জন্মদিনে স্মরণ: তাজউদ্দীনের ঘরের যুদ্ধও কম ছিল না
২৩ জুলাই ২০১৮ ১৬:৪৮
মুক্তিযুদ্ধের সঙ্কটকালে তাজউদ্দীন আহমদ ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সরকার গঠন ও যুদ্ধ পরিচালনায় যে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। নয় মাসের যুদ্ধকালে তাজউদ্দীন আহমদকে শুধু পাকিস্তানের বিরোধীতাই সহ্য করতে হয়নি। সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছিল ঘরের শত্রু বিভীষণও। সব ক্ষেত্রের শত্রুকে তিনি পরাজিত করতে পেরেছিলেন। আজ মহান এই নেতার জন্মদিন।
তাজউদ্দীনের মন্ত্রিসভার সব সদস্যই ছিলেন তার চেয়ে বয়সে বড়। খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর চেয়েও তিন বছরের বড় ছিলেন। তিনি মুজিবকেই হিংসা করে চলতেন, সেখানে তাজউদ্দীনের প্রধানমন্ত্রীত্ব তিনি মানতে পারছিলেন না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সব বিষয়ে নির্ভর করত তাজউদ্দীনের ওপর। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান প্রকাশ্যে বড় প্রতিক্রিয়া না দেখালেও ভেতরে ভেতরে তারা দুজনেই প্রধানমন্ত্রীত্ব পেতে চেয়েছিলেন। দালিলিকভাবে এসব বিষয়ে বড় প্রমাণ হাজির করা কঠিন। তবে কিছু ঘটনা সেই সময়ের পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করবে।
যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর পরিস্থিতি কী ছিল তার চাক্ষুস সাক্ষী বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রীপরিষদ সচিব হোসেন তৌফিক ইমাম। বর্তমানে তিনি এইচ টি ইমাম নামেই সমধিক পরিচিত। এখন দায়িত্ব পালন করছেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে। তিনি ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘ঐ পরিস্থিতিতে তাজউদ্দীন যে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তার তুলনা হয় না। অসীম ধৈর্য্য ছিল তার। কোনো প্ররোচনাতেই তিনি উত্তেজিত হতেন না। সে সময় মন্ত্রিপরিষদ সভায় কেউ কেউ মুখের উপর কাগজ ছুঁড়ে দিয়েছেন, এমন ঘটনাও আমার মনে আছে’।
তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রকাশ্যে তাজউদ্দীনের বিরোধীতা করে তাজউদ্দীনকে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগের আহ্বান জানান। আরও প্রচার করতে থাকেন, মুক্তিযুদ্ধের যা অবস্থা তার চেয়ে দেশে ফিরে গিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আপোস করা ভালো।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় সরকার গঠনকে কেন্দ্র করে চার যুব-ছাত্রনেতা তাজউদ্দীনের সর্বোচ্চ বিরোধীতা করেও সুবিধা করে উঠতে পারেননি। তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকের মাধ্যমে বুঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তিনিই সরকার গঠন করার দাবিদার শুধু নন যোগ্যতম ব্যাক্তি। তবে, ইন্দিরা গান্ধীর একান্ত আগ্রহে সেই চার যুব নেতা আলাদা বাহিনী করার সুযোগ নেন। এতেও তাজউদ্দীন বিরোধীতা থেকে সরে যাননি। ভারত সরকারের কাছে নালিশ করে তাদের প্রত্যাশিত ফল না পেয়ে এবার নিজ দলের মধ্যে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করেন। এতে যোগ দেন মন্ত্রীসভার সদস্য কুচক্রী মোশতাক ও তার কয়েকজন সহযোগী।
তাজউদ্দীনের প্রতি চার খলিফার এক খলিফার একদিনের আচরণের প্রত্যক্ষ সাক্ষী এম এ মোহাইমেন। ’৭০-এর এই জনপ্রতিনিধি তাজউদ্দীনের ঘনিষ্ট থাকায় মাঝে-মধ্যে তার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন মুক্তিযুদ্ধকালে প্রধানমন্ত্রীর দফতর ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে। তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে, সন্ধ্যার পর গিয়ে দেখি, দোতলার সিড়ির গোড়ায় দাড়িয়ে তাজউদ্দীন রাগে কাঁপছেন। কাছেই ছাত্রলীগের এক প্রভাবশালী নেতা দাড়িয়ে। এ নেতা তাজউদ্দীনের কাছে টাকা নিতে এসেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ কয়েকদিন আগেই তাকে একশ টাকা দিয়েছেন। এখন আবার দাবি অনুযায়ী টাকা না পেয়ে তাজউদ্দীনে সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে বলে উঠেছে, আপনি টাকা না দেওয়ার কে, টাকা আপনাকে দিতেই হবে। তাজউদ্দিনকে প্রতারক বলার ধৃষ্ঠতাও দেখিয়েছিলেন ওই ছাত্রলীগ নেতা, স্মৃতিচারণে বলেন মোহাইমেন। এই ঘটনার পর তাজউদ্দীন মোহাইমেনকে বলেন, এ ভার আমি আর বইতে পারছি না। কায়মনোবাক্যে প্রর্থনা করি শেখ সাহেব (বঙ্গবন্ধু) যতশীঘ্র হয় ফিরে আসুক। তাঁর হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি নিষ্কৃতি পেতে চাই।
মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক চ্যালেঞ্জ সামলাতে হলেও আনুষ্ঠানিক সবচেড়ে বড় ধাক্কা ছিল ১৯৭১ সালের ৫ জুলাই। এদিন জলপাইগুড়ি জেলার বাগডোরায় ’৭০-এর নির্বাচনে জয়ী নেতাদের নিয়ে পরিষদ বৈঠক বসে। ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করছিলেন ‘শয়তান’ মোশতাক। সে তার অনুসারীদেরকে দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করানো শুরু করেন। পরিষদের অন্য সদস্যরা সেইদিনের মতো সভা মূলতবি রাখতে অনুরোধ রাখছিলেন। মোশতাক তাতে কর্ণপাত না করে সভা চালিয়ে যান। তারই ইঙ্গিতে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নগ্নভাবে অযৌক্তিক বক্তব্য দিচ্ছিলেন পরিষদ সদস্য শেখ আবদুল আজিজ।
এমন পরিস্থিতি সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে ময়েজউদ্দিন নামের আরেক পরিষদ সদস্য কারও অনুমতি না নিয়ে মঞ্চে উঠে আবদুল আজিজকে শার্টের কলার ধরে মঞ্চের বাইরে পাঠিয়ে দেন। এরপর তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে তাজউদ্দীন সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে আবেগঘন এক বক্তৃতা উপস্থাপন করে। ময়েজউদ্দিনের বক্তৃতা চলাকালে মোশতাক বৈঠক ছেড়ে চলে যান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে বৈঠক চালান। বৈঠকে প্রায় ১৫০ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও ২৫০ জনের মতো প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হয় তাজউদ্দীন সরকারই বাংলাদেশের নেতৃত্বের আসনে থাকবে। এই বৈঠকের মাধ্যমে তাজউদ্দীনের ভিত্তি অনেক মজবুত হয়, এতে অন্যতম ভূমিকা রাখেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ভারতও বুঝতে পারে যে তারা ভুল মানুষের উপর নির্ভর করেননি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের যুব ও ছাত্র নেতাদের মুখোশও পরোক্ষভাবে উন্মোচন হয়। খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে মূলত এরাই বিভিন্ন জায়গায় বলে বেড়াচ্ছিল যে, তাজউদ্দীন সরকারের প্রতি বেশিরভাগ পরিষদ কোনো আস্থা নেই।
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতা অর্জনে তাজউদ্দীনের নেতৃত্ব তাকে দেশের সব সময়ের জন্য শ্রেষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীর আসনে রাখবে। মহান যুদ্ধজয়ী ‘বাংলাদেশের’ এই নেতার জন্মদিনে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।
বাহরাম খান, সদস্য তাজউদ্দীন আহমদ পাঠচক্র।
** এই নিবন্ধে উপস্থাপিত সকল মত লেখকের নিজস্ব
সারাবাংলা/এমএম