ছিনতাইকারীর অবাধ দেশে নিরুপায় মায়ের কথা
১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৭:০৬
মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর
সকালে বার্তাকক্ষে বসে ছিলাম। বার্তাকক্ষ একটা আজব জায়গা। এখানে বসে থাকলে নিউজ না পাওয়া গেলে জীবন বৃথা মনে হয়। আর শুনতে যতই খারাপ শোনাক- ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ সেই তত্ত্বে সংবাদকর্মীরা খুবই বিশ্বাসী। বার্তাকক্ষে একটা খারাপ খবর পৌঁছালে একটা উত্তেজনাও কাজ করে। আর আমাদের কাছে নিউজ বলতে যা আসে তা ভালো কিছুর চেয়ে মন্দেরই বেশি হয়।
সোমবার ১৮ ডিসেম্বর সকালে শিফটে নিউজরুমে বসেছিলাম। দৈনিক কর্মসূচিতে কাজের সংখ্যা খুবই কম। হঠাৎ একজন প্রতিনিধির ফোন এলো। খবরের সমাগমে আমরা সহকর্মীরা আকর্ণ দন্ত বিকশিত হাসি দিলাম। খবর হিসেবে যুতসই। ছিনতাইকারীর হামলায় এক শিশু নিহত।
কিন্তু নিমেষেই উত্তেজনাটি হারালো কষ্টের অনুভবে। হাজার হোক মানুষতো বটে আমরা সংবাদকর্মীরা। জানা গেলো, ছিনতাইকারী হামলা চালিয়েছিল রিক্সাযাত্রী এক নারীর ওপর। তার কোলে ছিলো ছোট্ট ছয়মাসের শিশুপুত্র। শীতের সকাল। বুঝি নিজের হাতব্যাগ নিয়ে শিশুকে পেঁচিয়ে রেখে বসেছিলেন। ছিনতাইকারীরা তার ব্যাগটি ধরে টান দিয়েছে। আর সেই হ্যাঁচকা টানে শিশুটিকে কোলে নিয়ে মা ছিটকে পরে যান নিচে। শিশুটি ছিটকে পড়ে একদিকে। ছোট্ট কোমল শরীর সে আঘাতের ধকল নিতে পারেনি। ফলে মরেই গেলো।
https://youtu.be/VdnPp98_sPI
হাসি উবে গেলো এমন খবরে। জগতের এক রূঢ় সত্য জেনে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো শিশুটি। সে জানলো এ পৃথিবী নষ্টদের, এই পৃথিবী দুর্বৃত্তদের। তার গ্রাম্য, সরল, দরিদ্র মা এই সত্যের কাছে নিরুপায়! একজন মা হিসেবে জানি এই মায়ের এখন বেঁচে থাকা কতটাই কষ্টের হবে।
ছিনতাইয়ের ঘটনা আমরা অহরহ শুনি, জানি। এ মাসেই শুরুর দিকে একজন চিকিৎসক ছিনতাইকারীর টানে পরে গিয়ে মারা গেলেন। প্রতিদিন এরকম অগণিত মানুষ ছিনতাইয়ের কবলে পড়ছেন, কতগুলো আমরা জানি? শুধু যখন চূড়ান্ত খারাপ খবরটা হয় তখনই এই খবরগুলো আমাদের সামনে আসে। সে গল্পও কত কষ্টের! সেই যে এক নববিবাহিতা, তার যোগ দেওয়ার কথা বিসিএস ক্যাডারে, ছিনতাইকারীর টানে পড়ে গিয়ে যে আঘাত পান তা বদৌলতে আজও সে জড় পদার্থ হয়ে পড়ে আছে। তার স্বামী স্বাভাবিক জীবন ত্যাগ করে এখন পাথর হয়ে যাওয়া স্ত্রীর সেবা করে দিন কাটাচ্ছেন। এই অসীম ভালোবাসা ছুঁয়ে যায় না এক টানে অনুভূতিহীন হয়ে যাওয়া সে পাথর মানুষকে!
অথবা সেই ব্র্যাক ব্যাংকে চাকরি করা সেই ছেলেটির যার বাগদান হয়েছিল? বিয়ের কদিন আগেই একটা টানে চলে গেল তার জীবন। একটা ব্যাগের ফিতার সাথে হেঁচড়ে গেলো তার শিক্ষা, তার ভবিষ্যত, তার মধ্যে থাকা সম্ভাবনা।
পুরাতন গল্প খুঁজতে গেলে এমন অগণিত গল্প মিলে। শুধু এসব ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার, বিচারের সংবাদ তেমন চোখে পড়ে না।
আমি যখন মাস ছয়েকের গর্ভবতী, একদিন বইমেলা থেকে ফেরার পথে মিন্টো রোডে আমার ব্যাগ টান পরল। আমার হাতে ব্যাগটা আলগা করে ধরা ছিল, ব্যাগ চলে গেলো, আমার জীবন বেঁচে গেলো। আজও এই স্মৃতি আমাকে তাড়া করে ফিরে, কী হতো সেদিন যদি আমি পড়ে যেতাম? আমার সন্তান আমাকে ছেড়ে চলে যেতো?
একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি জানি একটা নিউজ হওয়া ছাড়া আর কোনো পরিবর্তনই আসতো না। এই সংবাদ হওয়া এতই স্বাভাবিক যে একে পরিবর্তনও বলা যায় না!
আমি জানি না আরাফাতের মা কীভাবে সামনের দিনগুলো কাটাবে, এই অনুভূতি এতই নিষ্ঠুর যে তা ভাবার কষ্টেও যেতে চাইবো না। নিরাপদ জীবনে বসে একজন সন্তান হারানো মায়ের কষ্ট অনুভব করার চেষ্টা শুধুই একটি কল্পনা। কল্পনায় বাস্তবতাকে ভোগ করতে হয় না। স্বপ্নে কিল খেয়ে ঘুম ভাঙলেও ব্যথা পিঠে কুঁকড়ে বসে থাকতে হয় না। আর এটা থাকতে হয় না বলেই কেউ দৌড়ে যায় না এই ছিনতাইকারীদের ধরতে, তাদের বিচারের সম্মুখীন করতে, তাদের টুঁটি চিপে ধরতে।
বেলা বাড়লে আরাফাতের মা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে এমন একটি ভিডিও ফুটেজ নিউজরুমে এসে পৌঁছে। ঢাকার বাইরে থেকে বড় পুত্রের চিকিৎসার জন্য আসা এই মা জানতেন ঢাকা সব সম্ভবের শহর, এখানে উচ্চ চিকিৎসা হয়, দুরারোগ্য রোগের আরোগ্য হয়। গ্রাম্য এই নারী ছোট পুত্রের জীবন দিয়ে জানে এ শহর শুধু সব সম্ভবের নয়। এটা একটা অসম্ভবেরও শহর। এখানে সামান্য ছিনতাইকারীদের প্রতিহত করা কারো পক্ষে সম্ভব হয় না।
সারাবাংলা/এমএ/এমএম