অসুখ কোথায়?
১৫ জুলাই ২০১৮ ১৫:১৩
দেশে চিকিৎসকদের কাজকর্ম নিয়ে গণমাধ্যমে নানা বিতর্ক। চট্টগ্রামে সাংবাদিক কন্যা রাইফার মৃত্যু, ভুল চিকিৎসার অভিযোগ, সরকারি উদ্যোগে অভিযুক্ত ম্যাক্স হাসপাতালে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে র্যাবের অভিযান, প্রতিবাদে সাংবাদিকদের দায়ী করে বেসরকারি চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া – সবই হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হয়তো হতেই থাকবে। কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আসল অসুখ কোথায় তা হয়তো কোনদিনই জানা যাবেনা। জানার চেষ্টাও হবেনা।
দেশে সার্বিক চিকিৎসা অবকাঠামোর যে উপস্থিতি আছে তার সুব্যবহারের প্রচুর অভাব। রাজধানীতে রোগীর ভিড় সমালানো কঠিন হলেও জেলা ও উপজেলার হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার বড় অভাব। বাস্তবতা এই যে, যাদের আর্থিক সঙ্গতি আছে, তারা রোগী নিয়ে চলে যায় বিদেশে নয়তো যায় পাঁচ তারকা মানের দেশীয় হাসপাতালে।
স্বাস্থ্য নিয়ে এ দেশে রাজনীতি আছে। জাতীয় রাজনীতির বিভাজিত কদর্য রূপ, আরও কুৎসিত চিকিৎসক সমাজের ভেতরকার রাজনীতি। সেই আলোচনা হয় কম, যতটা হয় ভুল চিকিৎসা নিয়ে চিৎকার। ভুল চিকিৎসার অভিযোগ সমাধানের একটা গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নির্ণয় প্রয়োজন। এদেশের চিকিৎসক সমাজকে জনগণের সামনে পরিষ্কার করতে হবে- পেশাগত দায়িত্বহীনতা, অসততা আর অবহেলার কারণে এ পর্যন্ত কতজনকে শাস্তি দিতে পেরেছে বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল – বিএমডিসি। অন্যদিকে রোগীর মৃত্যু মানেই ভুল চিকিৎসা এই সাধারণীকরণ থেকে মানুষের বেরিয়ে আসাটাও খুব জরুরি।
সরকারি স্বাস্থ্য সেবার কাঠামোতে চিকিৎসা আছে, পরিবেশ নেই। যেখান থেকেই আসুক সরকারি হাসপাতালে ঢুকতে পারলে চিকিৎসা রোগী পাচ্ছে। তবে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র আর হাসপাতালের পরিবেশ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আর এই সুযোগে বিকেন্দ্রীকরণের নামে বলতে গেলে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাই ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়ে স্বাস্থ্যকে ব্যয়বহুল পণ্যে পরিণত করা হল। আর এটাই রাজনীতি। সব দলের লোক এখান থেকে মুনাফা চায়।
স্বাস্থ্য সেবার তিনটি স্তর – প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টার্শিয়ারি। প্রয়োজন রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পাবলিক হেলথ সিস্টেম। প্রশ্ন হলো আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে? সিস্টেম নানা ধরণের হয়তো গড়ে উঠছে, সরকারি বিনিয়োগও স্বাস্থ্য খাতে বাড়ছে, অনেক বড় অবকাঠামো দৃশ্যমান হচ্ছে। কিন্তু একইসাথে লাগামহীন ভাবে বেড়ে চলেছে চিকিৎসা ব্যয়। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ যে তারা ইচ্ছামাফিক ফি নির্ধারণ করছেন, ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন খাওয়ার জন্য অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছেন। চিকিৎসা খরচ বাড়াতে আরও ভূমিকা রাখছে ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়া, দালালদের তৎপরতা, রেফারেল পদ্ধতির অভাব। ফলে বিভাগীয় শহর কিংবা ঢাকায় রোগী নিয়ে আসাসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিনিয়তই চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। ব্যয়কৃত অর্থের বেশিরভাগই রোগীকে বহন করতে হচ্ছে। চিকিৎসা ব্যয় বাড়ায় অতি দরিদ্র মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
স্বাস্থ্যখাতের কাঠামোগত ঘাটতি পুরণে যথাযথ উদ্যোগ সরকারের কাছ থেকেই প্রত্যাশিত। কিন্তু সেই চেষ্টার থেকেও বেশি করা হয়েছে বেসরকারি সংস্থাকে স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা করানোর সুযোগ দেওয়া। স্বাস্থ্য নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের গলা ফাটাফাটি বেশি পরিমাণে চলছে বোধহয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেকে কতটা ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিতে পারে, তা নিয়ে। সরকারি চিকিৎসকদের এখন রমরমা অবস্থা এসব বেসরকারি হাসপাতালে। তারা গ্রামীণ জনপদে যেতে চাননা, নগরে বসে কাজ করেন বেসরকারি কাঠামোয়। সরকারি বেতনও আবার ঠিক মতই আছে।
গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সরকারি চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি এত বেশি যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে অনেকবার তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি বিশেষ হয়নি। যে ডাক্তারি পরীক্ষাগুলো তৎক্ষণাৎ করা দরকার, তারও সুবিধা গ্রাম পর্যায়ে নেই। আবার বেশি করে সরকারি ডাক্তার গ্রামের চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠালেই গরিব রোগী আরও উন্নত চিকিৎসা পাবে এমনটাও হয়তো বাস্তব নয়। কারণটা হলো উপস্থিত থাকা আর আন্তরিকভাবে চিকিৎসা সেবা দেওয়া, এক কখা নয়।
কম চিকিৎসক দিয়ে, কম খরচে অধিক কার্যকর চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোন চেষ্টা নেই এদেশের চিকিৎসক সমাজের মধ্যে। আবার যিনি গবেষণা করতে চান, তাকে রাষ্ট্র বা সরকার কতটা সহযোগিতা করছে তাও ভাববার বিষয়।
সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে কাঠগড়ায় তোলা যায় নানাভাবেই। কিন্তু বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে কেন এত খরচ তার কোন জবাবদিহিতা কোথাও নেই। আমরা হামেশাই মুক্ত বাজারের কথা বলি। কিন্তু মুক্তবাজারের স্বর্গ পশ্চিমা বিশ্বে ডাক্তাররা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে কত পারিশ্রমিক পান? নিশ্চিত করেই বলা যায় বাংলাদেশের মতো নয়। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর দৌরাত্ম নিয়ে ভুব একটা আলোচনা নেই। দেখা যায় একটির বিরুদ্ধ অভিযোগ উঠলে দল বেঁধে সব নেমে যায় তাকে রক্ষা করতে। চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। আর এসব কারণেই কোনও বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়তো দূরের কথা, নালিশ জানানোর অধিকারও যেন নেই মানুষের।
বাংলাদেশে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্র বাড়ছে বিধায় এই বিশেষ বিদ্যায় দক্ষ জনবল বাড়ানো অত্যাবশ্যক। অর্থাৎ ইমার্জেন্সি ডাক্তার, নার্স এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী বেশি করে লাগবে। জরুরি স্বাস্থ্যসেবার আরেকটি অনুষঙ্গ ফার্স্ট এইড। এ ব্যাপারে ব্যক্তি ও পারিবারিক সচেতনতার দরকার আছে। তবে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর যদি উপযুক্ত ডাক্তার-নার্স পাওয়া না যায়, তাহলে অনেক সাধারণ রোগীরও মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই জরুরি বিভাগের ডাক্তার-নার্সদের যেমন অধিক দক্ষ ও মানবিক হতে হবে, তেমনি তাদের দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। শুধু তাই নয়, পর্যাপ্ত টেকনিশিয়ানের উপস্থিতি ও তৎপরতাও আবশ্যক। কেউ অন-কলে থাকলে ডাকামাত্র তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। অনেক ডাক্তার দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও সময়মতো হাজির থাকেননা। অফিস টাইমে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন অনেকেই। তাদের সরকারি চাকরি করবার ও একে ব্যবহার করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালানোর অধিকার আছে কিনা ভাবা প্রয়োজন। বিশ্বাস করতে চাই যে, অধিকাংশ ডাক্তার নার্সই নিয়ম-কানুনের মধ্যে চলতে চান। কিন্তু কিছু ব্যক্তির জন্য তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়্। চট্টগ্রামে যেমনটা দেখা গেলো্ – এক বিএমএ নেতা পুরো শহরের স্বাস্থ্য সেবাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন, অন্য ডাক্তারদের সুনাম নষ্ট করছেন। তাদের ব্যাপারে শাস্তিমূলক কঠোর ব্যবস্থাই প্রত্যাশিত। এরা রাজনীতির জোরে সব ধরণের অন্যায়কে ন্যায় মনে করে।
সরকার বারংবার কাঠামোর কথা বলে। কিন্তু নীতি নির্ধারকদের ভাবতে হবে প্রশ্নটা জনস্বাস্থ্যের। জনস্বাস্থ্যকে অবহেলা করে শুধু বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ বা হাসপাতালকে ঝকঝকে করলে অসুখটা ধরা যাবেনা কখনোই।
সারাবাংলা/এমএম