বাস্তবিকই এরকম হয়, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। বাঙ্গালি জাতিসত্ত্বার আরেকটু বেশিই হয়। তার মানে আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি ধীর লয়ে কাজ করে। অথচ ষড়যন্ত্র, কূটবুদ্ধি আর কুটচাল কাজ করে ত্বরণ বেগে।
তেপ্পান্ন বছরে আমাদের অনেক কিছু ছিনতাই হয়ে গেছে, চুরি হয়ে গেছে, ডাকাতি হয়ে গেছে। কখনো আমরা মোছে তা দিয়ে তন্দ্রালু ছিলাম, কখনো দেখে দেখে মজা নিচ্ছিলাম এই ভেবে যে, দেখি শালা কি করে? এই এই করে খেলারামরা খেলে গেছে আর আমরা হেলাফেলা করে দেখেই গেছি। ফলত সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর এর জন্য যারা দায়ী তারা দলে ভিন্ন, মতে বিপরীত হলেও আচরণে অভিন্ন। তারা ব্যাট হাতে মারকুটে ব্যাটসম্যান অতিশয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো এরা যতই পরস্পরের শত্রুভাবাপন্ন হোক না কেন নিপাতনে সিদ্ধর মত একে অপরের অপকর্মের দায়মুক্তি দাতা। পাবলিক এখানে দর্শক মাত্র।
জুলাই বিপ্লব এসব ছলচাতুরী থেকে মুক্ত হওয়ার একটা সুবর্ণ সুযোগ আমাদের করে দিয়েছিলো। কিন্তু কিছু বয়ষ্ক পদস্থের দ্বিচারিতা আর কুটকৌশলের কাছে অমিততেজা অনভিজ্ঞ তরুণরা ইনিংস শুরু করার আগেই একে একে ডাক আউট হয়ে বড় ইনিংস গড়ার স্বপ্ন ধুলিস্মাৎ করে দিয়েছে। দোষ তরুনদের না। তাদেরকে পরিচালনাকারী যেসব পদস্থ বকধার্মিকরা সম্ভাবণার কথা বলতেন, পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখাতেন, দোষ ও অপরাধ তাদের। অথচ সময় গড়ানোর সাথে সাথে তরুনদের ইমেজ হয়েছে ম্লান আর ঘাপটি মেরে থাকা সুবিধাবাদী পদস্থরা পাবলিককে হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট দেখিয়ে বিপ্লবের স্পিরিটকে ঘুম পাড়ানী ইঞ্জেকশন দিয়ে অকার্যকর করে রেখেছে। দিকভ্রান্ত তরুণের দল ইতিউতি যাতায়াত করছে, তাদের নাম ধরে কেউ কেউ অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। কলকাতা হারবালে উত্তেজিত মিডিয়া এগুলোকে আকারে প্রকারে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমন আবহ তৈরি করছে যাতে মনে হবে দেশে বিপ্লবের নামে যাচ্ছেতাই হচ্ছে। যার অপর অর্থ দাঁড়ায় : আগেরটাই ভালো ছিলো।
৫ আগষ্টের পর কার্যত কয়েকদিন কোন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ ছিলো না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিগত রেজিমের হেভিওয়েট যোদ্ধারা দলে দলে ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেছে নির্বিঘ্নে। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ না থাকতে পারে কিন্তু সরকারের স্থায়ী প্রশাসনিক কাঠামো তো ছিলো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছিলো, সচিব ছিলো, আমলাতন্ত্র ছিলো, ইমিগ্রেশনের পদস্থরা ছিলো, গোয়েন্দা এজেন্সির সরকারি বেতনভুকরা ছিলো, অন্যান্য এজেন্সি, দপ্তরের লোকজনও তো ছিলো। তারা কি করেছে? তাদের দায়িত্ব কি শুধু রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা বাস্তবায়ন? এই কয়েকদিনে যারা সীমানা পেড়িয়ে গেছে, এরপরেও গেছে তাদের এই নিরাপদ পগার পার হওয়ার দায় কার? কাউকে কি অভিযুক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে? বরং আমলাতন্ত্রের পদস্থরা ঘুটু করেছে, ইন্ধন দিয়েছে, নিষ্ক্রিয় থেকে এমন একটা চিত্র পোর্ট্রেট করেছে যে, আগেরটাই ভাল ছিলো। বর্তমানে যারা আছে তারা অদক্ষ ও দুর্নীতির পথে নিমজ্জিত। অথচ ৫ আগষ্টের পর সেইসব হেভিওয়েটদের ব্যাংক হিসাব ব্লক করা উচিত ছিলো, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ সাময়িকভাবে বাজেয়াপ্ত করার দরকার ছিলো। ইমিগ্রেশনে রেড ফ্ল্যাগ পাঠানো উচিত ছিলো। কেন করা হয় নি? ইচ্ছে করেই? নাকি চৈতন্য ছিলো না? এখন অসময়ে এসে তা করা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে একেকজনের করা হাজার কোটি টাকার ট্রাঞ্জেকশনের ব্যালান্স এখন মাত্র হাজার টাকার ঘরে। ৫ আগষ্টের পর এই টাকা কারা কার মাধ্যমে কি পদ্ধতিতে তুলে নিলো বা কোথায় ট্রান্সফার করলো তার কি কোন হদিস আছে? ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে, মানি ল-ারিং ঠেকাতে অনেক কমিটি ছিলো, এখনো আছে। আছে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। কেউ কিছু করেনি। সবাই চুপ মেরে সময় ক্ষেপণ করেছে আর অপকর্মের হয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছে নাহয় ভাগিদার হয়েছে। অথচ এদের কারো বিরুদ্ধে কিছু হয়েছে কিনা কেউ জানে না।
আগের সেই আস্থাভাজনদের দিয়ে প্রশাসন চালানোর মন্ত্র কে দিয়েছে জানা না গেলেও সরকারের কোর গ্রুপে থাকা এক প্রাক্তন আমলা যে ঘুটু করেছে তা নিয়ে পাবলিকের কোনই সন্দেহ নেই। ৫ আগষ্টের পরে যাদেরকে তড়িঘড়ি করে প্রশাসনে চুক্তিতে নিয়োগ করা হয়েছে তারা প্রশাসনে সুপরিচিত, দক্ষ সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা চেয়ার টেনে বসে পড়ার পর তাদের খুব কাছের বার্ধক্যের ভারে ন্যুব্জ ও অনুরক্ত ভক্তদের সুবিধাজনক জায়গায় বসিয়ে অন্যদের পদায়নের সকল পথ সীল গালা করে দিয়ে আজকের যে প্রশাসন উপহার দিয়েছেন এর দায় তাদেরকেই বহন করতে হবে। ক্ষমতা চিরকাল থাকেনা- এ কথা ক্ষমতায় থাকার সময় মনে থাকে না। কিন্তু ক্ষমতা শেষে কী দশা হয় তা বোধকরি এখন আর কাউকে বলে বুঝাতে হবে না। তাদের কৃত অপরাধ ও অনৈতিক পদক্ষেপের একদিন পোস্টমর্টেম হবেই।
পুলিশেও একই দশা। পুলিশকে এখনো সাজানো যায় নি। সিংহভাগ পুলিশের রাজনৈতিক আনুগত্য ও মনস্তাত্তিক গঠন গেল রেজিমের অনুগামী। এদের দিয়ে কতটুকু কী করা যাবে তা সত্যিই ভাবনার বিষয়। জাতির দুর্ভাগ্য যে, প্রশাসন ও পুলিশ জনগণের বিপরীতে একটা বিশেষ শ্রেনীর লাঠিয়াল, কোতোয়াল, মোসাহেব ও ভৃত্য হিসেবে কাজ করেছে, এখনো সে বৃত্ত থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারছে না। কেউ কেউ ঘুন পোকা হয়ে কাজ করে যাচ্ছে নিরবে, অবিরত। গেলো রেজিমের ডাকসাইটে একজন মহিলা মিডিয়া কর্মীকে কারওয়ান বাজার থেকে পাবলিক ধরিয়ে দিলো। থানা কার নির্দেশে চিরচেনা পথে মুচলেকা নিয়ে তাকে সসম্মানে বাড়িতে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করে দিলো জানা যায় নি। বেশ কিছুদিন পর জানা গেলো তার কথিত স্বামীর একাউন্টে কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন পাওয়া গেছে। ব্যস, পাবলিক এই পর্যন্তই জানে। কলকাতা হারবালে উজ্জীবিত মিডিয়া আর এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। কেন করে নি?
পাবলিক সব বুঝে। ধরে ধরে বাইরে থেকে শিল্পকলা সহ অন্যান্য দপ্তরে এমনকি সর্বোচ্চ পরিষদেও যাদের নিয়োগ দেওয়া হলো বা হচ্ছে তারা কার বা কাদের রেফারেন্সে নিয়োগপ্রাপ্ত তা জানা না গেলেও হোয়াইট কালার কিছু শিক্ষিত ও পদস্থ যে এর অনুঘটক তা বুঝতে কষ্ট হয় না। ছাত্রদের অভিভাবক হিসেবে যারা ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়েছেন তারা তাদের সাথে সংযোগ পরিত্যাগ করে এখন অতিথির মত আচরণ করছে। তাই, অভিভাবকহীন এসব তরুণরা হয়েছে দিকভ্রান্ত, অনেকে অপকর্মে লিপ্ত, বাকিরা হতাশাগ্রস্ত। কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবিরা প্রকাশ্যে না এলেও অস্তমিত আলোর পুনরাগমনের স্বপ্নে বিভোর আর নেপথ্যে জাল বুননে সতর্ক।
সর্বত্র এখন ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’র দৃষ্টান্ত সহনীয় হয়ে যাচ্ছে। এর মানে আমাদের কারো কোন দায় নেই। যারা চেয়ারে আসীন তারা তাদের হায়ার ম্যাথ নিয়ে ব্যস্ত। যারা সরকারের নির্বাহক তারা টাইম পাস করছেন, গুটি নাড়ছেন আর ‘জো আপসে আতা হ্যায় ও হালাল হ্যায়’ পদ্ধতিতে ইনিংসটা বড় করার কাজে ব্যস্ত। কথা ছিলো জুলাই বিপ্লবের সনদ হবে। হয় নি। এখন আবার চাপের মুখে এ নিয়ে উচ্চপর্যায়ে নাড়াচাড়া হচ্ছে। কদ্দুর কি হবে তা আগামীতেই দেখা যাবে। বিভিন্ন কমিশন করা হয়েছে। তারা তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। সেটার কি গতি হবে জানি না। এসব কমিটির বেশিরভাগ সদস্যই উচ্চশিক্ষিত ও যার যার কর্মক্ষেত্রে কর্মবীর। কিন্তু এরাই তেপ্পান্ন বছরে পালাবদলে সরকারি বৃষ্টি দেখে ছাতা ধরেছে। অথবা নেপথ্যে নিজেদের এজে-া বাস্তবায়ন করেছে। কয়েকজন ছাড়া এদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা কম।
মোটকথা, বিপ্লবোত্তর একটা সমাজ, দেশ, প্রশাসন যেভাবে ঢেলে সাজানো উচিত ছিলো, যেভাবে চলা উচিত ছিলো তা মোটেই দৃশ্যমান হয়নি। এখন শুধু এক এক করে দেখার পালা চোর পালালে বুদ্ধি কীরূপ বাড়ে? আসলে এগুলো অজুহাত, ছুঁতা। আগের রেজিমের নষ্ট, ভ্রষ্টদের কর্ম। এগুলোকে হাল্কা করে দেখার কোন সুযোগই নেই। হয়ত মহামান্যের মত আরো কেউ পরম ছায়াতলে দেশান্তরি হয়ে যাবে। আবার কিছু হৈচৈ হবে। আবার শক্তিশালী তদন্ত কমিটি হবে। তারা কি রিপোর্ট দেবে তা জনগণের জানার সুযোগ নেই, অধিকারও নেই। এরপর আর কিছু জানা যাবে না। জানা গেলেও আইওয়াশ গোছের কিছু নিম্নপদস্থ এর শিকার হবে আর পদস্থ কয়েকজন হাওয়া বদলের মত এক গ্রহ থেকে আরেক গ্রহে বদলি হবে। একই খেলা চলছে হরদম। ইদানীং রফিকুল আলমের গাওয়া এই গানের কথাই কেবল মনে পড়ছে। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।
লেখক: কলামিস্ট