আজ পাখিদের উড়বার স্বাধীনতা
২৭ মার্চ ২০২০ ১৪:৩৪
আমার নানুবাড়িতে একটা ভাঙাচোরা পাকা বিল্ডিং আছে। মামনিদের দাদার বানানো। সত্তর সালের ঝড়ে ছাদ ভেঙে পড়ার পর থেকে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। নানার মেঝভাই মেরামত করলেও লোকজন এটার ইট, জানালার লোহা খুলে নিয়ে যায়। পরে আর ঠিক করা হয়নি। কেউ বাসও করত না। শতবর্ষ পরে এখন তো আরও ভেঙে পড়া অবস্থা। নানুবাড়ির সবাই এটাকে দালান বলে।
ছেলেবেলা থেকেই দেখছি, দালানের দু’টো ঘর আর সামনের বারান্দা স্টোররুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ধানের গোলা থেকে শুরু করে কাঠাল, গুড়, কলা, আম, চাল-ডাল— সবই থাকে সেখানে। বারান্দায় থাকে জ্বালানির জন্য পাটকাঠি, বড়ে (গোবরের জ্বালানি), নারকেল সুপারির পাতা, ডালপালা। দালানের রোয়াকে আর সিঁড়িতে আমি নিজেও ছোটবেলায় মেহেদি বেটেছি, হাড়িকুড়ি খেলেছি। কিন্তু সাপের ভয়ে ঘরের মধ্যে কখনো ঢোকা হয়নি। তালা খুলে মুখে হুশ হুশ শব্দ করে টর্চ জ্বালিয়ে নানা, বড়মামা বা নানু ভেতরে গিয়ে এটা-ওটা আনতেন।
দালানের ঠিক উল্টোপাশে টিনের দোচালা পাকা ঘরে নানাদের বাস। আমার যখন জ্বর হতো, তখন এই ঘরের বারান্দায় শুইয়ে নানু মাথায় পানি ঢালতেন। শীতের রোদে এই বারান্দায় পাটিতে শুয়ে-বসে থেকেছি কখনো সখনো। সামনাসামনি দালানের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কাজ ছিল না। এমনকি অসুস্থ না থাকলেও এই বারান্দার বেঞ্চে বসে উঠোনের ওপাশে পরিত্যক্ত দালানের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। চেয়ে চেয়ে দেখতাম কীভাবে ভাঙা দালানের ফাঁকফোঁকড় দিয়ে বট-পাকুড়ের গাছ বের হয়েছে। প্রতিবছর যেন একটু একটু করে বাড়ে সবুজের সংখ্যা। আর দালানটাও একটু একটু করে ‘পোড়ো বাড়ি’তে রূপ নেয়।
আমার নানুবাড়ির পরিত্যক্ত ভাঙা দালানই শুধু নয়, ওই গ্রামে ব্রিটিশ আমলের এমন বেশ কয়েকটি পুরনো দালান আছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলো ভেঙে পড়ছে, ঢেকে যাচ্ছে ঘন সবুজে। নড়াইলে ব্রিটিশ আমলের কুয়া, পুকুরপাড়, নদীর ঘাট, প্রার্থনালয়সহ অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন এভাবে সবুজে ঢেকে যেতে দেখেছি। পুরনো আমলের বাড়ির ছাদে দুয়েকটা বট-পাকুড়ের শেকড় ছড়ানো যেন স্বাভাবিক ঘটনা। এসব দেখে দেখে আমার ধারণা ছিল, শুধু পুরনো আমলের বাড়িতেই গাছ গজায়। লতাপাতায় ঢেকে যায়।
আমার ভাবনার জগতে নাড়া লাগে বছর দুই আগে, ৩৭ বিজয়নগরের সারাবাংলা অফিসের ছাদে। ছাদের ওপর বালি আর ইটের খোয়ার বস্তার স্তূপ কয়েকদিনের মধ্যেই সবুজে ছেয়ে যেত। পরিষ্কার করে শেষ করতে না করতেই নতুন করে আবার গাছে ভরে উঠত। নতুন বিল্ডিং। অথচ এখানে সেখানে ঠিক বট-পাকুড়ের শেকড়। না আছে মাটি, না আছে যত্ন। রোদ আর বৃষ্টিতেই প্রকৃতিকে তার জায়গা করে নিতে দেখেছি।
তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম আর ভাবতাম— প্রকৃতির কী শক্তি! মানুষ ১৬ তলা ভবন তুলেছে, কিন্তু প্রকৃতিকে রুখবে সে সাধ্য কোথায়! বুঝলাম, আমার নানুবাড়ির শতবর্ষী ভাঙা দালানের মতো পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে দিলে নবনির্মিত এই বিশাল প্রীতম-জামান টাওয়ারকেও প্রকৃতি সবুজে ঢেকে ফেলবে।
যতই আস্ফালন করি না কেন, প্রকৃতির অতি ক্ষুদ্র অংশ আমরা। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের হাজার বছরের চেষ্টা আমাদের। সভ্যতার কী নিদারুণ অপচয়। পৃথিবীর ভেতর ও বাইরের সব আকর আর সম্পদ আমরা শেষ করে ফেলছি নিদারুণ লোভ আর ভোগবিলাসিতায়। কে কার চেয়ে বেশি ধনী আর ক্ষমতাশালী হবে, সেই পাল্লা চলে দিনরাত। বিশ্বের বড় বড় নেতারা সারাক্ষণ ব্যস্ত কীভাবে আরও আরও ক্ষমতাশালী হওয়া যায়, সে চেষ্টায়। আজ সিরিয়ায় যুদ্ধ বিমানের হামলা, কাল আফ্রিকার গৃহযুদ্ধ— খালি হয়ে যায় জনপদের পর জনপদ। বিশ্বনেতারা একদিকে ব্যস্ত কূটনৈতিক যুদ্ধে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ দিনের পর দিন আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ছে ভোগবাদিতায়।
কিন্তু আজ প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার দিন শেষ। মাত্র কিছুদিন আগেই অস্ট্রেলিয়ায় মাইলের পর মাইল বন পুড়ে ছাই। সেইসঙ্গে মরে শেষ লাখ লাখ বন্যপ্রাণী। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত গলছে বরফ। একটু একটু করে বাড়ছে সাগর-মহাসাগরের পানির উচ্চতা। আর বিশ্বের নিচু এলাকায় বাস করা মানুষ একটু একটু হারাচ্ছে বসবাসের উপযোগী শুকনো জমি। আমরা আতঙ্কিত হয়ে ভাবি, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো জলমানব হয়েই না বাস করতে হয়!
শুধুই কি বিশ্বনেতাদের দোষ? আমরা মানবজাতি একবিংশ শতাব্দীতে ভোগবাদিতার চরম সীমা অতিক্রম করেছি। নিত্য নতুন ডিজাইনের বৈদ্যুতিক যন্ত্রই শুধু নয়, আমাদের চাই আরও আরও সম্পদ, আরও আরও খাবার আর বিলাসদ্রব্য। ফলাফল— পৃথিবীতে জ্বালানির সংকট। এই শতাব্দীর শুরু থেকেই দেখছি কীভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য এক দেশ আরেক দেশে বোমা মেরে মানুষ মারছে। নিজ ভূখণ্ড থেকে পালাতে গিয়ে মহাসাগরে ভেসে উঠছে শিশুর মরদেহ।
শুধুই কি মানবশিশু? বিশ্বের নানা প্রান্তের সমুদ্র সৈকতে ভেসে উঠছে হাজার হাজার সামুদ্রিক প্রাণীর মরদেহ। এদের মৃত্যুর জন্য কিন্তু আমি আপনিই দায়ী। পানিতে ময়লা ফেললে তা দূষিত হয় না— এমন সরল বিশ্বাসে আমাদের ফেলা প্লাস্টিক পণ্য আর রাসায়নিক পদার্থ বিষাক্ত করে ফেলেছে সাগরের পরিবেশ। প্লাস্টিকের বোতলে পাইপ গলায় ঢুকে মারা যাচ্ছে সাগরের তলদেশের কাছিমের বাচ্চা। আমরা দেখেছি আর আহা-উহু করছি, কিন্তু হাতেগোনা দুই-চার জন মানুষ ছাড়া কেউ নিজেদের জীবনধারা ও আচরণ বদলানোর চিন্তা করিনি। আমরা জেনেছি এবং শুনেছি, কার্বন নিঃসরণের কারণে পৃথবীকে সূর্যরশ্মি থেকে বাঁচানো সুরক্ষা পর্দা ওজন লেয়ারের এখানে সেখানে ছিদ্র হয়ে গেছে। কিন্তু শুনেও মনে লাগাইনি। বাড়িতে ফেরার পথে রান্নাঘরের জন্যও আরেকটা এসি কিনে এনেছি। অথবা নতুন মডেলের গাড়ি কিনেছি। আমার একটা এসিতে কী হবে— ভেবে দায় এড়িয়েছি। গাছ কেটে আর জলাশয় ভরাট করে করে পৃথিবীর তাপমাত্রা এত বাড়িয়েছি যে আজ বিশ্বের একপ্রান্তে আগুন লাগে তো আরেক প্রান্তে মহাশক্তিশালী টর্নেডো এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এসব দেখেশুনেও আমরা চুপ করে থেকেছি। মোবাইলে গেম খেলেছি আর পিজা হাটে নিত্যনতুন পিজা অর্ডার করেছি।
কিন্তু প্রকৃতি প্রমাণ করে দিলো, আমরা কেউই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নই, নই অতিমানব। তাই আজ বিরাট ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে বিরাট ধনী অভিনেতা কী মহাশক্তিধর রাজপুত্র— সবাই ছোট্ট এক ভাইরাসের সংক্রমণে অসহায়। এতটাই অসহায় যে করোনাভাইরাস নামের মহাশক্তিশালী সেই ভাইরাসের দখলে আজ বিশ্বের প্রায় সব দেশ। এর মধ্যে পাঁচ লাখের বেশি, মৃত্যু ২৪ হাজার পেরিয়ে গেছে। কোনোকিছুতেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না এই ভাইরাস। বিলিয়ন ডলার ঢেলেও বের করা যাচ্ছে না এর ওষুধ বা প্রতিষেধক। গত বছরের শেষ দিন থেকে শুরু, সেই হিসাবে প্রায় তিন মাস হতে চললো। কিন্তু বিশ্বের বাঘা বাঘ সব বিজ্ঞানীরাও এখন পর্যন্ত কোনো জবাব বের করতে পারেননি এই ভাইরাসের। উল্টো এই ভাইরাসই বরং দ্রুততার সঙ্গে নিজের জিনগত বৈশিষ্ট্য বদলিয়ে বিজ্ঞানীদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে চলেছে।
ওষুধপত্র যখন ব্যর্থ, তখন করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ রোগের বিস্তার ঠেকানোর একটা রাস্তা পাওয়া গেছে— মানুষকে মানুষের থেকে আলাদা করে ফেলা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভাইরাস ছড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ থেকে এবং তার থুতু, কফ, হাঁচি-কাশির ড্রপলেটের মাধ্যমে। তাই এরকম ব্যক্তির স্পর্শ এবং ড্রপলেট এড়াতে তারা ওই ব্যক্তি থেকে অবস্থানের দূরত্বও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন— সেটা ১ মিটার বা তিন ফুট। চীন শেষ পর্যন্ত এই পদ্ধতিতেই নিয়ন্ত্রণে এনেছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের গতিকে। বাকি সব দেশও ঠিক এই ‘সামাজিক দূরত্ব’ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতেই গুরুত্ব দিচ্ছে এখন।
বিশ্বের বড় বড় দেশের দেশের বড় বড় নেতারা আজ না পারছেন পরমাণু অস্ত্র বানানোর পরিকল্পনা করতে, না পারছেন কোন কোন দেশ দখল করা যায় সেই পরিকল্পনা করতে। কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী আক্রান্ত হওয়ার পর তিনিই সবার প্রথম নিজেকে কোয়ারেনটাইন করে ফেলেন। অর্থাৎ মানুষের সংস্পর্শ থেকে নিজেকে দূরে রেখে একাকী করে ফেলেছেন। বাকি সবার ক্ষেত্রেও তাই। আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে আসলে ১৪ দিন নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে। এর মধ্যেই বোঝা যাবে তিনি সংক্রমিত কি না। করোনাভাইরাস সবাইকে বাধ্য করছে আক্রান্ত হলে সবার থেকে দূরে সরে যেতে। যত ক্ষমতাবানই হোন না কেন, আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে এলেই এই ভাইরাস থেকে রেহাই নেই। ঠিক এতটাই অসহায় আমরা ক্ষুদাতিক্ষুদ্র এই ভাইরাসের কাছে।
তাই আসুন, মানুষ হিসেবে আরেকটু কমপ্যাশনেট অর্থাৎ দয়াবান হই। প্রকৃতিকে আরেকটু ভালোবাসি, নিজেদের ভোগবাদী আচরণ নিয়ন্ত্রণে আনি। কল-কারখানা, গাড়ি ও যন্ত্রপাতি না চলার কারণে এরই মধ্যে চীনের আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। ইতালির ভেনিসের বিখ্যাত লেকগুলোতে মহানন্দে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট মাছ থেকে শুরু করে বড় আকারের কচ্ছপ, যারা এতদিন মানুষের ভয়ে এ পথ মাড়াত না। এসব দেখে একবার ভাবুন, কতটা নিষ্ঠুরের মতো এই বিশ্বটাকে নিজেদের মুঠোয় এনে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনেছি আমরা।
করোনাভাইরাসের দিনগুলোতে আবদ্ধ থাকতে থাকতে তাই আসুন প্রতিজ্ঞা করি— এ যাত্রা বেঁচে গেলে যেন পৃথিবী নামক গ্রহটাকে আরেকটু ভালোবাসি। জীবাশ্ম জ্বালানির পোড়ানোর পরিমাণ কমিয়ে ফেলি, কমিয়ে ফেলি অতিরিক্ত ভোগবাদিতা, যেন কোম্পানিগুলোই কম কম জিনিস উৎপাদন করতে বাধ্য হয়। আসুন আকাশটাকে পাখিদের জন্য ছেড়ে দেই। যেন তারাও পায় উড়বার স্বাধীনতা।