Saturday 24 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডিজিটাল শোকের সমাজতত্ত্ব

ড. মতিউর রহমান
২৪ মে ২০২৫ ১৬:০৫

আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে শোক প্রকাশ ও প্রিয়জনকে স্মরণ করার পদ্ধতিগুলো এক নতুন রূপ নিচ্ছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো শুধু বিনোদন বা যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং শোক প্রকাশ, স্মৃতিচারণ এবং শোকের আচার-অনুষ্ঠান পালনের ডিজিটাল মঞ্চে পরিণত হয়েছে। এই রূপান্তর সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আবেগপ্রকাশ নয়, বরং আমাদের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ এবং সামাজিক বন্ধনকেও নতুনভাবে গড়ে দিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

প্রথাগতভাবে, শোক প্রকাশ একটি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রক্রিয়া ছিল, যেখানে ধর্মীয় রীতিনীতি, জানাজা বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং আত্মীয়স্বজনের সমাবেশের মাধ্যমে শোক পালন করা হতো। এসব শোকাচরণ আমাদের সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করত এবং মানসিক সমর্থন জোগাত। কিন্তু ডিজিটাল যুগে, মানুষ বাস্তব সমাজ থেকে অনেকাংশে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভার্চুয়াল জগতে আবেগ প্রকাশ করছে। এর ফলে শোক আর নিছক পারিবারিক বিষয় না থেকে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ফেসবুক শোক প্রকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। কোনো ব্যবহারকারীর মৃত্যুর পর তার প্রোফাইল একটি ‘মেমোরিয়াল পেইজ’-এ রূপান্তরিত হয়, যেখানে প্রিয়জনরা ছবি, স্মৃতিচারণমূলক বার্তা এবং প্রার্থনা পোস্ট করে থাকে। ফেসবুকের ‘legacy contact’ এবং ‘memorialization settings’-এর মাধ্যমে প্রয়াত ব্যক্তির ডিজিটাল উপস্থিতি রক্ষার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই প্রোফাইলগুলো অনেক সময় মৃত ব্যক্তির সঙ্গে এক ধরণের মানসিক সংযোগ বজায় রাখতে সহায়তা করে, যদিও পুরনো স্মৃতি ফেসবুকের অ্যালগরিদমের মাধ্যমে হঠাৎ উঠে আসলে তা মানসিকভাবে আঘাতও করতে পারে।

ইনস্টাগ্রামে শোক প্রকাশের ধরন আরও ভিজ্যুয়াল। এখানে ছবি ও ক্যাপশন দিয়ে প্রিয়জনকে স্মরণ করা হয়। মোমবাতি, সূর্যাস্ত, সাদা গোলাপ বা প্রার্থনার প্রতীকগুলো ছবিতে তুলে ধরা হয়। এই পোস্টগুলো সৌন্দর্যের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশের এক নতুন রীতিতে পরিণত হয়েছে। তবে অনেকের মতে, এটি মাঝে মাঝে ‘পারফরমেটিভ’ বা লোকদেখানো হয়ে ওঠে, যেখানে শোক প্রকাশের পেছনে ‘লাইক’ বা মন্তব্য পাওয়ার একটি অদৃশ্য প্রতিযোগিতা কাজ করে।

টিকটক, তুলনামূলকভাবে নতুন এবং তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় একটি প্ল্যাটফর্ম, শোক প্রকাশের ক্ষেত্রে এক ভিন্ন রূপ দেখাচ্ছে। ব্যবহারকারীরা এখানে ছোট ভিডিওর মাধ্যমে নিজেদের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি এবং স্মৃতি প্রকাশ করে। অনেক সময় এসব ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায় এবং কমেন্টে দেখা যায় হাজার হাজার মানুষের সহানুভূতি, ভালোবাসা এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার। এতে একটি ভার্চুয়াল সমবেদনার নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে, যা ব্যবহারকারীদের একাকীত্ব কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সাহায্য করে।

ডিজিটাল শোক প্রকাশ একটি ভিন্ন ধরনের সময়-সচেতনতা তৈরি করছে। আগে শোককে ধাপে ধাপে কাটিয়ে ওঠার একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া হিসেবে ভাবা হতো—যার শেষ ধাপ ছিল গ্রহণযোগ্যতা বা ‘closure’। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই প্রক্রিয়া এখন অনবরত চলমান। কোনো একটি পোস্ট, ছবি, ভিডিও, অথবা পুরনো মন্তব্যে ফিরে গিয়ে মানুষ বারবার শোকের মুহূর্তে ফিরে যেতে পারে। এই ‘চক্রাকার শোক’ আমাদের শোকের ব্যাখ্যা ও অভিজ্ঞতাকে নতুন আকারে উপস্থাপন করছে।

ডিজিটাল শোকের আরেকটি দিক হলো সমষ্টিগত বা সম্মিলিত শোক। যখন কোনো জাতীয় নায়ক, সেলিব্রিটি বা সমাজের প্রভাবশালী কেউ মারা যান, তখন কোটি কোটি মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় শোক প্রকাশ করেন, হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেন এবং স্মৃতিচারণ করেন। এই ধরণের ঘটনাগুলোতে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটক একটি সামাজিক শোকমঞ্চ হয়ে ওঠে, যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ একত্রিত হয়ে আবেগ ভাগাভাগি করে।

বাংলাদেশে ডিজিটাল শোকের সংস্কৃতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ফেসবুক এখানকার প্রধান মাধ্যম। কারও মৃত্যুর খবর জানানো, কবরস্থানে যাওয়ার ছবি পোস্ট করা, ব্ল্যাক রিবন প্রোফাইল পিকচারে যোগ করা, এবং মৃত ব্যক্তির জীবনের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা এখন খুবই সাধারণ চর্চা। জাতীয় শোক দিবস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করা মানুষদের জন্যও সম্মিলিত শোক প্রকাশ এখানে জনপ্রিয়।

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম ইনস্টাগ্রাম ও টিকটককেও শোক প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে। টিকটকে দেখা যায়, কেউ কেউ নিজ পরিবারের সদস্যের মৃত্যুর পর কান্নাভেজা চোখে ভিডিও শেয়ার করছেন, কেউ স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো ক্লিপ আকারে প্রকাশ করছেন। ইনস্টাগ্রামে স্মৃতিচারণমূলক রিলস, ‘Rest in Peace’ হ্যাশট্যাগ এবং স্টোরিতে প্রার্থনার বার্তা এখন প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা।

তবে এর সঙ্গে কিছু সামাজিক ও নৈতিক প্রশ্নও উঠে আসে। মৃত ব্যক্তির সম্মতি ছাড়াই তার ছবি বা ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো শেয়ার করা কি নৈতিক? শোক কি ব্যক্তিগত না সামাজিক বিষয়? শোক প্রকাশ যদি সোশ্যাল মিডিয়ার রীতি ও জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভর করে, তবে কি তা সত্যিকারের আবেগের প্রতিফলন? এসব প্রশ্ন আমাদের সমাজে শোকের ভূমিকা ও ব্যাখ্যা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে।

এদিকে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে শোক প্রকাশের সহজলভ্যতা অনেককেই স্বস্তি দেয়। শহর থেকে গ্রামে, বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ—সবাই এখন এক ক্লিকে প্রিয়জনকে স্মরণ করতে পারে। এই নতুন আচার-অনুষ্ঠান আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ আবেগগুলোকে প্রযুক্তির ভাষায় প্রকাশ করার সুযোগ করে দিচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে, ডিজিটাল শোকের সমাজতত্ত্ব আমাদের দেখায় যে, শোক প্রকাশের রূপ পরিবর্তন হলেও আবেগ, ভালোবাসা ও স্মৃতির গভীরতা একই থেকে যায়। প্রযুক্তি আমাদের শুধু সংযুক্তই করছে না, বরং আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চা, মূল্যবোধ এবং শোকের নীতিকে নতুনভাবে গঠন করছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো এখন শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং স্মৃতি রক্ষার পবিত্র স্থান, যেখান থেকে নতুন প্রজন্ম তাদের শোক ও ভালোবাসা প্রকাশ করতে শিখছে।

এই পরিবর্তনকে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, প্রযুক্তি আর আবেগ একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে শোক ও মৃত্যুর ধারণা আরও কীভাবে রূপান্তরিত হবে, তা সময়ই বলবে। তবে এটা নিশ্চিত, ডিজিটাল যুগের এই শোকচর্চা আমাদের মানবিক অভিজ্ঞতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠেছে, যাকে আর উপেক্ষা করা যায় না।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

সারাবাংলা/এএসজি

ড. মতিউর রহমান ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

ওয়ালটন'এ কাজের সুযোগ
২৪ মে ২০২৫ ২০:২০

আরো

সম্পর্কিত খবর