জীবনকে একেকজন একেকভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করে। বয়স, লিঙ্গ, সময় ও প্রতিবেশ ভেদে জীবনের সংজ্ঞা ভিন্ন হয়ে থাকে। একেবারে অশীতিপর বৃদ্ধাবস্থায় জরা-ব্যাধি যখন চতুর্দিক দিয়ে আক্রান্ত করে, যখন মুড়ি খাওয়ার মত করে ওষুধ গিলতে হয়, হাসপাতাল আর ক্লিনিকে টানাহেঁচড়া করতে করতেই জান বের হওয়ার উপক্রম হয়, যখন তীব্র শ্বাস কষ্টে অক্সিজেন মাস্ক বা সিলিণ্ডারে মুখ গুঁজে রাখতে হয়, যখন ডায়াবেটিসের প্রবল উৎপাতে কোন চিকিৎসাই স্বাভাবিকভাবে প্রয়োগ করা যায় না, তখন যাপিত জীবনের অর্থ যাই হোক, তাতে মধুরতার লেশমাত্র থাকে না। তখন সে জীবন ভারবাহী জীবন্ত লাশ হয়ে উঠে, মনে হয় এ যাতনার অবসান হোক, মৃত্যু যেন এর চেয়ে অনেক বেশি প্রিয়। অথচ সুন্দর এ ভুবন ছেড়ে চলে যেতে কারো মন চায় না।
একটা জীবন সময়ের সাথে সাথে কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, মানসিক বিকাশের সাথে সাথে স্বপ্নের জাল বুনতে শেখায়। ছেলেবেলায় স্বপ্নেরা পুতুল খেলার মত হরহামেশাই রঙ্গীন প্রজাপতির মত কেবলই ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়। তখন বাসের ড্রাইভারকে দেখে মনে হয় এটাই পৃথিবীর সেরা পেশা। আহা আমি যদি হতে পারতাম। গাড়ী নিয়ে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াতাম। আকাশ দিয়ে হাওয়াই জাহাজ উড়ে যেতে দেখলে মনে সাধ জাগত আহা যদি পাইলট হতে পারতাম। বাবা-মা, পরিবার, প্রতিবেশী এসে তখনই ছবক দিয়ে বলত, লেখাপড়া করে যে গাড়ী ঘোড়া চড়ে সে। সেটাকেই অভীষ্ট ধরে কত অধ্যবসায়, কত লেখাপড়া, কত কত পরীক্ষা! মাস্টার মশাইয়ের কান ডলা খাওয়া, লজ্জার মাথা খেয়ে ক্লাস রুমে বা স্কুল বারান্দায় বা প্রচণ্ড রোদে স্কুল মাঠে প্রকাশ্যে নীল ডাউন হয়ে বা দু’কান ধরে এক পা উঁচিয়ে অন্তহীন দাঁড়িয়ে থাকা ছিলো যেন সুস্থ জীবনের প্রয়োজনে স্বাভাবিক। আর পারিবারিক শিক্ষা তো ছিলো আরো কঠোর। সব কিছু ওই মানুষ হয়ে জীবন গড়ার জন্য। বয়সের বৃদ্ধির সাথে সাথে স্বপ্নের দ্রুত বাঁক পরিবর্তন হতে থাকে। পড়াশোনা শেষে বাস্তবের জগতে পা রেখেই জীবনের অর্থ কঠিন সমীকরণের হিসেবে মুখোমুখি হতে হয়। সেই থেকে স্বপ্নরা হতাশাক্রান্ত হতে শুরু করে।
জীবন-জীবিকায় কেউ সফলকাম হয়, কেউ মন্দের ভালো হিসেবে ‘যাই পাওয়া যায় তাই সই’ হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়। সেখান থেকেই স্বপ্নের তেজস্বতা ক্রমহ্রাসমান হতে থাকে। আর সংসারে যারা কামিয়াব হতে পারে না তাদের জন্য উপরের আকাশ দেখা বারণ, নিচের জমিন কাঠফাটা শক্ত কংক্রিটের মত দু:সহ হয়ে উঠে। সংসার জীবনে প্রবেশের পর জীবনের কার্ভ লাইভ সাপোর্টে থাকা রুগীর মনিটরের কাভের্র মত অস্থিরমতি হয়ে উঠে।
প্রেমে জীবনের অর্থ একরকম, সফলতায় এর পুলক ‘হ্যাপী টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি’। ব্যর্থতায় তা মাঝ আকাশে বিধ্বস্ত বিমানের মত ছিন্নভিন্ন। পেশাগত জীবনে কেউ রতি সুখের মত চরম পুলকিত, কেউ সো সো, আর কেউ জন্ম থেকেই জ্বলছিবৎ। কেউ সফল স্বামী, কেউ পয়মন্ত বউ। কেউ অথর্ব গাধা, কেউ অপয়া। কেউ যেন শূন্যতাই বয়ে বেড়ায়, কেউ অল্পকে সম্বল করেই ভালো আছি বলাতে ধাতস্থ। কারো আছে অঢেল, অগণিত। কারো থোরা থোরা আর কারো তা অধরা। সবই একজীবনে পাশাপাশি চলার চালচিত্র।
এক জীবনের জন্য আমাদের কত কিছু আয়োজন। আমাদের বিদ্যা লাগে, ভালো সার্টিফিকেট লাগে। তার জন্য কত মেহনত, কত কিছুর যোগাড়পাতি লাগে। কারো চাকরি লাগে, কারো ব্যবসা। তা না হলে জীবন চলে না। তাই পরীক্ষা দিতে হয় পদে পদে। ঘাটে ঘাটে বিছানো প্রতিবন্ধকতা টপকাতে হয় জীবনব্যাপী। আমাদের সুখ পাখী লাগে, তাই সুন্দরী বউ চাই। তার জন্য উপযুক্ততা লাগে। সে আরেক হিসেব। পরিবার লাগে। জেনেশুনে তার জোয়াল কাঁধে তুলে নিতে হয়। সেই জোয়াল আর কাঁধ থেকে নামানোর জো নেই। কেবলই সামনের দিকে টেনে নিতে হয়। ফিরবার পথ নেই, সেপথ অনিশ্চিত, বড়ই কঠিন, চড়া মাশুলযুক্ত।
তারাপদ রায়ের বিখ্যাত একটা কবিতার কয়েকটি চরণ স্মরণ না করে পারছি না…
একটা জন্ম জোড়াতালির, ভাত কাপড়ের তক্কে তক্কে
একটা জীবন মাথা গোঁজার ফন্দি খুঁজে,
একটা জীবন বাক্স মাথায় ভুল শহরে
ভুল ঠিকানায় ঘুরে ঘুরে,
একটা জন্ম এমনি এমনি কেটে গেলো,
একটা জীবন দেখতে দেখতে চলে যাচ্ছে।
জীবন সায়াহ্নে হিসেব কষতে গিয়ে অনেকেরই হয়ত এরূপ মনে হতে পারে। কেউ হয় তুষ্ট, কেউ বড় বেশি কৃতজ্ঞ। কেউ জীবনের ডেবিট-ক্রেডিটের ব্যালান্স কষতে গিয়ে হতাশ। মৃত্যুর অমোঘ নিয়মে চলে যেতে হয়, চলে যেতে হবে- এই বোধ আমাদের আত্মস্থ হয়ে আছে ছোটবেলা থেকেই। এই দেহ যখন লাশের উপাধি প্রাপ্ত হয় তখন তা দেখে সবাই আমরা বলে উঠি, “আমরা তো আল্লাহর এবং নিশ্চয় আমরা তার দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন)”। জীবনের এই অমোঘ সত্যকে মেনে নিয়ে মুহুর্তকাল থমকে দাঁড়াই। তারপরেই বেগের তাড়নায়, পেছনে পড়ে থাকার ভয়ে দৌড়াতে থাকি ঊর্ধ্বশ্বাসে। এভাবেই আমরা একেকজন একেক ভাবে জীবনকে টেনে নিয়ে যাই মৃত্যুর দিকে। কারো মধ্যে অনুশোচনা হয়, পাথেয়র পরিমাণ কম বলে পরপারের ট্রেনে উঠায় অজানা ভীতি জাগে। আফসোস দানা বাঁধে। কাফফারা দিয়েও হয়ত তার ঘাটতি পূরণ সম্ভব নয়।
আমরা এসবের সব জানি। কিন্তু রিপু আমাদের সার্বক্ষনিক সহযাত্রী হয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যায় এদিক সেদিক, দিকবিদিক। তখন বিবেকের ফ্যাকাল্টি মুমূর্ষু অবস্থায় থাকে। আবেগের পারদ টগবগ ঘোড়ার মত দিগবিজয়ের নেশায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। যেন, ফিরবার পথ নেই, থামবার কোন নীতি নেই, বিরতি মানেই যেন পিছিয়ে পড়া।
সমাজ এগিয়েছে। সমাজ চিত্র বদলেছে। সময়ের বরকত কমে যাচ্ছে। তৃপ্তির ব্যারমিটার উল্লফন যাত্রায় পেরেশান। বিবেক-বিবেচনা বোধ পার্থিব লাভালাভের উপর নিভর্রশীল। বিবেকের চেয়ে দলের কথা, দলের চেয়ে নেতার কথা শিরোধার্য। নীতির রীতি এখন সিলেবাসের সবচেয়ে কম জায়গা জুড়ে থাকে। স্বাথের্র কানাকড়িতে টান পড়লে খুনোখুনি কোন ব্যাপার না। অমুকের গাড়ী-বাড়ী আছে, ফ্ল্যাট আছে একাধিক দেশে-বিদেশে। তাই আমারও চাই। পড়শীর বিশাল ব্যাংক ব্যালান্স দেশে, বিদেশে। আমারও থাকা চাই। তার দৌড় সুইস ব্যাংক স্ট্যাণ্ডার্ড হলে আমার তো নিদেনপক্ষে সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, ইণ্ডিয়া, ব্যাংককে হওয়া চাই। টাকা কোথা থেকে আসে বা আসবে তার নির্দিষ্ট কোন খাত নেই, দৃশ্যমান কোন সোর্স নেই। অফিসের পিওনের ক্যাশ শত কোটি, মহল্লার হিরোইনখোরের পুঁজি শ’ শ’ কোটি বা ততোধিক। তাদেরও বাড়ী আছে বিদেশে। তারাও ফি বছর হজ্জ্ব করে, একাধিক উমরাহ করে সপরিবারে। টাকা এলো কোত্থেকে তার তালাশ করে না কেউ। এমনকি স্ত্রী, পুত্র-কন্যা বা স্বজনরাও না। ভোগের টার্গেট ফিক্সড। সাপ্লাইয়ের চ্যানেল চালু রাখতে তাই পেরেশান।
দান মেরে দান-খয়রাত হচ্ছে প্রচুর। ছওয়াব কামাইয়ের এ হেন খাত নেই যাতে অবদান নেই। কি শিক্ষিত; কি অর্ধশিক্ষিত; কি অশিক্ষিত দান মারায় কেউই পিছিয়ে নেই। সিণ্ডিকেট আছে, ফেডারেশন আছে, সলিড স্ট্রাকচারড অলিগার্ক আছে। তাই ভয় নেই। কুচ পরোয়া নেই। যাদের আছে বুদ্ধি অতিশয়, যারা বুদ্ধিজীবী নামধারী তাদের আবার আভিজাত্য আছে, নীতিকথাও আছে আবার ভাগবাটোয়ারা জ্ঞানও টনটনে আছে। রাজনীতিবিদদের কথার মাধুর্য অপরিসীম। সুইট টকার হিসেবে তারা সমাজে পরম পূজনীয়। তাদের একই অঙ্গে একাধিক রূপ, এক মুখে শত কথা। তারা স্বপ্ন জাগানিয়া। পাবলিক জেনেশুনে বিষ পান করে। আশাহত হয়। দুয়ো ধ্বনি দেয়। আবার কাছে ভিড়ে, অপুষ্ট হাত উঁচিয়ে শ্লোগানে শামিল হয়। না হয়ে উপায় নেই। দল ছুট মানেই হারিয়ে যাওয়া, নি:শেষ হয়ে যাওয়া, আম-ছালা দুটোই হারানো। সকল শ্রেণি পেশায়ই একই দশা। তাই বলে কি ভালো লোক নেই? আছে। তারা আছে গৃহকোণে, ব্যাকবেঞ্চে, বাইরের পরিত্যক্ত মাঠে, নদীর কিনারায় সংসারের ঘানি টানতে জোয়াল কাঁধে। সেখানে নিয়ম মেনে সূর্য উঠে, দিনের পালাবদলে সন্ধ্যা নামে। বাইরের কোলাহলে তাদের ভয় হয়, পদস্থদের কথায় তাদের আশা জাগে না, স্বপ্নরা আর তাদের কাছে স্বপ্ন দেখাতে আসে না।
এতক্ষণ যাদের চিত্র আঁকা হলো তাদের জন্ম চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকে। এদেরকে বুমার প্রজন্ম নামে অভিহিত করা হয়। এই বুমারদের অভিভাবকত্বেই বেড়ে উঠছে বর্তমানের জেন-জি প্রজন্ম। এরা স্ট্রেটকাট, কোনরকম ভুজুংভাজুংয়ে ভোলে না। প্রযুক্তি এদের হাতের মুঠোয়। এদের সামনে কেউ কোন চিত্র এঁকে দেয় নি। এরা তার ভ্রুক্ষেপও করে না। এরা রাত জাগে। দিনভর ঘুমোয়। রাত জেগে কি করে? কেউ জানে না। এদের কাছে ইনফরমেশন ইজ পাওয়ার। এরা বিশ্বের তাবত কিছু জানতে চায়। কিছু একটা স্ট্রাকচার দাঁড়া করাতে চায়। আমাদের মত ঘোড়েল বুমারদের মারপ্যাঁচে তারা বারবার হতাশ হয় আর ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠে। সময়ে তারাই বিস্ফোরিত হয়ে পথে নামে। স্বপ্নের বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়। অথচ ধুরন্ধর বুমারদের পাল্লায় পড়ে তাদের বিপ্লব বেহাত হয়ে যায়। স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। তাদের নিয়ে নানা কথা হয়। বলা হয় তারা পথভ্রষ্ট, বিপথগামী। তাদের কেউ কেউ মওকা পেয়ে রাতারাতি অবস্থা পাল্টে ফেলে। অস্থির সমাজ আরো অস্থির হয়ে উঠে। ফলতঃ কাঠামোগত মেরামত কাজ চাপা পড়ে যায়।
একটা জীবনের জন্য কত কি যে হচ্ছে, কত শত জারিজুরি যে করতে হচ্ছে তার কোন হিসাব-কিতাব নেই। খেলারামরা খেলে যাচ্ছে। পাবলিক যে যেমন পারছে নিজের মত করে খাচ্ছে। নীতি-নৈতিকতা কিতাবে লেখা আছে। যার যখন প্রয়োজন তা থেকে চয়ন করে ভাষণ দিচ্ছে, বয়ান তৈরি করছে। কেউ শুনছে, কেউ মানছে, কেউ হাসছে, কেউ প্রলাপ জ্ঞানে উড়িয়ে দিচ্ছে। আর চামে চামে ঘোড়েল কামেলিয়েরা তাদের কাম করে যাচ্ছে। আহারে জীবন!
লেখক: কলামিস্ট