Wednesday 25 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কেউ কথা রাখেনি

আনোয়ার হাকিম
২৫ জুন ২০২৫ ১৯:২৪

কালো টাকার শক্তি অপরিসীম। সাদা টাকার নড়াচড়া খুব সহজেই দেখা যায়। কিন্তু কালো টাকা এত কালো যে তাকে সাদা চোখে দেখা তো যায়-ই না, খুঁজে পেতেও কষ্ট হয়। কালো টাকা নিয়ে সরকার বেকায়দায় পড়ে নাকি কালোকে সাদা রূপ দিতে কালো মানিকদের চাপের কাছে সরকার গ্যাড়াকলে পড়ে নাকি যৌথ বোঝাপড়ায় রঙের এরূপ রূপান্তর ঘটে তা মিলিয়ে দেখা বড় কঠিন। তবে কিছু একটা ঘুটু বা অস্বস্তি বা ‘উইন উইন সিচুয়েশন’ যে এর নেপথ্যে কাজ করে তা কাউকে বলে বুঝাতে হয় না।

এতো গেলো কালো টাকার কথা। একে তবু জায়েজ করে দেশে পুন:বিনিয়োগের সুযোগ দিলে বিনিয়োগ জনিত উৎপাদন বাড়ে, নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হওয়ার কারণে বেকারত্ব কমে, সঙ্গত কারণে আয় বাড়ে। সাধারণত এরূপ কালো টাকার উৎস খোঁজা যাবে না বা তালাশ করা হবে না এমন শর্ত যুক্ত থাকে সরকারি বয়ানে। এতসব করেও আমাদের অর্থনীতি কতটুকু ফাল দিয়েছে তা জানা যায় না। এ নিয়ে কয়েকদিন মিডিয়া ও বুদ্ধিভারাক্রান্ত সুশীলদের উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়। এরপর এ নিয়ে আর কোন আওয়াজ নেই।

বিজ্ঞাপন

লুটপাটের টাকা নিয়ে এখন কথা বলার সময় এসেছে। গেলো রেজিমে এ টু জেড সব সেক্টর থেকে গোগ্রাসে লুটপাটের যে ফিরিস্তি বের হচ্ছে বা পাবলিকের আলোচনায়, মিডিয়ার স্কুপ নিউজে উঠে আসছে তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। কালো টাকা দেশে থাকে। ভুলিয়ে ভালিয়ে সাদা করার সুযোগ দিলে কিছুমিছু সাদা অর্থনীতির বহরে ঢুকে অর্থনীতির প্রবাহকে বৃদ্ধি করে কিন্তু লুটপাটের অর্থ? তা থাকে কই, যায় কই? রাহাজানি করে যে অর্থ লুটপাট করা হয় তার অবশ্যম্ভাবী গন্তব্য হয় দেশের বাইরে বিভিন্ন উন্নত দেশে, কাছেপিঠের বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহে। যে টাকা দেশান্তরি হয়ে চলে যায় চুপিচুপি তাকে ফিরিয়ে আনার তরিকা কী? প্রথমত ধরা না খেলে বা কেউ ধরিয়ে না দিলে লুটপাটের টাকা লুটেরা গ্যাংদের ছায়া-প্রচ্ছায়ায় আউট অফ ফোকাস হয়েই থেকে যায়। উদ্ঘাটিত হলে তখন মাথায় বাজ পড়ে। পগার পাড় হওয়া সেসব অর্থ ও সম্পদ ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে সফলভাবে সম্পন্ন করে দেশে ফিরিয়ে আনার রেকর্ড এখনো শোনা যায় নি। কিছুমিছু হয়ত এসেছে তবে তা পরিমাণে এতই নগণ্য যে পরিহাসের মত শোনাবে। সরকার বলছে তারা চেষ্টা করছে। তারা আশাবাদী। প্রক্রিয়াগত কারণে তা সময় সাপেক্ষ। আর এখানেই বেধেছে গোল। এতেই গণতন্ত্রীমনা ডান-বাম সবার আপত্তি। শুরু হয়েছে লুটপাটের অর্থ নিয়ে ঘোলা পরিবেশ সৃষ্টির অপপ্রয়াস। টাকা যাদু জানে। তাই টাকা কালো আর ধলো যা-ই হোক ফাও পেলে বা খয়ের খা-গিরি করে কিছু-মিছু মিললে মন্দ কি? গোল্লায় যাক নীতি-নৈতিকতা, রসাতলে যাক দেশ ও জাতি। তাতে কার কি?

আমরা সবকিছু শুরু করি চমৎকার আয়োজনের মোড়কে। উদ্বোধনে, অঙ্গীকারে, মসৃণ বয়ানে আমরা চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে আমরা শ্লথ হয়ে পড়ি, আরো কিছুদূর গিয়ে ক্লান্ত হয়ে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়ি। পরে ভুলেই যাই কী যেন আমরা শুরু করেছিলাম আর কোথায় যেন তা ফেলে রেখে আরেক আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। যারা এসব আয়োজন নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তারা সর-মাখন যা তুলে নেওয়ার ও গোগ্রাস করার পর পড়ে থাকা পানসে পানি নিয়ে আর মাথা ঘামান না। কর্তৃপক্ষ ফলাও করে প্রচার মাধ্যমে নিজেদের এজেণ্ডা ও অঙ্গীকার শতভাগ বাস্তবায়নের দাবী করে সর্বক্ষণ একটা ভাইব তুলে রাখে। পাবলিক এসবের খোঁজ-খবর আর রাখে না। তারা তো সারাদিন বিনে পয়সায় সরকারি সার্কাস দেখেই কুল পায় না। আর মিডিয়াও গন্ধ শুঁকে যে বেগে এর ভেতরে ঢুকে কেন জানি সেবেগেই ইউটার্ন নিয়ে অন্তর্জালে আড়াল হয়ে যায়।

লুটপাটের টাকা সনাক্তকরণে, যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া গ্রহণে ও লেগে থাকার কাজে যারা নিয়োজিত থাকেন তাদের আন্তরিকতার উপরই এর ফলাফল নির্ভর করবে। দেশের প্রশাসন, বিচারিক ক্ষেত্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আন্তরিক হলে, লুটকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় আর তয়-তদবির করলে উল্লেখযোগ্য অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ও দূতাবাসের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ প্রায় সময় মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে উত্থাপিত হয়। পাবলিক তাদের সাফল্যের, উৎকর্ষের তেমন কিছুই জানে না। শুধু জানে, প্রবাসীরা দূতাবাসের সেবাদ্বার পর্যন্ত যেতেই হিমসিম খায়। মেওয়া পাওয়া তো দূরকে বাত।

বলছিলাম লুটপাটের অর্থ ফিরিয়ে আনা নিয়ে। যারা দেশ-জাতি-রাষ্ট্র নিয়ে ভাবেন, গলদঘর্ম হন তারা কি আদৌ এ বিষয়ে আন্তরিক? জমানো টাকা কাকবন্ধ্যা হয়ে বসে থাকেনা। সে রীতিমত আণ্ডা পারে। টাকায় টাকা আনে। লুটের অর্থ দিয়ে কেনা সম্পত্তির ডিপ্রেসিয়েশন হয়েও বর্তমান যে ভ্যালু দাঁড়ায় তা লাফিয়ে লাফিয়ে সময়ের তালে কেবলই বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত পুঞ্জীভূত এই টাকা দিয়ে দেশের বাইরে থেকে কলকাঠি নাড়া যায়, নিজের ও দলের, সম্প্রদায়ের অনুকূলে সুন্দর সুন্দর বয়ান রচনা করা যায়, নানা ছুঁতায় উস্কানীও দেওয়া যায়। এতে ডান-বাম সবার অবদান অনস্বীকার্য। তাই, লুটতন্ত্রের টাকা উদ্ধারের মহতী উদ্যোগ কতটুকু সফলতার মুখ দেখবে সেটাই দেখার বিষয়। আশায় উদ্বেলিত হই। ভাবি এইবার বোধহয় জায়গামত কোপ পড়লো।

ভাবি তো অনেক কিছুই হবে। দিন শেষে দেখি কিছুই হয় না। কারা যেন আপোষে কাটাকুটি খেলে। সরটুকু নিয়ে পানিটুকু বুঝিয়ে দিয়ে বলে এইবার হবে, দেখে নিও। আসলে হয়না তো। সরকার শক্ত হলে, প্রক্রিয়ার শক্ত বাধন দিয়ে ধরতে পারলে হয়ত কিছু একটা ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে। কিন্তু সময়ের বরাদ্দ যে অনেক কম। অনেকেই তো চায় না সরকার এভাবে সবকিছুতে হাত দিক। এতসব তাদের কাজ না। এসব শুনি আর ভাবি, কি জানি? হবে হয়ত, হয়ত একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তাই, তারাপদ রায়ের কবিতা: “সব ঠিক হয়ে যাবে” আওড়াই _
‘এই সেদিন পর্যন্ত ভেবেছি, সব ঠিক হয়ে যাবে/ কবে কখন কেমন করে, কি ভাবে ঠিক হবে,/এবং সত্যি সত্যি কি ঠিক হবে, এবং ঠিক না হলেই বা কি হবে/সে বিষয়ে অবশ্য কোনো চিন্তা করিনি/কোনো ধারণাও ছিলো না।/শুধু কোথায় কেমন একটা আলগা বিশ্বাস ছিলো,/মনে মনে ধরে রেখেছিলাম,/একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে’।

আমিও এভাবে ভাবি, ভাবতে চাই- একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে- কবে, কখন, কী ভাবে ঠিক হবে জানি না। তেপ্পান্ন বছর পেড়িয়ে গেলো, কেউ কথা রাখেনি।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

আনোয়ার হাকিম কালো টাকা মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর