২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে গোপালগঞ্জের কোটালিাপাড়ায় নিজ নির্বাচনী এলাকায় এক মতবিনিময় সভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, তারা নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না। তাই আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের (২০২৪ সাল) দিকে বাংলাদেশে এমন অবস্থা করবে, যেন দুর্ভিক্ষ ঘটাবে। ২০২২ সাল থেকেই এই আশঙ্কার কথা বলে আসছিলেন। কারণ হিসেবে করোনা পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের দায়কে সামনে আনেন।
বিবিসি বাংলা ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী (ডব্লিউএফপি) সতর্ক করে বলেছে যে ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে এবং ২০ কোটি মানুষের জন্য জরুরি সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। এমন শঙ্কার প্রেক্ষিতে, আশু দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় জনসাধারণকে এক টুকরো কৃষি জমিও অনাবাদী না রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী।
৭ জানুয়ারি ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে জার্মানি সফর শেষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলেন তিনি আবারো, দুর্ভিক্ষের বিষয়টি সমানে আনেন। এবার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরে মার্চ নাগাদ দুর্ভিক্ষ হতে পারে বলে সতর্ক করে দেন। দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি আর আসেনি। বরং ৫ আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে তার সরকারের পতন হয়।
অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বেরিয়ে আসতে শুরু করে অর্থনীতির প্রকৃত ভগ্ন দশা। শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে, প্রতি বছর দেশ থেকে পাচার হয়েছিল গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার। এর উৎস ছিল মেগা প্রকল্পের আড়ালে এবং ব্যাংক থেকে ঋণের নামে লুটপাট করা টাকা। যার মূল্য জনগণকে পরিশোধ করতে হয়েছে জিনিসপত্রের বাড়তি দাম দিয়ে তথা উচ্চ মূল্যস্ফীতি সহ্য করে। এখনো তা অব্যাহত আছে।
অর্থনীতির এসব কথা ওঠে এসেছে জুলাই-আগস্টে হওয়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার করা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস প্রতিবেদনেও। এর ২৮ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়, অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও সম্পদের পুঞ্জীভূতকরণ এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের কারণ হলো, সরকারি ক্রয়ে ব্যাপক দুর্নীতি এবং আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ অভিজাতরা ব্যাংক, জ্বালানি সরবরাহকারী ও অর্থনীতির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাত দখল করেছিল।
আরো বলা হয়, রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্লায়েন্টরা ঋণ আত্মসাতের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি বড় বড় ব্যাংক ফাঁকা কর ফেলে, যা দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকিতে ফেলার জন্য যথেষ্ট ছিল। আত্মসাৎ করা অর্থ এবং অন্যান্য অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ তারা বিদেশে পাচার করেছে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত বাংলাদেশী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং তাদের সাথে সম্পৃক্ত বাংলাদেশেী অভিজাতদের সুবিধার্থে বিদেশে বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের যে আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছিল তা মূলত অর্থনীতিকে ভিতর থেকে এভাবে খেয়ে ফেলার ফলাফল হিসেবেই, যা জাতিসংঘের রিপোর্টেও কিছুটা ওঠে এসেছে। চরম অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার জেরে ডলারের দাম বাড়ছিল হুহু করে। রিজার্ভ পতন হচ্ছিল দ্রুত। ২০২১ সালে ওঠা ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ৫ আগস্টের আগে নেমে আসে ২০ বিলিয়ন ডলারের নীচে।
পরিস্থিতি এমন হয়েছিল, বিদেশি দায়দেনা মেটানোর যাচ্ছিল না। জ্বালানির দাম বাকি পড়ে যায়। আমদানির জন্য খোলা ঋণপত্রের টাকা পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়ছিল ব্যাংকগুলো। এতে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লেনদেনে তৈরি হয় আস্থাহীনতা। বাকিতে কেনাকাটা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। ফলাফল হিসেবে সময়মতো জ্বালানি, খাদ্য ও শিল্প পণ্য আমদানি করতে পারতো না, যা দেশে তৈরি করতো দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি।
সংকট উত্তরণে তৎকালীন সরকার রিজার্ভের ক্ষয় কমাতে আমদানির গলা চিপে ধরে। তবে এটাও সত্য যে করোনার পর বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় হঠাৎ বেড়ে যায়। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৮২.৫ বিলিয়ন ডলার (১ বিলিয়ন=১০০ কোটি) আমদানি ব্যয় পরিশোধ হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এটি কমে হয় ৭০.৭৫ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরো কমে হয় ৬৩.২৪ বিলিয়ন ডলার। এসব আমদানি ব্যয়ের আড়ালে যে অর্থপাচার ছিল না তা বলা যাচ্ছে না।
আমদানি কমিয়ে আনার পাশাপাশি বাংলাদেশে থাকা বিদেশি কোম্পানিরগুলোর লভ্যাংশ তাদের নিজ দেশে পাঠানোও বন্ধ ছিল। এসব পরিস্থিতি গোপন করে সরকারের পক্ষ থেকে করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উপর দায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। অর্থনীতির এমন ভঙ্গুর দশা সহসাই সারানো সম্ভব নয়। এর প্রভাব আমাদের আরো কয়েক বছর বয়ে বেড়াতে হতে পারে। যার ফলে, দেশে নতুন করে ৩০ লাখ নতুন দরিদ্র তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছে বিশ্ব ব্যাংক।
তারপরও দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরি না হওয়ার কারণ, অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই যতটা সম্ভব অর্থপাচার রোধ করার চেষ্টা করছে। আগের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ছেদ পড়ে পাচারের অন্যান্য রাস্তাও সংকুচিত হয়ে গেছে। কিছু ব্যাংক সম্ভাব্য পথ হিসেবে ব্যবহার হতো। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়েই সেগুলোর পরিচালনা পর্ষদ দ্রুত পুর্নগঠন করেন। আমদানি-রফতানিতেও নজরদাড়ি বাড়ানো হয়। এসব উদ্যোগে ডলার বেরিয়ে যাওয়া হ্রাস পেয়ে, রিজার্ভের দ্রুত পতন কমে আসে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর বিপিএমসিক্স অনুযায়ী রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের উপরে।
রিজার্ভ বাড়ায় ডলারের দামেও এসেছে স্থিতিশীলতা। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ডলারের বিনিময়হার ছিল গড়ে ৮৬ টাকা। ২০২৩ সালের শেষ দিকে যখন প্রধানমন্ত্রী দুর্ভিক্ষের কথা বলছিলেন তখন ডলারের দাম বেড়ে হয়েছিল ১১০ টাকা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকারের পতনের সময় ছিল ১১৮ টাকা। জুনে এসে ডলারের দাম হয়েছে ১২৩ টাকা।
অর্থাৎ অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার ১০ মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার পতন হয়েছে ৪.২৩ শতাংশ, যা ২০২২ থেকে ৫ আগস্ট পরযন্ত ছিল ৩৭ শতাংশের বেশি। ওই সময় ডলারের দাম ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের আমদানি পণ্যের দামও বেড়ে যায়। যদি আইএমফ এর শর্ত মেনে ডলারের দাম বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হতো তাহলে এখনো ১২০ টাকাতেই স্থিতিশীল রাখতে পারতো নতুন সরকার।
তবে, মূল্যস্ফীতি বা জিনিসপত্রের দাম বাড়ার পিছনে ডলারের দাম বৃদ্ধি, টাকার প্রবাহ বাড়া যেমন কারণ তার পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেটে আরো বড় কারণ। এখানে অন্তবর্তী সরকার জোরালো ভাবে হাত দিতে পারেনি, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু আর্থিক ব্যবস্থাপনার জায়গা থেকে যেসব উদ্যোগ নেয়া দরকার তা যথা সময়ে নিয়েছে। ফলাফল হিসেবে দেশ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি ঠেকাতে পেরেছে।
এতে সহায়তা করেছে প্রবাসীদের ভাই-বোনদের পাঠানো বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স। গত বছরের জুলাই থেকে এই বছরের জুনের ৩ তারিখ পরযন্ত তারা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ২৮.১১ বিলিয়ন ডলার। যা আগের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। এছাড়া রফ্তানিও বাড়ছে। আবার, রফতানির টাকা দেশে না আসা সংক্রান্ত যে হিসেবের গড়মিল ছিল সেটাও মেলানো হয়েছে।
পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় সরকার বিদ্যুতের দায় দেনা মেটাতে পারছে। কাতারসহ অন্য রাষ্ট্রগুলো আবারো বাকিতে জ্বালানি সরবরাহের সুযোগ দিচ্ছে। এতে জ্বালানির ব্যাপক সংকটের যে শঙ্কা ছিল তা কমে এসেছে। ফলাফল হিসেবে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন খুব একটা ব্যাহত হয়নি, বরং বেড়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে গেল মার্চে শিল্প উৎপাদনের সার্বিক সূচক ছিল ২৩২.৭৭, যা ২০২৪ সালের মার্চে ছিল ২১৩.৫৭।
নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর জ্বালানি সংকটের কথা বলে শিল্প উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগের সত্যতাকে এই তথ্য সায় দিচ্ছে না। অভিযোগটা বেশি এসেছে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে, যা কিনা ম্যানুফেকচারিং খাতের অংশ। এই খাতের উৎপাদন সূচক চলতি বছরের মার্চে ছিল ২৩৮.০৫, যা গেল বছরের মার্চে ছিল ২১৯.৩১, অর্থাৎ এই বছর বেড়েছে।
এদিকে, রিজার্ভ বাড়ায় তথা ডলারের সংকট কমে আসায় ব্যাংকগুলো এলসির দায় পরিশোধ করতে পারছে। এতে করে বাকিতে পণ্য কেনার সুযোগ বাড়ছে। খাদ্যসহ শিল্প পণ্য আমদানি ব্যহত হচ্ছে না। ধীরে ধীরে এলসি মার্জিন কমিয়ে আনা হচ্ছে। যদিও বিনিয়োগ নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় কমছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি। সার্বিক ভাবে ডলার সংকট কাটতে থাকায় ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট রেটিং এর যে পতন হয়েছে, তার উন্নতি আশা করা যাচ্ছে।
অন্তবর্তী সরকার দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে পারলেও আগামীতে দেশের জন্য বড় শঙ্কা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ। রূপপুর কিংবা মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোর মত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে উচ্চ সুদে ঋণ নেয়া হয়েছে। যেগুলো দিনকে দিন বিরাট বোঝা হয়ে জনগণের ঘাড়ে চেপে বসবে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে ২.৬১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৭-২৮ অর্থবছরে এটা বেড়ে হবে প্রায় ৩.৩৪ বিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে, ২০২৬ সালের নভেম্বরে এলডিসি উত্তরণের পরবর্তী বিরাট চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সুবিধা সংকোচিত হওয়া, স্বল্প সুদের ঋণ কমে আসা ও আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব আইন কারযকর হলে আমাদের শিল্পগুলো চাপে পড়বে। এর থেকে উত্তরণে প্রয়োজন সক্ষমতা বাড়ানো। এজন্য প্রয়োজন সুশাসন নিশ্চিত করা। আর, সুশাসন তখনই নিশ্চিত হবে যখন সুষ্ঠু গণতন্ত্রের মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা যাবে।
লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, সময় টেলিভিশন ও সাবেক কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, ইআরএফ