Wednesday 09 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যম— প্রাসঙ্গিক ভাবনা

আনোয়ার হাকিম
৯ জুলাই ২০২৫ ১৭:২৫ | আপডেট: ৯ জুলাই ২০২৫ ১৮:৩০

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ জমানায় কত কি যে ভেসে বেড়াচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। কেউ কাঁদছে, কেউ হাসছে, কেউ ট্রল করছে, কেউ হিংসা-দ্বেস ছড়াচ্ছে। কেউ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নিচ্ছে, কেউ তার উপর কৃত জুলুম-নির্যাতনের প্রতিকার চাচ্ছে। কেউ কারো পিণ্ডি চটকাচ্ছে। কেউ কারো হয়ে সাহায্য প্রার্থনা করছে। রং-ঢং, অশ্লীলতা আর বেলেল্লাপনার কথা নাহয় বাদই দিলাম।

পরিবর্তনের হাওয়ায় মূল ধারার মিডিয়া আজ অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। সমস্যায় আকন্ঠ নিমজ্জিত পাবলিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এসব চলতি মানের বারোয়ারি কাহিনী সম্বলিত কন্টেন্ট দেখতে আজ বড়ই উদগ্রীব। এসব চলতিমানের কন্টেন্টের চাপে মূল ধারার মিডিয়াও অনলাইন ভার্সন খুলেছে। এতেও তেমন সুবিধে করতে না পেরে যার যার মিডিয়ার নামে পৃথক পৃথক পেইজ খুলতে বাধ্য হয়েছে। তাতে হাজার হাজার লাইক, ভিউ, কমেন্ট পড়ছে। এর বাইরে ট্যুরিস্ট ভ্লগ, কাপল ভ্লগ, নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল তো আছেই। সারা বিশ্বেই এখন এগুলো ট্রেনিং। প্রযুক্তি নিভর্রতা এতটাই প্রকট হয়েছে যে, চ্যাটজিপিটি এখন তরুণদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও নিভর্রযোগ্য টুল।

বিজ্ঞাপন

প্রযুক্তির বিকাশ যুগে যুগে ছিল, এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। এর ভাল-মন্দ দু’দিকই আছে। ব্যবহারকারীর মানসিকতা, চাহিদা ও আসক্তির উপর তার প্রভাব পড়ে থাকে। মানুষ যখন স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয় তখন সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে মেলে ধরে। যখন তার প্রতিকার পথে রাষ্ট্রের সাহায্যের হাত সংকুচিত বা অন্য কারণে অনুপস্থিত বলে মনে হয় তখন সামাজিক মাধ্যমে মানুষ তার বেদনার কথা প্রকাশ করে, সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে প্রতিকার প্রত্যাশা করে।

বেশ কিছুদিন যাবত একটা ট্রেণ্ড লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাহলো বিভিন্ন পেশার প্রধান বা সেলিব্রেটি টাইপের ব্যাক্তিদের,রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আধিকারিকদের ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে অডিও-ভিডিও লিংক ভাইরাল করা হচ্ছে। নেট দুনিয়া এর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। নানা প্রকার ট্রল ও কমেন্টে আজ সমাজ জীবন কলুষিত হয়ে পড়ছে। নীতি-নৈতিকতা এখন হাসির বিষয় হয়ে পড়েছে। কুরুচি আজ রুচির জায়গা করে নিচ্ছে। অশ্লীলতা নতুন গ্ল্যামার পেয়েছে। সভ্যতা-ভদ্রতা এখন পরিত্যক্ত মালের মত মূল্যহীন, অযথা জায়গা দখল করে রাখার মত বিরক্তিকর হয়ে পড়েছে। গোপনীয় ট্যাগ দেওয়া এসব লিংক ভাইরাল হলে ব্যাক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পরিবার তছনছ হয়, সমাজ কলুষিত হয় আর সামগ্রিকভাবে প্রশাসনের উপর জনগণের আস্থা উঠে যায়।

কারা, কী কারণে এগুলো ছড়াচ্ছে তার একটা চটজলদি জরীপ করে ফেলা যাক। এ ধরণের অডিও-ভিডিও লিক করতে পারে তারাই, যারা কারো দ্বারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা যারা এগুলো লিক করার মাধ্যমে কাউকে পরিবার-সমাজের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করতে চায়, বিশেষ সুবিধা নিতে ব্যর্থ হয়ে অধিকতর চাপ প্রয়োগের অপকৌশল হিসেবেও অনেকেই এ কাজ করে থাকে। এর শিকার হচ্ছে কারা? বিশেষত রাজনীতিবিদ, ছাত্র নেতা, নারী ও সরকারি আধিকারিকরা। মজার বিষয় হলো গঠনমূলক সমালোচনার উপাদান হিসেবে নয় বরং ব্যাক্তির ব্যাক্তিগত ফোনালাপ, চ্যাটালাপ পাবলিক করে দিয়ে তারা এটাই জানান দিতে চায়, যে কোনো সময় তারা যে কারো লিংক ভাইরাল করে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে। অথচ এসব লিংকের মূল উপজীব্যই হলো পরকীয়া, নারীঘটিত কেলেংকারি, প্রতিশ্রুতি দান ও ভঙ্গ, বহুগামিতা ইত্যাদি। যেগুলোর সাথে আক্রান্ত ব্যাক্তির পেশাগত কর্মের কোনই সংশ্লিষ্টতা নেই। আবার কেউ এগুলো স্রেফ মজা নেওয়ার জন্য ফাঁস করে থাকে। অনেকেই আর্থিকভাবে লাভবান হতেও তা করে থাকে। ফাঁস হওয়া এসব অডিও-ভিডিও লিংক মুহুর্তেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। প্রশ্ন আসে, কারা এ ধরণের উদ্দেশ্যমূলক অডিও-ভিডিও লিংক ভাইরাল করে দিচ্ছে? রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আধিকারিকদের এরূপ লিংক ভাইরাল করে থাকে তারা, যারা এই দুই অঙ্গণকে ঘোলাটে করতে চায়, যারা তাদের কাছ থেকে লাভবান হতে চায় অথবা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চায়। পেশাগত দায়িত্ব পালনকারীরা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যত্যয় করলে, নয়ছয় করলে, সীমা লংঘন করলে তার সুস্পষ্ট প্রমাণক থাকলে এর যৌক্তিকতা অবশ্যই প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু পেশাগত কমের্র সাথে সম্পর্কহীন একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে নাড়াঘাটা করা অবশ্যই কুরুচির পরিচায়ক।

সম্প্রতি প্রশাসনের জেলা পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার নারী কেলেংকারি নিয়ে অডিও-ভিডিও টেপ ভাইরাল হয়েছে। মুহুর্তেই হাজারো মানুষের হাতে হাতে তা লক্ষ মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়ে গেছে। এই সংখ্যা দিনে দিনে বহুগুণে বৃদ্ধিই পাচ্ছে। সেই কর্মকর্তাকে নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে প্রাথমিকভাবে মন্ত্রণালয়ে এনে ওএসডি করে রাখা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে সেই কর্মকর্তা ফেসবুক লাইভে এসে অঝোর ধারায় কান্নাকাটি করে বিলাপের যে চিত্র দেশবাসীর সামনে উপহার দিয়েছেন তাতে বর্তমান সামাজিক, পারিবারিক ব্যবস্থাপনাকে তছনছ করে দেওয়ার উপক্রম হয়েছে। সেই কর্মকর্তা একটি জেলার শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। যে অফিসের তিনি শীর্ষ আধিকারিক ছিলেন সে প্রতিষ্ঠানটি আড়াই শ’ বছরেরও পুরোনো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। দৈব-দুর্বিপাকে, আনন্দ-বেদনায়, উৎসবে-অনুষ্ঠানে, সামাজিক-রাষ্ট্রিক আচারে, সুশাসন প্রতিষ্ঠায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এই প্রতিষ্ঠান জনগণের খুব কাছে থেকে কাজ করে থাকে। জনগণ তার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারলে নিজেদেরকে সম্মানিতবোধ করে, নিরাপদ ভাবে। তারা শীর্ষ কর্মকর্তাকে অতি আপনজন ভাবে, যে কোন উপায়ে তার দ্বারস্থ হতে পারলে প্রতিকার মিলবেই এরূপ প্রত্যাশাও পোষণ করে থাকে। অন্যদিকে তাকে দুর্বৃত্ত শ্রেণী, অসাধু ব্যাক্তিবর্গ ভয় পায়, এড়িয়ে চলে। জনগণ এরূপ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীকে অকুতোভয়, বীর, করিৎকর্মা, উদ্যোগী, প্রোয়েক্টিভ, সৎ ও দয়ালু হিসেবে চেনে, জানে, সে ভাবেই দেখতে চায়। তারা জেলা প্রশাসককে দৃঢ়, প্রত্যয়ী, সুবিবেচক ও শারিরীক, মানসিকভাবে সুস্থ হিসেবে দেখতে চান। তারা অপকর্মে লিপ্ত, ছিঁচ কাঁদুনে, ভগ্নদশা কাউকে জেলা প্রশাসকের চেয়ারে দেখতে চান না।

সবারই মনে রাখা উচিত সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যাক্তি বা অন্য কেউই জবাবদিহিতার উর্ধ্বে না। অপরাধী অপরাধীই। এর বাইরে অন্য কোনো দৃষ্টিভঙ্গীতে তাকে দেখা অনুচিত। ডিসির এই অঝোর ধারার কান্না থামাবে কে? তাকে অনতিবিলম্বে থামানো উচিত বিবিধ কারণে। যদিও বুঝাই যাচ্ছে যে, তাকে শান্ত করার, কান্না থামাবার মত এখন তার পাশে কেউ নেই। অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে তার স্ত্রী, সন্তান (যদি থাকে) তার পাশে থাকার মত অবস্থানেও নেই। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন হয়ত মুখ লুকোতেই ব্যস্ত। কলিগ যারা, তারা হয়ত নিজেদেরকে তার চৌহদ্দী থেকে উইথড্র করে নিয়েছে। ব্যাচমেটরাও অনুরূপ। হয়ত দু’ একজন হাই হ্যালো, শক্ত হও, মাথা গরম করো না, শান্ত হও টাইপের পরামর্শ দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে। এই বিপুলা বিশ্বে সেই ডিসি এখন মূলতঃ একা। বড় একা। মূলতঃ সেই ডিসি ধরা খেয়েছেন নৈতিকতার কাছে আর প্রযুক্তির কাছে।

আজ সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠেছে আনন্দ- বেদনার কারণ। বিশেষত রাজনৈতিকভাবে যারা প্রভাবশালী, যারা উদীয়মান তারকা, যারা সেলিব্রেটি, বিশিষ্টজন কিংবা যারা আমলা, ব্যবসায়ী বা আণ্ডার ওয়াল্ডের্র কেউ। মনে রাখা দরকার, যা কিছুই আমরা আড়াল রাখার চেষ্টা করছি তা মোটেই আর অনাবৃত থাকছে না। প্রযুক্তি ব্যবহারকারীরা তাদের সুবিধামত এটাকে ধারণ করে, প্রচার করে, নিজেদের সুবিধামত সময়ে তা ফাঁসও করে। কখনো কখনো তা বুমেরাং হয়েও ফিরে আসে। যেমনটি হয়েছে সেই ডিসির ক্ষেত্রে। এরিমধ্যে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এ আই) এর অপপ্রয়োগও শুরু হয়ে গেছে। অতএব, সাধু সাবধান। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

আনোয়ার হাকিম প্রযুক্তি প্রাসঙ্গিক ভাবনা মত-দ্বিমত সামাজিক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর