পদ্মার বুকে ইস্পাতের মায়া ধনু
১১ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:০১
শিমুলিয়া ঘাটে ১৫ বছর ধরে খাবারের হোটেলের ব্যবসা করেন ইউসুফ ব্যাপারী। রেস্টুরেন্টের নাম পদ্মার পাড়। মাত্র মাসখানেক আগে রেস্টুরেন্ট বড় করেছেন। সেইসঙ্গে বদলেছেন নাম। ‘পদ্মার পাড়’ এখন হয়ে গেছে ‘নিউ বসুন্ধরা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’। সেই রেস্টুরেন্টে বসেই কথা হচ্ছিল ইউসুফ ব্যাপারীর সঙ্গে। জানালেন এই সেতু ঘিরে তার স্বপ্নের কথা। এক কথায় এই দিনটি তাদের জন্য অনেক গর্বের আর খুশির— বলেন তিনি।
পদ্মাসেতুর সর্বশেষ, অর্থাৎ ৪১তম স্প্যান বসানোর ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে টিম সারাবাংলার পক্ষ থেকে যাওয়া হলো মাওয়া প্রান্তে। বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) দুপুর নাগাদ স্প্যানটি বসানো হয়ে গেলে ফেরার পথে কথা হচ্ছিল ইউসুফ ব্যাপারীর সঙ্গে।
ইউসুফ ব্যাপারী মুন্সীগঞ্জের অধিবাসী। বলছিলেন, পদ্মাকে দেখছেন জন্মাবধি। সেই প্রমত্ত পদ্মার বুকে যে কখনো সেতু হতে পারে, কল্পনাতেও ছিল না এই এলাকার মানুষের। ইউসুফ ব্যাপারীর সঙ্গে মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছিলেন তার দোকানের কর্মীরাও। সবার মুখ আনন্দে ঝলমল।
এতদিন তো নদীর ঘাটে ফেরি, ট্রলার আর স্পিডবোটে পারাপারের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীদের আনাগোনা ছিল। সেই সুবাদে মাওয়া ঘাটের রেস্টুরেন্টগুলোও ছিল জমজমাট। জানতে চাইলাম, ব্রিজ চালু হওয়ার পর তাদের রেস্টুরেন্টে লোক কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে কি না। ইউসুফ বলেন, তাদের এখানে ভোজনরসিক কমার আশঙ্কা তেমন নেই। কারণ অধিকাংশ মানুষ এসব হোটেল-রেস্টুরেন্টে খাওয়ার উদ্দেশ্যেই আসেন। নদী পারাপারের যাত্রীরা খুব একটা আসে না। সেই সঙ্গে ইউসুফ এ-ও জানালেন, যদি হোটেল বন্ধ করতে হয় করবেন, কিন্তু কোটি মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আসা এই সেতুর আনন্দের সঙ্গে পেশা বদলানো কোনো ব্যপারই না। ইউসুফ ব্যাপারীর চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠা খুশি যেন উছলে উঠছিল। দোকানের অন্যদের চোখ-মুখও বলছিল, সবাই একমত ইউসুফ ব্যাপারীর সঙ্গে।
প্রমত্তা পদ্মা। যেমন গভীর, তেমনি খরস্রোতা। যুগ যুগ ধরে পদ্মা যেমন ভালোবাসায় আঁকড়ে রেখেছে এর দুই তীরের মানুষকে, তেমনি তার প্রচণ্ড রূপ ছড়িয়েছে আতঙ্কও। পদ্মার ইলিশ, পদ্মার ঢেউ যেমন বাঙালি রোমান্টিকতার অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে রয়েছে, তেমনি দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় তিন কোটি মানুষের অসংখ্য দুঃখ-বেদনার সঙ্গীও এই পদ্মা।
রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পদ্মা যে পার হতেই হবে। জীবন-জীবিকাই শুধু নয়, নদী পার হয়ে ঢাকায় আসে অসংখ্য রোগী, বিপদগ্রস্ত মানুষ। যাত্রীবাহী বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কারের পাশাপাশি এই নৌপথের অন্যতম যান মালবাহী ট্রাক। এই বিপুল পরিমাণ যানবাহনের জন্য নদী পারাপারের ভরসা মাত্র কয়েকটি ফেরি। কেউ কেউ লঞ্চ, স্পিডবোট আর ট্রলারে করেও পাড়ি দেন পদ্মা। ভরা বর্ষা কিংবা শীত— দুই মৌসুমেই তাই নদীপথে চলাচলে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। কখনো পানিতে ডুবে যায় ফেরির পন্টুন, কখনো ভাঙতে থাকে পদ্মার কূল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যান্য যানবাহনে পার হতে গিয়ে জীবন দেয় অসংখ্য মানুষ।
আবার শীতে এখানে সেখানে জেগে ওঠা চর বাচিয়ে চলতে বেগ পেতে হয় ফেরি থেকে শুরু করে বড় বড় লঞ্চকেও। ফলাফল নদীর দুই তীরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ির সার। ছোটবড় মানুষ টানা গাড়িতে রোদে-বৃষ্টিতে আর ক্ষুধায় কষ্ট পায় আদম সন্তান, অন্যদিকে পচন ধরে ট্রাকভর্তি কাঁচাপণ্যে। দক্ষিণাঞ্চলের উৎপাদিত তাজা শাকসবজি, ফলমূল আর মাছ-মাংস বিক্রির জন্য ঢাকাসহ দেশের অন্য অঞ্চলে পাঠানো যেন ব্যাবসায়ীদের জন্য আলাদা চিন্তার। ঠিকঠাক ফেরি পার হতে পারবে তো— আশঙ্কা যেন যায় না!
কোনো জরুরি প্রয়োজনে ঢাকায় আসতে চাইলেও নিতে হতো জীবনের ঝুঁকি। কারণ, ফেরির অনিশ্চয়তা। ঈদ কিংবা অন্যান্য পালা-পার্বণে গাড়ির শিডিউল মিস হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। জন্মাবধি ওই এলাকার মানুষ জানে, ঢাকা অনেক দূর। যেমন আমার জন্মস্থান নড়াইল থেকে ঢাকার দূরত্ব যশোর হয়ে গেলে গাবতলী থেকে ২৯৩ কিলোমিটার, মাওয়া হয়ে গেলে যাত্রাবাড়ী থেকে মাত্র ১৪০ কিলোমিটার। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে গেলে কোনো পথেই পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু ঈদুল ফিতরের ছুটিতে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগেছে ঢাকা-নড়াইল দূরত্ব পার হতে। আর এই অঞ্চলের মানুষ ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরতে কিংবা বাড়ি থেকে ঢাকা যেতে পথে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা থাকার প্রস্তুতি নিয়েই ঘর থেকে বের হন। অবর্ণনীয় কষ্ট আর দুর্ভোগের সেই অপেক্ষা। বিশেষ করে রাতের ভ্রমণে নিরাপত্তা নিয়ে আলাদা চিন্তা লেগেই থাকে।
ফেরি থেকে অনেক দূরে অপেক্ষমাণ অবস্থায় সারাক্ষণ ডাকাত কিংবা চুরির আতঙ্ক ঘিরে থাকত। দীর্ঘ এই অপেক্ষার সময়ে পর্যাপ্ত খাবার দোকান বা বাথরুমের ব্যবস্থাও ছিল না। খাবারের দোকান শুরুই হয় ঘাটের খুব কাছাকাছি। ফলে অসুস্থ, বয়স্ক, নারী ও শিশুদের পড়তে হয় অতিরিক্ত সমস্যায়। ফেরির অনিশ্চয়তা নিয়ে সপরিবারে দুর্ভোগ পোহানোর অভিজ্ঞতা তো আমারও কম নয়। আট বছর আগে এই ডিসেম্বর মাসেই হার্ট অ্যাটাকের পরে হার্ট ফেইলিওর হয়ে যাওয়া আমার আব্বুকে জরুরিভিত্তিতে ঢাকায় নিয়ে আসতে হয়। অ্যাম্বুলেন্স থাকায় সবাই অগ্রাধিকারভিত্তিতেই এগিয়ে দেয়। কিন্তু তবুও শুধু নদী পার হতেই অন্তত ঘণ্টাদুয়েক লাগেই। একটু একটু করে হাতের মধ্যে অসুস্থ পিতাকে নিস্তেজ হতে দেখার সেই অসহায়ত্ব কখনোই ভোলার নয়। শুধু মনে হচ্ছিল, কবে পার হব ঘাট, কখন পৌঁছাতে পারব একটা হাসপাতালে।
প্রমত্ত পদ্মার সামনে অসহায় আত্মসমর্পণের এরকম অভিজ্ঞতা আমার মতো এই অঞ্চলের অনেকেরই আছে। কারণ, দিনের শেষে মৃত্যুপথযাত্রীকে বাঁচানোর জন্যও আমাদের ঢাকা অভিমুখেই দৌড়াতে হয়। আশা করা যায়, পদ্মাসেতু আমাদের এমন অনেক আক্ষেপ আর অসহায়ত্ব ঘুচিয়ে দেবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাওয়ায় বদলে যাবে আমাদের অঞ্চলের কোটি মানুষের জীবন। অসহায় সন্তানকে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে মা-বাবার থেমে যেতে থাকা নিঃশ্বাসের সাক্ষী হতে হবে না। একটানে চলে আসা যাবে রাজধানীতে অথবা নিজের এলাকাতেই পাওয়া যাবে কাঙ্ক্ষিত সেবা।
পদ্মাসেতুর শেষ স্প্যান বসানো দেখতে একঝাঁক সাংবাদিকের সঙ্গে পদ্মার বুকে ভেসেছিলাম চার ঘণ্টার কিছুও বেশি সময়। সঙ্গী ছিল ট্রলারমালিক বছর সাতাশের আজিজুল ইসলাম। পদ্মাপাড়েরই মানুষ। বাড়ি মাওয়া চৌরাস্তা। ছোটবেলা থেকেই নদী টানত তাকে। ছিলেন দর্জি, পরে কাজ করেছেন পদ্মাসেতুর শ্রমিক হিসেবে। আবার নৌকা নিয়ে জীবিকার খোঁজে ফিরেছেন পদ্মার বুকেই। জানালেন, মাস তিনেক হলো কিনেছেন এই ট্রলারটি। এর আগে টানা সাত বছর কাজ করেছেন পদ্মাসেতুতে, পিলার বসানোর কাজ। সেই কাজ শেষ হয়ে যেতে না যেতেই শুরু কলো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। কোথাও কিছু করতে না পেরে ট্রলার কিনে হয়েছেন পদ্মা নদীর মাঝি।
আজিজুল ইসলাম বলছিলেন, মাসে প্রায় হাজার ১২ টাকা আয় হয়। শুক্র-শনিবার ভিড় বেশি থাকে। অন্যান্য দিন তুলনামূলকভাবে কম। সেতু চালু হওয়ার পর এই জীবিকাতে ভাটা পড়ার আশঙ্কা আছে কি না— জানতে চাই আজিজুলের কাছে। তার উত্তরেও ইউসুফ ব্যাপারীর কথার প্রতিধ্বনি। বলেন, আমাদের নদীতে এরকম একটা ব্রিজ হচ্ছে— এর চেয়ে আনন্দের কিছু নাই। অন্য কিছু করতে হলে করব, কিন্তু এই সেতু চালু হলে সেই আনন্দের কোনো তুলনা হয় না।
ইউসুফ ব্যাপারী বা আজিজুল ইসলামের মতো মানুষগুলো নিশ্চিতভাবে না জানলেও অনুধাবন করতে পারেন, কতটা সম্ভাবনার এই সেতু। ঘাটপাড়ের মানুষ তারা। প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই বেড়ে ওঠা। তাই আজন্ম চেনা সেই খরস্রোতা পদ্মার বুকে রামধনুর মতো বাঁকা ব্রিজটা নতুন স্বপ্নের পথ দেখায় আজিজ-ইউসুফকে। এই পদ্মাকে শাসন করে তার বুকে এত বড় ব্রিজ যখন করা গেছে, তখন তারাও নতুন দিনের সন্ধান করে নতুন করে জীবন সাজাতে পারবেন— এমনই আত্মবিশ্বাস তাদের।
ছোটবেলা থেকেই ফেরি পারাপারের সময় পদ্মার তীর দেখার আশায় বসে থাকতাম। বর্ষাকালে দোয়া-দরুদ পড়া বেড়ে যেত সবার। মাইলের পর মাইল মেঘের মতো ভেসে থাকা পানি দেখলে একদিকে বুক জুড়িয়ে যেত, অন্যদিকে থাকত সমীহমাখা ভয়। যদি ডুবে যাই, ভেসে তীর পর্যন্ত যেতে পারব তো! শেষ হতে যাচ্ছে সেসব আনন্দ, আতঙ্ক আর স্মৃতিঘেরা দিন। একটানে পৌঁছানো যাবে বাড়ি। কিছুটা পুরনো দিনের মায়া জাগলেও আকূল পদ্মার বুকে দুইপাশ দেখা না যাওয়া বাঁকানো ইস্পাতের সেতুটা দেখে ঠিক বর্ষার আকাশে ঝুলে থাকা রঙধনু বলে ভ্রম হয়। ওই সেতু দিয়ে শাঁ শাঁ করে বাড়ি যাওয়ার কথা কল্পনা করলেই কেমন এক রোমাঞ্চ ছুঁয়ে যায় মনকে।
লেখক: সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, সারাবাংলা ডটনেট