রাজনৈতিক ঐক্য না ঐক্যের রাজনীতি?
২৭ জুলাই ২০১৮ ১৩:২২ | আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৮ ১৩:২৭
।। এরশাদুল আলম প্রিন্স।।
নির্বাচনের আগে সমমনা দলগুলোর মাঝে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার তোড়জোড় শুরু হয়। সমমনা বলতে আসলে ক্ষমতার প্রশ্নে সমমনা। আদর্শের প্রশ্নে রাজনৈতিক ঐক্য একটি কঠিন ব্যাপার। অবশ্য রাজনীতিতে ক্ষমতাই মূল আদর্শ। সেই আদর্শের জন্য রাজনৈতিক ঐক্য মানে নিজেদের মাঝে ক্ষমতার একটা ভাগাভাগি আরকি। এটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোতেই একই সংস্কৃতি বিদ্যমান। এর ভালো-মন্দ নিয়ে একাডেমিক আলোচনা হতে পারে, কিন্তু এর বাস্তবতা এড়িয়ে অন্তত আমাদের রাজনীতি চলবে না। নির্বাচন আসলেই তাই জোট গঠনের তোড়জোর শুরু হয়।
এই দৌড়ঝাপ জাতীয় নির্বাচন হোক আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক; সব ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। সবকিছু ঠিক-ঠাক থাকলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সে অনুযায়ী অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা হবে। তফশিল ঘোষণার পর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলগুলো পুরোপুরি নির্বাচনের মাঠে নামবে। তখন প্রচার প্রচারণাই মূল কাজ। ফলে তফশিল ঘোষণার আগে আগামী দুই মাস ছোট-বড় দলগুলো পুরোপুরি ব্যস্ত থাকবে জোট গঠনের কাজে। সেই সাথে বড় দলগুলো নির্বাচনের মাঠ গরম করার কাজটিও সমান তালে করে যাবে।
ক্ষমতাসীন দল এরইমধ্যে নির্বাচনের মাঠ গরম করতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনার অন্তরালে একটি প্রাক-নির্বাচনী মহাসমাবেশ করে ফেলেছে। বিএনপি খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে যাবে না বললেও নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করে দিয়েছে। যেকোনো গণতান্ত্রিক দলই নির্বাচনমুখী। বিএনপিও তাই করছে। এটি আশাব্যঞ্জক।
১৪ দলীয় জোটের মধ্যে আপাতত কোনো দলাদলির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাদের জোট সদস্যদের মধ্যে জোট ভেঙে নতুন জোট গঠন করার তেমন কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। এর মাধ্যমে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ক্ষমতায় থাকতে জোটের সদস্য হিসেবে বড় দল আওয়ামী লীগ তার অপরাপর শরীকদের সন্তুষ্ট করতে পেরেছে। অথবা ১৪ দলের কোনো সদস্য বিএনপি কেন্দ্রীক জোটে গিয়ে তেমন সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না-এমন ধারণা থেকেই হয়তো পুরান সংসার রেখে নতুন সংসার গড়ার দিকে তাদের মন নেই। তবে, বিদ্যমান ১৪ দলীয় জোটের মধ্যেই আগামী নির্বাচন কেন্দ্রীক আসন ভাগাভাগিতে কোনো মতভেদ যে একেবারেই হবেনা এমন কথা বলা যাবে না। মোটামুটি তফশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত জোটের মধ্যে আসন ভাগাভাগির দেন-দরবার চলতেই থাকবে। সেই সাথে, জোট সদস্য ১৪ থেকে বাড়ানোর চেষ্টাও হতে পারে।
বিএনপি কেন্দ্রীক ২০ দলীয় জোট আসলে কোনো দৃশ্যমান জোট নয়। রাজনীতির মাঠে বিএনপি জোটের অন্যদলগুলোর দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা ছিল না। শুধুমাত্র জামায়াত এ সরকারের আগের আমলে কিছু কর্মকাণ্ড দেখিয়েছিল। সেটি বরং বিএনপির জন্য নেতিবাচক ফলই বয়ে এনেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচীর কথা বাদ দিলেও, ২০ দলীয় জোট তেমন কোনো যৌথ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। এমনকি যৌথ সংবাদ সম্মেলন বা যৌথ বিবৃতির ক্ষেত্রেও এই জোটের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। গণমাধ্যমেও তাদের উপস্থিতি তেমন ছিল না। যেটি এসব জোট সদস্যদের মূল কাজ ও পুঁজি।
এই দুই জোটের বাইরে গিয়েও বিকল্প জোট গঠন করার একটি ধারা এ সরকারের আমলেই তৈরি হয়েছে। কিন্তু নেতৃত্ব ও স্থায়ীত্বের প্রশ্নে এই জোট দীর্ঘমেয়াদী হতে পারেনি। সেই সাথে আজ পর্যন্ত কোনো জাতীয় নির্বাচনেই এরা সম্মিলিতভাবে প্রার্থীও দিতে পারেনি। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি, ড. কামাল হোসেন, বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে একটি জোট গঠন হয়েছিল। কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদি হয়নি। বিকল্প একটি জোট গঠনের এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। তবে তা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটিই দেখার বিষয়।
উপরোক্ত ওই তিনজনের বাইরে নতুন করে যোগ হয়েছেন আ স ম আবদুর রব ও মাহমুদুর রহমান মান্না। এই পাঁচজন মিলে একটি জোট গঠনের কথা অনেক দিন থেকেই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু তা এখনো আলোতে আসেনি। আদৌ এ জোট গঠন হবে কিনা তা এখনো বলা যাচ্ছে না। কারণ, ইতিমধ্যেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেছেন। এ সৌজন্য সাক্ষাতের পরিণামে যদি ভালো কিছু ইনাম মেলে তবে কেন এই নতুন জোট? বি. চৌধুরী হয়তো বিএনপিতে আর যেতে পারবে না। কিন্তু এক ঘরে থাকতে না পারলেও এজমালি পুকুরে সাঁতারকাটাই বা মন্দ কিসে? কাদের সিদ্দিকীর সাথে আওয়ামী লীগের বাবা-ছেলের সম্পর্ক বা ভাই-বোনের সম্পর্কের কথা তিনি গত নয় বছরে বহুবার বয়ান করেছেন। বোনের (শেখ হাসিনার) আহ্বানে তিনি সাড়া দেবেন না এটা হতেই পারে না। কাজেই, কাদের সিদ্দিকী আসলে কাদের এটা সময়ই বলে দেব।
কিন্তু ভোটের মাঠে এই পঞ্চপাণ্ডবের দৌড় কতটুকু তা তারা নিজেরাও জানেন। ব্যক্তিগত ইমেজ আর ভোটের আমেজ এক না। নিজের আসনে জয়ী হওয়া আর জাতীয় নির্বাচনে নিজ জোটের প্রার্থীদেরকে জয়ী করে আনা এক কথা না। কত আসনে তারা প্রার্থী দিতে পারবেন সেটাই বড় প্রশ্ন। পৃথক নির্বাচন করাতো অনেক পরের কথা। সেটি দোষের কিছু নয়। দ্বিদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিকল্প দল ও জোটের পক্ষে বেড়ে ওঠা কঠিন। বিশ্বব্যাপী এটিই নজির। ফলে, এই জোটের (যদি জোট হয়) নেতৃবৃন্দ বিকল্প জোট না করে যদি নৌকায় ওঠে বা ধানের ক্ষেতে নামে তবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বদরুদ্দোজা চৌধুরী ইতিমধ্যেই ১৫০ আসনের একটি ফর্দ মির্জা ফখরুলকে ধরিয়ে দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগও বসে নেই। নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা তাদের জোট সদস্য ১৪ থেকে আরো বাড়ানো যায় কিনা সে চেষ্টার একটা নমুনা দেখা গেছে। মধ্য বামপন্থিরা তো আওয়ামী জোটে আগে থেকই আছে। এবার আওয়ামী লীগ ‘আসল বামপন্থী’দের (এই বামপন্থিদের ভাষায়) জোটে ভিড়ানোর একটা চেষ্টা করবে যাতে ভোটের মাঠে আরেকটু জোয়ার সৃষ্টি করা যায়। নির্বাচনের আগে ছোট-বড় সব দলের মাঝেই সৌজন্যবোধ জাগ্রত হয়। তারই নমুনা জাহির করেছেন ওবায়দুল কাদের। তিনি সিপিবি সভাপতি মোজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সাথে ‘সৌজন্য সাক্ষাত’ করেছেন। বাসদ নেতার সাথে যদিও এখনো ওরকম সৌজন্য সাক্ষাত’ হয়নি। তারা উভয়েই আবার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ভিত্তিতে যারা রাজনীতি করছেন তাদের সাথে জোট গঠনের সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেননি। এর মাধ্যমে মূলত তারা আওয়ামী লীগের দিকেই ইঙ্গিত করছেন।
বিএনপি এখন মূলত সরকার বিরোধী একটি জাতীয় ঐক্য গড়তে চায়। আর আওয়ামী লীগ চায় মু্ক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সাথে ঐক্য। এ ঐক্য মূলত ভিভাজনের ও ভোটের। রাজনৈতিক আদর্শের সাথে এ ঐক্যের রক্তের সম্পর্ক নেই। ভোটের জন্য মূলত এ এক রাজনৈতিক ঐক্য, আদর্শিক ঐক্য নয়। তাই এটি ঐক্যের রাজনীতিও নয়।
নির্বাচনের আগে এজাতীয় ঐক্য গড়ার প্রয়োজন বড় দলের চেয়ে ছোট দলের আরো বেশি। ছোট দলগুলো নৌকায় না উঠলে অথবা ধানের শীষে যোগ না দিলে ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে পারবেন না-সে উপলব্ধি তাদের আছে। কাজেই ভোটের আগে ছোট দলগুলোর নেতৃবৃ্ন্দের(তারা অবশ্য নিজেদের ছোট দল বলতে নারাজ) আওয়াজ আরো উঁচু হয়। এতে নেগোশিয়েশন বা দেন-দরবারে সুবিধা হয়। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে অনেক দলের নেতাই এসরকারের আমলে মন্ত্রী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন তাদের অনেকে।
নির্বাচনের আগে এ জাতীয় জোট গঠন রাজনীতি বা গণতন্ত্রের সাথে কতটা সঙ্গতিপুর্ণ বা উপকারী সে আলোচনা তাত্ত্বিক হলেও প্রাসঙ্গিক। তবে তা আরেক দিন।
আমাদের দেশে মোটামুটি তিন দশক ধরেই এই জোট গঠনের একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চলছে। তবে, শুধু জোট গঠনের ফলেই কেউ ক্ষমতায় গিয়েছে এটা বলা যাবে না। তিন দশকের ক্ষমতার পালাবদল মূলত ক্ষমতাসীনদের প্রতি বিদ্যমান অসন্তুষ্টিরই ফল। এ ধারাবাহিকা আজো আছে। সেখানে জোট গঠন করে ভোটের মাঠ গরম করা যেতে পারে, কিন্তু ভোটের হাওয়ার গতি পরিবর্তন করা যায় না।
কিন্তু তারপরও ভোটের জন্য এ জোট গঠন প্র্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। ভোটের কুরুক্ষেত্রে কুশীলবরা একটু সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থান করার জন্যই এ পজিশন। কাজেই এটি অবস্থানগত, আদর্শিক নয়।
এরশাদুল আলম প্রিন্স, আইনজীবী ও কলামিস্ট