Wednesday 04 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যা দেখি, যা শুনি— বুঝি না কিছুই

আনোয়ার হাকিম
২ জুন ২০২৫ ১৬:৪৯

একটা সময় ছিলো যা দেখতাম, যা শুনতাম তার সবই বুঝতাম। কেননা, আগের খেলাধুলা হত একতরফা। আয়োজক, নির্বাহক, খেলোয়ার সব চেনাজানা, ফলাফলও ছিলো নির্ধারিত। বাহবা ধ্বনিতে চারিদিক প্রকম্পিত করতে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকত ভাড়াকরা দর্শক। ধারাবর্ণনায় থাকত একদল চৌকস বুদ্ধিজীবী আর ভাড়াকরা সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব। আমলারা ছিলো প্রোমোটার। মিডিয়াও থাকত মুখিয়ে ভাড়া খাটার জন্য। কিছুমিছু পেলে ভালো। মাগনা কামলা খাটলেও ক্ষতি নেই। রাজসিক বোঝাপড়া থাকলেই হলো। ভবিষ্যতে কাজে দেবে এই আশায় আগে থেকেই বয়ান তৈরি করে রাখত। বেছে বেছে মচমচে, কুরমুরে প্রশ্ন করা হত। প্রশ্নœকারী জানত কি তার জিজ্ঞেস করা উচিত। আর জবাবদানকারীও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত তাদের লোপ্পা প্রশ্নে তৃপ্তির ওভার বাউ-ারী হাঁকাতে। ‘উইন উইন’ সিচুয়েশনের এমন আরেকটি চিত্রও পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না, যাবেও না বোধকরি। বলাবাহুল্য, গত পনের বছরে এভাবেই চলছিলো সব কিছু সুন্দর ও পরিপাটি। পরিবেশটাও ছিলো ভালো। কোথাও কোন ভেজাল ছিলো না। থাকলেও ক্ষতি নেই। আওয়াজ প্রকট হওয়ার আগেই ‘তেড়ে মেরে ডাণ্ডা করে দেবো ঠাণ্ডা’ ডোজের কথা সবারই জানা ছিলো।

বিজ্ঞাপন

‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও/ তারি রথ নিত্যই উধাও/ জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন/ চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন/ ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল/ জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল–/ তুলে নিল দ্রুতরথে/ দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে/ তোমা হতে বহুদূরে/ মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে/ পার হয়ে আসিলাম/ আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়/ রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়/ আমার পুরানো নাম।/ ফিরিবার পথ নাহি/ দূর হতে যদি দেখ চাহি/ পারিবে না চিনিতে আমায়।/ হে বন্ধু, বিদায়’। এটি কোন সাধারণ কবির কবিতা না। রবী বাবুর।

বিদায়ের এই করুণ আর্তি শ্বাশত। বিদায়ের এরকম আয়োজন সবসময় হয়ে উঠে না। অনেকের কপালেও জুটে না। হলে ভালো হত। যারা ছিলেন এক সময়ের ধারক-বাহক-কার্যনির্বাহক তারাও বুঝতে পারেন নি কালের রথ এভাবে বিশেষ কাউকে তুলে নিয়ে বাকী সবাইকে এই জনারণ্যে এতিম করে উধাও হয়ে যাবে। এখন এতিমদের দেখভাল করার সেরকম আস্থাভাজন কেউ নেই। সবাই ‘ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি’ কাজে ব্যস্ত। তাই, সুদুরের ইশারা, স্ট্রং ফ্রিকোয়েন্সীর বার্তা আর আলো আসবেই ধরণের আশার বাণীই এখন ভরসা। এই পুঁজি নিয়েই সাবধানে, সঙ্গোপনে পাশা খেলা চলছে। সাথে আছে পুরোনো খেলোয়ার, কার্যনির্বাহক আর মিডিয়া পার্টনার।

সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড় একাকার হয়ে এখন দমকা হাওয়ার মত যে তরঙ্গ উঠছে বা উঠানো হচ্ছে তাতে তাদের ঐকতান বেশ স্পষ্ট। আমাদের দুর্ভাগ্য এরূপ ঘনঘটায় আমরা যার যার সরটুকু তুলে নিতে যারপরনাই সচেষ্ট। আমরা কি করছি, কেন করছি, কোথায় যাচ্ছি তা আমাদের সবার কাছে সুস্পষ্ট। বিপরীতে দুর্বল প্রতিপক্ষ ব্যাট হাতে নবীশ, বল হাতে আরো সাদামাটা। তাদের যারা নিয়ন্ত্রণ করছে ম্যানেজার, ব্যাটিং কোচ আর বোলিং কোচ হিসেবে তারা হাইভোল্টেজ পারফরমার হলেও ব্যাটিং পীচে আগে ব্যাট করার সুফল নিতে চায় না, তুলে দেয় শক্তিশালী প্রতিপক্ষের হাতে। তেমনিভাবে বোলিং উইকেটে বল হাতে না নিয়ে ব্যাট হাতে দ্রুত বীর্যপাতের মত রতিসুখ মেনে নেয় মন্দের ভালো হিসেবে।

৫ আগস্টের পর সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে ভেবে যারা নি:শ্বাস নিচ্ছিলেন তারা খুব দ্রুত রতিস্খলনের মত হতাশ হয়েছেন, হচ্ছেনও। পরিবর্তন যেখানে ছিলো শপথ, নতুন ধারার উন্মেষ ছিলো যেখানে স্বপ্ন আর অভীষ্ট যেখানে ছিলো ইনসাফ আর শৃঙ্খলার সেখানে ক্রমে ক্রমে শক্তিশালী হয়েছে ভাইরাস । তা এতই শক্তিশালী হয়েছে যে, ভাইরাস আক্রান্ত সবকিছুতেই পুরোনো পথ্য গেলানোর চেষ্টা হচ্ছে। ফলতঃ যে স্বপ্নযাত্রার সূচনা হয়েছিলো তা আজ বহু বাঁকে বিভিন্ন অলগলিতে বিস্তীর্ণ হয়ে এমন জটাবস্থা সৃষ্টি করেছে যে পুরোনো ফরমূলা ছাড়া এই জট খোলা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। আমরা পুরোনো পথকেই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছি। কারা যেন মিলেমিশে সম্ভাবনার নতুন পথে ব্যারিকেড দিয়ে পুরোনো জটিল, কুটিল পথে আমাদেরকে পরিচালিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমরা এখন সে পথেই চলা শুরু করে দিয়েছি।

আমরা এখন কিছুই চাইনা, শুধু চাই পুরোনো বৃত্তে ফিরে যেতে। সেখানে সবকিছুই থাকবে আগের মত। শুধু ক্রীড়নক, কার্যনির্বাহক, ম্যানেজার, কোচ, ভাড়াকরা দর্শক, ভাষ্যকার, বয়ান রচয়িতা ও অনুগত মিডিয়া পার্টনার থাকবে ভিন্ন। কিছু বিপরীত স্রোত মৃদু ঢেউ তোলার চেষ্টা করবে, কিছু অবুঝ লোকে ভিন্নসুরে গান গাওয়ার চেষ্টা করবে। তাতে অসুবিধে নেই। ম্যানেজ মন্ত্রে কিছু ভাত ছিটিয়ে দিলেই হয়ে যাবে। তা না হলে পথ্য হিসেবে ডাণ্ডা, শৃংখল আর গারদের নজীর তো আছেই।

৫ আগস্টের অভ্যুদয় বিপ্লব নাকি গণ অভ্যুত্থান – এ নিয়ে আজো আমাদের উর্বর মস্তিষ্কের চর্চা শেষ হয়ে যায় নি। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা পত্র তৈরি হবে কি হবে না তা নিয়েও পরস্পর বিরোধী প্লাটফরম মুখোমুখি। সংবিধানের কিছু পরিবর্তন, সংশোধন আদৌ হবে কিনা, দরকার আছে কিনা তা নিয়েও রীতিমত যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান। এগুলো এখন টক শো-র স্থায়ী টপিক হিসেবে আয়োজক মিডিয়া ও বক্তাদের কাছে খুবই উপাদেয় বিষয় হয়ে গেছে।

আমরা দাবী আদায়ের নামে ছাত্রদের অটোপাসের বিভৎসতা দেখেছি। আনসার বাহিনীর দফায় দফায় তা-ব দেখেছি। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির লোকদের নৈরাজ্য প্রত্যক্ষ করেছি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের অবরোধ, হুমকি-ধামকি দেখেছি, পেশাজীবিদের দাবীদাওয়ার মহড়া দেখেছি। অটো ভার্সেস পা দলা রিক্সা শ্রমিকদের রিহার্সেল উপভোগ করেছি। বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি দপ্তেরের কর্মকর্তা – কর্মচারীদের ডজন ডজন দাবী দাওয়া উত্থাপন করতে দেখেছি, তাদের হুমকি, আল্টিমেটামও শুনেছি। বেসরকারি সংগঠন ও অন্যদের রাজপথ অচল করে দেওয়ার বজ্র কঠিন শপথ নিতেও দেখেছি। আরো দেখেছি সচিবালয় উপুর্যুপরি ঘেরাও করতে, আর দেওয়াল ভেঙ্গে সহিংসতা চালাতে। যখন তখন চাইবা মাত্র পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙ্গতে দেখেছি। পুলিশের সীমাহীন নিষ্ক্রিয়তাও প্রত্যক্ষ করেছি। দিনের পর দিন যমুনা ঘেরাও করে রাখতে দেখেছি। অনশনে বসতে দেখেছি। অনশন ভাঙ্গতেও দেখেছি। এখনো হুমকি দেওয়া হচ্ছে দেখে নেওয়ার, আবার সোচ্চার হওয়ার। কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কিছু এলাকা ও স্থাপনাকে ‘সংরক্ষিত’ ঘোষণা দিয়ে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার ফরমান জারী করতে দেখেছি। আবার এও দেখেছি এসব কাগুজে ফরমান কাগজেই শোভা পেতে। কেউ এর তোয়াক্কা করেনি, করছেও না।

পনের বছরে এত দাবী ছিলো না, এত একাত্মতা ছিলো না, এত ঘেরাও, অবরোধ, অবস্থান কর্মসূচী, অনশন, বিধ্বংসী কায়কারবার দেখিনি। সবাই এখন মুক্ত হাওয়ায় যে যার মত করে যাচ্ছেতাই করে যাচ্ছে। প্রশাসন দেখেই যাচ্ছে, ভাবটা এমন যে, দেখি শালা কী করে? নয় মাস চলে গেছে আমরা প্রতিশ্রুত বিচারের কোন পর্যায়ে আছি তা কেউ জানে না। শুধু জানে কাজ হচ্ছে। বজ্র আঁটুনির মত। সংস্কার হচ্ছে মুখে মুখে। কমিটির সুপারিশে। কয়েকটি সংস্কার বাস্তবায়নে পাবলিক রিয়েকশন দেখে বিস্ময় জাগে। এগুলো কারা করেছে, কেন করেছে বা এখনই তড়িঘড়ি করে কেন করতে হবে? নারী বিষয়ক সংস্কার কমিটির রিপোর্ট ও তার পক্ষে রাজপথে ভিনগ্রহের নারীদের কদর্য প্রকাশ দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। সংস্কার কি আপামর জনগণের পক্ষে হবে নাকি কিছু চিহ্নিত ফোরামের ইচ্ছেতে হবে? যে ভাবে, যে পোষাকে, যে আচরণে, যে ঔদ্ধত্যে নারীর হিস্যার সাথে কতিপয় ভিনগ্রহের নারীরা নিজেদেরকে বেশ্যার ছন্দমিল ঘটিয়েছে তা রীতিমত উদ্বেগজনক ও অরুচিকরও। কারা তাদেরকে এভাবে উপাস্থাপনের আয়োজন করেছে সুনির্দিষ্টভাবে তা জানা না গেলেও জনগণ বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নেয়নি। ফলশ্রুতিতে জনগণ নিজেদেরকে সরকার থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্তর্বতীকালীন সরকার আর উপকৃত হয়েছে দেশী-বিদেশী এজেন্ট।

এমুহুর্তে এনবিআর ভাগাভাগি কি এতটাই জরুরি ছিলো? একটু রয়ে সয়ে কি করা যেত না? এটাকে নিয়েও জল ঘোলা কম হয় নি। এখনো এর বিষবাষ্প নিবার্পিত হয় নি। জুন ক্লোজিংয়ের আগেই কি এটাকে উপস্থাপন জরুরি ছিলো? বাস্তবসম্মত ছিলো? এর বুদ্ধিদাতা কে বা কারা? উদ্দেশ্য কি মহৎ না অসৎ? জানি এগুলো কোন কালেই উদঘাটিত হবে না। খেলোয়াড়রা থেকে যাবে নেপথ্যে। অন্য ঘুটি চালার অপেক্ষায় হয়ত কিছুকাল চুপ মেরে থাকবে। এরিমধ্যে সরকারি কর্মচারী আইন ২০১৮ এর সংশোধনী নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে। এর জের এখনো চলমান আছে। প্রশাসনের নাভিমূলে দাঁড়িয়ে সচিবালয়ের কর্মকর্তা – কর্মচারীদের অচল করে দেওয়ার মত কায়কারবার প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে সবাইকে। গেলো কয়েকদিন অবস্থা এমন হয়েছে যে, এদেরকে নিবৃত্ত করার যেন কেউ নেই। এক মাত্র বিকল্প হলো সরকারকে পিছু হটে পূর্বাস্থায় ফিরে যাওয়া। এরকম অবস্থার কেন সৃষ্টি হলো? কারা এই উত্তপ্ত কড়াইয়ে নতুন তেলের ফোঁড়ন দিয়েছে? কী তাদের উদ্দেশ্য? সচিবালয়ের বড় বড় আধিকারিকরা কি এটা আঁচ-অনুমান করতে পারেন নি? যদি তর্কের খাতিরে ধরেও ধরে নিতে হয় যে, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থেই এরূপ একটা কঠিন আইনের প্রয়োজন ছিলো- তাহলেও এটাকে কি অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে উপস্থাপন করা যেত না? অথচ ১৯৭৯ সালের এই অধ্যাদেশ নিয়েই প্রশাসন এতকাল বন্ধুর পথ পেড়িয়ে এসেছে। সাত দিনের সময়কে আরো চওড়া করে, তদন্ত ও আপীলের দ্বার প্রশস্ত রেখে ও পদ্ধতি আরো সহজ করে অভীষ্ট কী অর্জন করা যেত না? যেত। হয়ত সময় একটু বেশি লাগত। এখানেই সন্দেহ জাগে, কারা, কেন এটা এসময় মাঠে ছেড়ে দিয়েছে?

মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব কি এটা আন্দাজ করতে পারেন নি? সর্ষের মধ্যে ভূত আসলে কারা? সেটা অস্পষ্ট থেকে গেলো। হয়ত থেকেই যাবে। তবে বাইরের অশান্ত ও বিবদমান পক্ষের এত এত হানাহানি, কাঁদা ছোঁড়াছুড়ির মধ্যে প্রশাসন অঙ্গনকেও তাতিয়ে তুলতে কোনো পক্ষ কি নেপথ্যে ফায়দা নিচ্ছে? ভেতর-বাইরের রব একাকার হয়ে চারিদিকে একটাই ম্যাসেজ দিচ্ছে, সরকারের সামনে রথ ধেয়ে আসছে। হয়ত রবী ঠাকুরের কবিতার মত তুলে নেবে দ্রুত রথে দু:সাহসী ভ্রমণের পথে। সে জন্যই কি সকল পক্ষ এক সুরে গান গাইছে? একটাই সরল রেখা টেনে রথের যাত্রা পথকে সুনির্দিষ্ট করে দিচ্ছে? সবই হচ্ছে দেশপ্রেম, গণতন্ত্র আর জনগণের নাম দিয়ে, তাদের ভালোর জন্য। জনগণ কী ভাবে তার ধার কেউ ধারে না। তাদের হয়েই যেন সকল ভাবনার দায়িত্ব নিয়েছে কিছু হোয়াইট কালার পিপল, দেশি-বিদেশী এক্টর, দেশীয় কার্যনির্বাহক, কোচ, ম্যানেজার, ধারাভাষ্যকার, বয়ান লেখক, ভাড়াটে দর্শক আর মিডিয়া পার্টনার। যা দেখছি, যা শুনছি তা থেকে কি কিছু বুঝতে পারছি? ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায়। অতএব, সাধু সাবধান। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

আনোয়ার হাকিম মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর