Friday 30 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডিজিটাল সামন্ততন্ত্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবসান

ড. মতিউর রহমান
২৭ মে ২০২৫ ১৫:৪০

একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে আমরা এক অভাবনীয় অর্থনৈতিক রূপান্তরের সাক্ষী হয়ে চলেছি। এই পরিবর্তনকে প্রথম দৃষ্টিতে পুঁজিবাদের স্বাভাবিক বিবর্তন বা সম্প্রসারণ বলে মনে হলেও, গ্রিক অর্থনীতিবিদ এবং প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারুফাকিস একে এক ভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন – ‘প্রযুক্তিসামন্ততন্ত্র’ (Technofeudalism)। তাঁর বিশদ বিশ্লেষণে, এই নতুন ব্যবস্থায় চিরাচরিত বাজার অর্থনীতির মূলনীতিগুলি ক্রমশ অকার্যকর হয়ে পড়ছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলি, যেমন – গুগল, অ্যামাজন, মেটা (ফেসবুক), অ্যাপল এবং মাইক্রোসফট – শুধুমাত্র পণ্য বা সেবার পরিসর হিসেবে কাজ করছে না, বরং এগুলি নিজেরাই এক প্রকার নতুন ‘এস্টেট’ বা ‘জমিদারি’তে পরিণত হয়েছে। এই ব্যবস্থায় মুনাফা অর্জনের প্রধান উপায় পণ্য বা সেবার সৃজনশীল বাণিজ্য নয়, বরং প্ল্যাটফর্মের একচ্ছত্র মালিকানার জোরে ব্যবহারকারী এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক সত্তার কাছ থেকে নিয়মিত ‘ভাড়া’ বা ‘খাজনা’ আদায় করা। এই ভাড়া তথ্যের আকারে, মনোযোগের আকারে, অথবা সরাসরি আর্থিক কমিশনের মাধ্যমে আদায় করা হচ্ছে, যা পুরাতন সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার ভূমি-ভিত্তিক খাজনা আদায়ের সঙ্গে তুলনীয়।

বিজ্ঞাপন

মার্কসীয় শ্রেণি তত্ত্বের নিরিখে দেখলে, পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোয় মূলত দুটি প্রধান শ্রেণির উদ্ভব ঘটে: উৎপাদনের উপকরণের মালিক ‘বুর্জোয়া শ্রেণি’ এবং নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রি করে জীবনধারণকারী ‘প্রলেতারিয়েত শ্রেণি’। এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক পুঁজিবাদের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু ভারুফাকিসের মতে, প্রযুক্তিসামন্ততন্ত্রের এই নবযুগে প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিকের চিরাচরিত সংজ্ঞা এবং অবস্থান আরও জটিল, অস্পষ্ট এবং বহুলাংশে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখানে শ্রমিক কেবল তার নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার শ্রম বিক্রি করে না; তার প্রতিটি ডিজিটাল পদচারণা – যেমন ক্লিক, স্ক্রোল, লাইক, শেয়ার, পোস্ট, কমেন্ট এবং পণ্যের বা সেবার মূল্যায়ন (রিভিউ) – বিনামূল্যে মূল্যবান ‘তথ্য ও আচরণগত উপাত্ত’ (behavioral data) তৈরি করে। এই উপাত্তই গুগল, অ্যামাজন, মেটা, অ্যাপলের মতো বৃহৎ ডিজিটাল কর্পোরেশনগুলির কাছে অপরিমেয় লাভের খনি। এই অদৃশ্য ‘শ্রমের’ বিনিময়ে সাধারণ ব্যবহারকারীরা কোনো প্রত্যক্ষ আর্থিক মজুরি পান না। বরং, তারা এক ধরনের ডিজিটাল ‘ভূ-স্বামী’র অধীনে কার্যত বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে চলেন, যেখানে সমস্ত নিয়ম-কানুন, সুযোগ-সুবিধা নিয়ন্ত্রিত হয় জটিল ও দুর্বোধ্য ‘অ্যালগরিদম’ দ্বারা, যার স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতা প্রায়শই অনুপস্থিত।

বিজ্ঞাপন

শিল্পবিপ্লবোত্তর পুঁজিবাদী যুগে মধ্যবিত্ত শ্রেণি – যার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন সরকারি ও বেসরকারি চাকুরিজীবী, বিভিন্ন পেশাজীবী (যেমন ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিক্ষক), ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় – অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক স্থিতিশীলতার এক অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে পরিগণিত হতো। এই শ্রেণি একদিকে যেমন উদ্ভাবন ও প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করত, তেমনই অন্যদিকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করত। কিন্তু প্রযুক্তিসামন্ততন্ত্রের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনে এই গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণিটি ক্রমশ তার শক্তি, স্বাতন্ত্র্য এবং দৃশ্যমানতা হারাতে বসেছে। তথাকথিত ‘গিগ ইকোনমি’র নামে বিশ্বব্যাপী যে কর্মসংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছে – যেমন উবার, লিফট, ফুডপ্যান্ডা, পাঠাও কিংবা ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মগুলি – তা বহুলাংশে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির ঐতিহ্যবাহী জীবিকার নিরাপত্তাকে কেড়ে নিয়েছে। এই প্ল্যাটফর্ম-নির্ভর কাজগুলি প্রায়শই অস্থায়ী, অনিরাপদ এবং স্বল্প আয়ের। এখানে কর্মীদের কোনো নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তা থাকে না, থাকে না সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের (যেমন – স্বাস্থ্যবিমা, পেনশন, সবেতন ছুটি) কোনো নিশ্চয়তা। তারা কার্যত পরিণত হচ্ছে এক আধুনিক ‘ডিজিটাল ভূমিদাসে’ বা ‘ডেলিভারি সার্ফে’, যেখানে তাদের কাজের শর্ত, মূল্যায়ন এবং এমনকি আয়ও নিয়ন্ত্রিত হয় সফটওয়্যার এবং অদৃশ্য অ্যালগরিদমের মাধ্যমে, যার বিরুদ্ধে তাদের দর কষাকষি বা প্রতিবাদের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই বৈশ্বিক রূপান্তর বিশেষভাবে গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার অনেক ইতিবাচক দিক থাকলেও, এর নেতিবাচক ও শোষণমূলক দিকগুলিও ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, এই ডিজিটাল রূপান্তর এক প্রকার প্ল্যাটফর্ম-নির্ভর দাসত্বের জন্ম দিচ্ছে। দেশের লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী ফ্রিল্যান্সার হিসেবে Fiverr, Upwork, Freelancer.com-এর মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলির মাধ্যমে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছেন। আপাতদৃষ্টিতে এটি আত্মকর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র মনে হলেও, এর গভীরে রয়েছে এক নির্মম বাস্তবতা। এই তরুণ ফ্রিল্যান্সাররা প্রায়শই এক অসম প্রতিযোগিতামূলক ‘বৈশ্বিক দরিদ্রতার খেলায়’ (race to the bottom) অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন, যেখানে কাজের মূল্য নির্ধারিত হয় বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে নয়, বরং প্ল্যাটফর্মের নিজস্ব অ্যালগরিদম এবং মুনাফা সর্বোচ্চকরণের নীতির দ্বারা। তাদের অর্জিত আয়ের সিংহভাগ প্ল্যাটফর্মের উচ্চ কমিশন এবং বিভিন্ন সার্ভিস চার্জের নামে কেটে নেওয়া হয়, ফলে তারা ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হন। অধিকন্তু, রাষ্ট্রযন্ত্র এই বিশাল ডিজিটাল শ্রমিক শ্রেণির শ্রম অধিকার, কাজের শর্ত এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অনেকাংশেই ব্যর্থ হচ্ছে বা উদাসীন থাকছে।

বাংলাদেশের ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবা, যেমন মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম, এবং বিভিন্ন মাইক্রোক্রেডিট অ্যাপ, একসময় আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং প্রান্তিক মানুষের কাছে ব্যাংকিং সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিষেবাগুলিও তথ্য-নির্ভর নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণের এক শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিগুলি এবং ডিজিটাল ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলি তাদের ব্যবহারকারীদের প্রতিটি আর্থিক লেনদেন, খরচের ধরণ এবং ব্যক্তিগত আচরণের বিশদ তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে এক ধরনের ‘ক্রেডিট স্কোর’ বা ঋণযোগ্যতার পরিমাপক তৈরি করছে। এই স্কোর ঋণ প্রাপ্তির যোগ্যতা, ঋণের পরিমাণ এমনকি সুদের হার নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অথচ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঋণগ্রহীতা বা ব্যবহারকারী জানেন না কোন কোন মানদণ্ডের ভিত্তিতে তাকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে, কিংবা এই মূল্যায়নের বিরুদ্ধে তার আপত্তি জানানোর কোনো স্বচ্ছ ও কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াও অনুপস্থিত। এটি এক অদৃশ্য সামাজিক নিয়ন্ত্রণের জাল তৈরি করছে, যা ব্যক্তির আর্থিক স্বাধীনতাকে সংকুচিত করছে।

শিক্ষা ক্ষেত্রেও প্রযুক্তিসামন্ততন্ত্রের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষত কোভিড-১৯ অতিমারীর পর থেকে অনলাইন শিক্ষার যে ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, তার সুযোগ নিয়ে অসংখ্য ‘এডটেক’ (EdTech) প্ল্যাটফর্ম আত্মপ্রকাশ করেছে। এগুলির অনেকেই শিক্ষাকে একটি বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করেছে। অনেক ক্ষেত্রে মৌলিক পাঠ্যসামগ্রী বা প্রাথমিক স্তরের কোর্সগুলি ‘ফ্রি’ বা বিনামূল্যে দেওয়া হলেও, গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা, বিশেষায়িত কোর্স, বা শিক্ষকদের নিবিড় তত্ত্বাবধান পাওয়ার জন্য ব্যবহারকারীদের উচ্চমূল্যের ‘প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন’ গ্রহণ করতে হচ্ছে। এর ফলে, দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা, যাদের পক্ষে এই অতিরিক্ত ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়, তারা উন্নতমানের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল বৈষম্য আরও প্রকট হচ্ছে। কর্পোরেট প্ল্যাটফর্মগুলি শিক্ষাকে মুনাফা অর্জনের একটি লাভজনক ক্ষেত্রে পরিণত করছে, যা মধ্যবিত্ত শ্রেণির জ্ঞানভিত্তিক আত্মনির্ভরতার ঐতিহ্যগত ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা এবং নতুন উদ্যোক্তা উদ্যোগগুলি ঐতিহ্যগতভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন ও অগ্রগতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু অ্যামাজন, আলিবাবা, এবং স্থানীয় পর্যায়ে দারাজ বা আজকেরডিলের মতো বৃহৎ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলির উত্থান এক নতুন ধরনের বাজার পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি খুচরা বিক্রেতারা তাদের ব্যবসার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কার্যত এই কর্পোরেট প্ল্যাটফর্মগুলির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। বিক্রেতাদের তাদের প্রতিটি বিক্রয়ের উপর একটি নির্দিষ্ট হারে কমিশন প্রদান করতে হয়, তাদের পণ্যের অনলাইন দৃশ্যমানতা (ranking and visibility) নির্ভর করে প্ল্যাটফর্মের জটিল ও অস্বচ্ছ অ্যালগরিদমের মর্জির উপর, এবং ক্রেতাদের সঙ্গে তাদের সরাসরি ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগও ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। এর ফলে, স্বাধীন উদ্যোক্তারা প্রকারান্তরে এই ডিজিটাল জমিদারদের অধীনস্থ ‘দালাল’ বা ‘এজেন্টে’ পরিণত হচ্ছেন, যেখানে তাদের ব্যবসার লাভজনকতা এবং স্থায়িত্ব উভয়ই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।

আবাসন খাতেও প্রযুক্তিসামন্ততন্ত্রের আগ্রাসনের ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। Airbnb-এর মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম বা স্থানীয় পর্যায়ে bikroy.com-এর মতো ক্লাসিফাইড বিজ্ঞাপনভিত্তিক অ্যাপের মাধ্যমে ব্যক্তিগত বাড়িঘর বা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দেওয়ার যে ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তা একদিকে যেমন অনেকের জন্য অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ তৈরি করেছে, তেমনই অন্যদিকে আবাসনকে একটি মৌলিক মানবিক প্রয়োজনের পরিবর্তে একটি ‘সম্পদে’ (asset) রূপান্তর করছে। এই ব্যবস্থায় বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভ অর্জনই মুখ্য বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সাধারণ মানুষের বসবাসের সুস্থিতি নয়। এর ফলে, বিশেষত শহরাঞ্চলে বাড়ির ভাড়া অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত আবাসন খুঁজে পাওয়া ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে।

তবে, এই নতুন ডিজিটাল সামন্ততন্ত্রের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিকটি হলো, এটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্য সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত থাকছে না, বরং এটি রাষ্ট্রশক্তি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। ক্লাসিক্যাল মার্কসীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী, রাষ্ট্রযন্ত্র মূলত পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষার একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তিসামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্র নিজেই বৃহৎ প্রযুক্তি কর্পোরেশনগুলির সঙ্গে এক ধরনের অংশীদারিত্বমূলক বা মিথোজীবী সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে। ডিজিটাল জাতীয় পরিচয়পত্র, বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ ও ট্র্যাকিং ব্যবস্থা, বিভিন্ন সরকারি ডিজিটাল পরিষেবা প্রদান – এই সকল ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র ক্রমবর্ধমানভাবে দেশি-বিদেশি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির সহায়তা ও পরিকাঠামোর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এর ফলে, সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত সংবেদনশীল তথ্য শুধুমাত্র রাষ্ট্রের কাছেই নয়, বরং বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির হাতেও চলে যাচ্ছে। এই তথ্যের সম্ভাব্য অপব্যবহার এবং এর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া জানানোর বা প্রতিকার পাওয়ার কোনো কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক পথ প্রায়শই উন্মুক্ত থাকছে না, যা নাগরিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য এক গুরুতর হুমকি।

তথাপি, এই চিত্র সম্পূর্ণ হতাশাব্যঞ্জক বা অপরিবর্তনীয় নয়। মানব ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক শোষণমূলক ব্যবস্থাও একসময় জ্ঞান-বিজ্ঞান, বাণিজ্য এবং বুর্জোয়া শ্রেণির সম্মিলিত উত্থানের মুখে ধসে পড়েছিল এবং পুঁজিবাদের জন্য পথ প্রশস্ত করেছিল। একইভাবে, ইয়ানিস ভারুফাকিস এবং অন্যান্য সমালোচনামূলক চিন্তাবিদরা মনে করেন যে, প্রযুক্তিসামন্ততন্ত্রও প্রতিরোধযোগ্য এবং পরিবর্তনযোগ্য। ফ্রিল্যান্সার, গিগ কর্মী এবং অন্যান্য ডিজিটাল শ্রমিকদের মধ্যে তাদের অধিকার সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান সচেতনতা, তথ্য অধিকার এবং ডেটা সার্বভৌমত্বের জন্য শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন, ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ও প্রযুক্তির প্রসার, এবং প্ল্যাটফর্ম কো-অপারেটিভ বা সমবায়ভিত্তিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠার মতো উদ্যোগগুলির মাধ্যমে এই নতুন শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। বাংলাদেশেও বিক্ষিপ্তভাবে কিছু আশার আলো দেখা যাচ্ছে – ডিজিটাল শ্রমিকদের মধ্যে ধীরে ধীরে অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিছু বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এবং নাগরিক সংগঠন ডেটা সুরক্ষা ও ডিজিটাল অধিকার নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তবে, এই প্রতিরোধের পথ এখনও অত্যন্ত দীর্ঘ, কণ্টকাকীর্ণ এবং সুসংগঠিত প্রয়াসের অভাব রয়েছে।

মার্কসীয় বিশ্লেষণ আমাদের এক মৌলিক সত্যকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়: ‘শ্রমই মূল্য সৃষ্টি করে’। প্রযুক্তিসামন্ততন্ত্র অত্যন্ত সুকৌশলে এই শ্রমকে অদৃশ্য এবং অবমূল্যায়িত করে তুলেছে। এটি শোষণকে এমনভাবে স্বাভাবিকীকরণ করেছে যে, তা অনেক ক্ষেত্রেই আকর্ষণীয় এবং আধুনিকতার মোড়কে উপস্থাপিত হচ্ছে। আমরা যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় ব্যয় করি, কনটেন্ট তৈরি করি, বা বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করি, তখন আমরা খুব কমই উপলব্ধি করি যে, আমাদের এই ব্যয়িত সময় এবং তৈরি করা ডেটাই হচ্ছে একালের ‘নতুন সোনা’ বা ‘ডিজিটাল পুঁজি’, যার উপর ভিত্তি করে গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজনের মতো কোম্পানিগুলি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য গড়ে তুলছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই সৃষ্ট মূল্যের অতি সামান্য অংশই প্রকৃত শ্রমদাতাদের অর্থাৎ সাধারণ ব্যবহারকারীদের হাতে পৌঁছায়, অথবা আদৌ পৌঁছায় না।

ফলস্বরূপ, মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিরায়ত অস্তিত্ব এবং ভবিষ্যৎ আজ এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক চাকরি, সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন, সকলের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, এবং অবসর জীবনের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা – মধ্যবিত্ত জীবনের এই আকাঙ্ক্ষাগুলি আজ যেন ক্রমশ অ্যালগরিদমের জটিল জালে এবং প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতির অনিশ্চয়তার হাতে বন্দী হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে যে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি একসময় জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিত ছিল, প্রযুক্তিসামন্ততন্ত্রের এই যুগে তাদের ভবিষ্যৎ আজ এক ঘোর অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত। ডিজিটাল অর্থনীতির চাকচিক্যপূর্ণ প্রচারণার আড়ালে প্রকৃতপক্ষে একটি অধিকতর শোষণভিত্তিক, অসম, এবং একচেটিয়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা নীরবে গড়ে উঠছে, যা বিদ্যমান শ্রেণিগত বৈষম্যকে আরও বহুগুণে তীব্রতর করে তুলছে।

এই জটিল ও সংকটময় প্রেক্ষাপটে, আমাদের প্রয়োজন প্রচলিত চিন্তাধারার বাইরে গিয়ে এক র‍্যাডিকাল বা আমূল সংস্কারমূলক ভাবনার পরিবর্তন। ডিজিটাল পরিসর এবং তার অন্তর্নিহিত অবকাঠামোগুলিকে মুষ্টিমেয় কর্পোরেট গোষ্ঠীর ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে ‘যৌথ মালিকানা, গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ এবং জনস্বার্থের ভিত্তিতে’ নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিচালনায় ব্যাপকহারে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলির অর্জিত বিপুল মুনাফার উপর ন্যায়সঙ্গত কর আরোপ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, এবং ব্যবহারকারী-নিয়ন্ত্রিত সমবায়ভিত্তিক বিকল্প গণতান্ত্রিক প্রযুক্তি ও প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ। কোডের আড়ালে, ইউজার ইন্টারফেসের চাকচিক্যের পেছনে যে সূক্ষ্ম অথচ নির্মম শোষণ প্রক্রিয়া লুকিয়ে আছে, তার মুখোশ উন্মোচন করা এবং সাধারণ মানুষকে সে সম্পর্কে সচেতন করে তোলা এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব রক্ষা, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও মানবিক ভবিষ্যতের স্বার্থে এই ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল সামন্ততন্ত্রকে প্রতিহত করাই একবিংশ শতাব্দীর মানবসমাজের অন্যতম প্রধান এবং জরুরি সংগ্রাম।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

সারাবাংলা/এএসজি

ড. মতিউর রহমান ডিজিটাল সামন্ততন্ত্র মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর