঙ্গে, সম্মানের সঙ্গে বিচরণ করছেন। আমাদের গার্মেন্ট সেক্টরে বিপুল সংখ্যক নারী কাজ করে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। কেবল তাই নয়, অনেকে বিদেশে কাজ করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অর্থনীতিতে অসামন্য ভূমিকা রেখে চলেছেন। কেবল পারিবারিক বা আর্থিক অগ্রগতিতে নয়, যেকোনো অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধেও এই দেশের নারীরা সরব। সর্বশেষ জুলাই অভ্যুত্থানেও আমরা রাজপথে বিপুল সংখ্যক নারীকে দেখেছি রাজপথে। তাদের বিপুল উপস্থিতি স্বৈরাচারের পতন ত্বরান্বিত করেছে। আমাদের মতো পশ্চাৎপদ একটা দেশে নারীদের এভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়ার প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকাকে কেউই অস্বীকার করতে পারবে না।
নারী শিক্ষার অগ্রপথিক
বিশেষ করে ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর নেতৃত্বহীন বিএনপির হাল ধরার সিদ্ধান্ত ছিল এই দেশের নারীদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার প্রেরণার একটা সোপান। বিএনপির মতো জনপ্রিয় একটা দলের নারী নেতৃত্ব এই দেশের আপামর জনগণের মধ্যে কন্যা সন্তানদের পড়ালেখা করিয়ে যোগ্য করে গড়ে তোলার মনোভাব তৈরিতে বিরাট প্রভাব তৈরি করে। দীর্ঘ আট বছর এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তার আপসহীন লড়াই দেশব্যাপী তার একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করে। গণমানুষের সামনে তিনি আপসহীন নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তার এই লড়াই, তার এই সফলতা এই দেশের গৃহবধু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সকল স্তরের নারীদের মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাস তৈরি করে।
নিজের লড়াই সংগ্রাম দিয়ে কেবল নয়, তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নারীর অগ্রগতিতে ব্যাপক সংস্কারের পদক্ষেপ নেন। বিশেষভাবে তিনি নারীর সাক্ষরতার হার বাড়াতে এবং তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হন। এজন্য তিনি মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করেন এবং বাংলাদেশের রফতানিমুখী পোশাক খাতের বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখেন। যেখানে বহু নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে মেয়েদের স্কুলমুখী করতে বিনামূল্যে শিক্ষার পাশাপাশি শুধু তাদের জন্য আলাদা বৃত্তিরও ব্যবস্থা করেন। বিদেশি দাতাদের সহায়তায় স্কুলশিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে দুপুরের খাবার সরবরাহের উদ্যোগও নেয়া হয়। তার এই বহুমুখী উদ্যোগের ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এক ধরনের বিপ্লব ঘটে যায়।
নারী শিক্ষায় খালেদা জিয়ার এই ভূমিকার কথা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে তুলে ধরা হয়। ১৯৯৩ সালের ১৭ নভেম্বর মার্কিন পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নারীর ক্ষমতায়নে তার ভূমিকা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরে। পাকিস্তানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর নীতির সঙ্গে বৈসাদৃশ্যের বিষয়টি তুলে ধরে পত্রিকাটি লিখেছে, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম জিয়া অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে শিক্ষা এবং কারিগরি প্রশিক্ষণকে উৎসাহিত করেছেন, বিশেষ করে মেয়েদের মাঝে।’ বেগম রোকেয়া নারীর অগ্রগতিতে যে স্বপ্ন দেখেছেন তা পূরণে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে, তবে সেই স্বপ্ন পূরণে বেগম খালেদা জিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান গুরুত্বের সঙ্গে ইতিহাসে লেখা থাকবে।
কোনো নির্বাচনে হারেননি খালেদা জিয়া
খালেদা জিয়া ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনগুলোর প্রতিটিতে পাঁচটি করে সংসদীয় আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি যে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন সেখানেও তিনি সব ক’টিতে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। তিনি জীবনে কোনো নির্বাচনে হারেননি। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এই মানসকন্যা ও আমৃত্যু আপসহীন নেত্রীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।