আমার ভোট, আমার ক্ষমতা
২৯ জুলাই ২০১৮ ২২:১৫
।। কবির য়াহমদ ।।
জীবনে প্রথমবার যখন ভোট দিয়েছিলাম, সেটা ছিল ভীষণ উত্তেজনার। নাগরিক ক্ষমতার প্রয়োগের চাইতে নতুনত্ব, আবিষ্কারের নেশা কিংবা উন্মাদনা ছিল সেখানে। ঘোর কিংবা মোহ ছিল পুরোটাই। নির্বাচনের আগ থেকে শুরু করে নির্বাচনের দিন হয়ে পরের আরও কয়েকদিন পর্যন্ত ছিল সে উত্তেজনা। এরপর একে একে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, জাতীয় নির্বাচনসহ অন্য আরও কিছু নির্বাচনে ভোট দিলে সেই উন্মাদনা কিছুটা কমেছে; তবে আগ্রহ আছে সেই শুরুর সময়ের মতোই। এটাই সম্ভবত নির্বাচন আর ভোটদানের আনন্দ, যা ম্রিয়মাণ হওয়ার নয় কোনোকালেই।
একটা সময় নির্বাচনের সময় স্লোগান ছিল- ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো’। এরপর এই স্লোগানে কিছু পরিবর্তন এসেছে। এখনকার স্লোগান- ‘আমার ভোট আমি দেবো, দেখে-শুনে-বুঝে দেবো’। এই দেখে-শুনে-বুঝে দেওয়ার বিষয়টি সর্বোচ্চ সচেতনতা আর দায়িত্বশীলতার স্মারক। কিন্তু মেনে চলার ক্ষেত্রে দেশের কত শতাংশ লোক সেটা অনুসরণ করে, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। নাগরিকদের সবাই সচেতন ও দায়িত্বশীল নয়; বরং অধিকাংশই পূর্বসিদ্ধান্তে ভোট দিয়ে থাকে। কেউ কেউ আবার ভোট দিয়ে থাকে হাওয়া বুঝে। ফলে ‘দেখে-শুনে-বুঝে’ ভোট দেওয়ার বিষয়টি স্রেফ স্লোগান হিসেবেই থেকে যায় এবং যাচ্ছে।
ভোটাধিকার প্রয়োগের এই নাগরিক অভ্যাসের বদল হয়তো একদিন হবে। সে দিন কবে, সেটা এখনও আমরা জানি না। তবে আশা করতে দোষ কী! কারণ একটা সময়ে আমাদের ভোট ছিল, কিন্তু সেটা অধিকারের পর্যায়ে ছিল না। আগে যেখানে প্রায়ই ঘোষণা দিয়ে ভোটাধিকার হরণ করা হতো, এখন সে প্রবণতা কমেছে অনেকটাই। তবে নাগরিক অধিকার হরণের এই অনুশীলন যে এখন নেই, তা-ও নয়। তবে সেটা করতে গিয়ে এখন বিভিন্ন ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। এই কৌশলের চূড়ান্ত রূপ অধিকার হরণ হলেও কৌশলীদের সমর্থকগোষ্ঠী সেটাও জায়েজ করার জন্য ফন্দি খুঁজতে ব্যস্ত। ফলে ভোট আছে, অধিকার আছে, প্রয়োগের কথা কিংবা আহ্বানও আছে; তবে সঙ্গেও আছে বিভিন্ন ধরনের শর্ত আর বাধা।
ভোটাধিকার প্রয়োগে নাগরিক যে সব ক্ষেত্রে ‘দেখে-শুনে-বুঝে’ ভোট দিচ্ছে, তা না। এমনকি যারা নিজেদের শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিক বলে দাবি করে থাকেন, তারাও না বোঝা জনগোষ্ঠীর মতোই নির্দিষ্ট ব্যক্তি-দল বা প্রতীকে ভোট দিতে প্রতিজ্ঞ। অথচ এই জনগোষ্ঠীর মাধ্যমেই যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার কথা ছিল।
বাংলাদেশের বিভিন্ন নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থক। ৩০ শতাংশের বেশি মানুষ যেখানে একেকটি দলের সমর্থক হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করেন, তখন দলীয় সমর্থনের বাইরের ভোটারদের সংখ্যা আদতে নগণ্য হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির এই নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটারের সংখ্যা ৬০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছালে বাকি যে ৪০ শতাংশের মতো ভোটার থাকে, তাদের বেশিরভাগই আদতে নির্বাচনে ভোট দেননি বা কোনো নির্বাচনেই এই ভোটাররা ভোট দিচ্ছেন না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই দুই দলের মধ্যে কি যোগ্য লোক নেই যারা নির্বাচিত হচ্ছেন? হ্যাঁ, আছেন; তবে তাদের সবাই-ও যে যোগ্য, সেটা নিশ্চিত করে কেউ বলতেও পারবে না। তাদের অধিকাংশই দলের নাম ও প্রতীকের কারণে জয়ী হচ্ছেন। এই জয়-পরাজয়ে মাঝখানে দলের নাম ও প্রতীক মুখ্য ভূমিকায় থাকায় আড়ালে পড়ে যায় প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা। দল ও প্রতীকের ওপর নাগরিকদের ভোটদান নির্ভর করায় দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও প্রার্থী যাচাইয়ে আশানুরূপ সতর্কতা ও সাফল্য দেখাতে পারছে না, বা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এতে সামগ্রিকভাবে আমাদের গণতন্ত্রই দুর্বল হচ্ছে, নাগরিক অমনোযোগিতা ও অসচেতনতায় কম যোগ্যদের গলায়ও উঠছে বিজয়ের বরমাল্য।
বলবেন, যোগ্যতা নিরূপণের মাপকাঠি কী? যোগ্যতার প্রশ্নাতীত সংজ্ঞায়ন হয়তো হয় না, এটা একান্তই ব্যক্তির নিজস্ব ধারণাগত। তবে সামর্থ্য, দক্ষতা, উপযুক্ততা, উপযোগিতার মতো শর্তগুলোকে যোগ্যতা পরিমাপে অপরিহার্য হিসেবে নিলে আমি নিশ্চিত, অনেকেই নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়ে ভড়কে যাবেন। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এ পর্যন্ত আমার ভোট পাওয়া অনেকেই এমন অপরিহার্যতা পূরণ করতে পারেননি, তবু ভোট দিয়েছিলাম; হয়তো কোনো দল, প্রার্থী, প্রতীক কিংবা নির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচির প্রতি দুর্বলতায়, অথবা অন্যের অযোগ্যতায়। এটা এখন উপলব্ধি করছি দৃশ্যত দেরিতে। তবে যতক্ষণ গণতন্ত্র আর ভোটাধিকারকে চলমান প্রক্রিয়া ও কর্মসূচি হিসেবে আমরা দেখছি, ততক্ষণ এটা চূড়ান্ত দেরি হওয়ার মতো নয়।
‘দেখে-শুনে-বুঝে’ ভোট দেওয়ার যে স্লোগানে এখন আমরা আছি, এর শর্ত পূরণে নিশ্চিতভাবেই যোগ্য প্রার্থী দরকার। একইসঙ্গে দরকার সচেতন ভোটার। এই সচেতনতা ততক্ষণ আসবে না যতক্ষণ আমরা কোনো নির্দিষ্ট দল কিংবা দলগুলোকেই আমাদের ভোটের গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করব। আমাদের প্রায় ৬০ শতাংশ ভোটার যেখানে দুইটি নির্দিষ্ট দলের নিয়মিত ভোটার, সেখানে ‘দেখে-শুনে-বুঝে’ কতটুকু ভোট দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়!
যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন শুরু হওয়ার কথা ছিল শিক্ষিত, সচেতন জনগোষ্ঠী থেকে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই নির্দিষ্ট দলের নির্দিষ্ট ভোটার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার পথে। ফলে কাঙ্ক্ষিত সচেতনতা কিংবা পরিবর্তনের আশাটা মার খাচ্ছে প্রবলভাবে। অথচ দেখে-শুনে-বুঝে ভোট দেওয়ার অনুশীলনটা তাদের মধ্য দিয়েই শুরু হওয়ার কথা ছিল। তারা সেটা করতে পারলে তার প্রভাবটা অন্যদের ওপর পড়তে পারত। এতে করে সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশটাই পরিবর্তন হতো।
নির্দিষ্ট দলের নির্দিষ্ট ভোটারদের বাইরে আরও অনেক ভোটার আছে, যাদের বলা হচ্ছে ‘ভাসমান ভোটার’। বলা হয়ে থাকে এই ভাসমান ভোটারেরা যেকোনো দলের জয়-পরাজয়ের নির্ণায়ক। খেয়াল করলে দেখা যায়, এই ভোটগুলো হয় আওয়ামী লীগ, নয়তো বিএনপির দিকে ঝুঁকে থাকে। এটা যতটা না ‘পজিটিভ ভোট’, তারচেয়ে বেশি ‘নেগেটিভ ভোট’। নেগেটিভ ভোটগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সর্বশেষ ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষেই প্রয়োগ হয়ে আসছে। ফলে দেখা যায়, নব্বইয়ে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর একেক নির্বাচনে একেক দলের পক্ষে ও বিপক্ষে পড়েছে ভোটগুলো।
সর্বশেষ নির্বাচন এবং এর আগের কয়েকটি নির্বাচনসহ আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী, দেশের ৩৫ শতাংশের বেশি ভোটার তাদের সমর্থক। গত কয়েকটি নির্বাচনের তথ্য বিশ্লেষণ করলে এই দাবির সত্যতাও মেলে। এই ভোটগুলোকে তাদের শক্তির দিক হিসেবে বিবেচনা করলে দুর্বল দিক হচ্ছে- ৬৫ শতাংশের কাছাকাছি ভোটে তাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নেই। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল বিএনপির নিজস্ব এমন ভোট ৩০ শতাংশ হলে বাদবাকি ভোটগুলোর ‘ভাসমান ভোটার’দের পজিটিভ কিংবা নেগেটিভ ভোটেই জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে দিতে পারে। তাই এই ৩৫ শতাংশ, কিংবা ৩০ শতাংশ দিয়েই নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়া সম্ভব না; এবং এটাই হয়ে আসছে। নিজস্ব ভোট দাবির এমন শতাংশের হিসাব স্রেফ একটা সংখ্যা হিসেবেই শেষ পর্যন্ত পরিগণিত হয়, যদি না ভাসমান কিংবা নীরব ভোটারদের নিজেদের পক্ষে না নিয়ে আসা যায়।
বলা হতে পারে, তাহলে কি আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে যোগ্যতম কেউ থাকে না? হ্যাঁ, থাকে; অবশ্যই থাকে। তবে অনেক জায়গায় অনেককেই বলতেও শোনা যায়, ‘শেষ পর্যন্ত মন্দের ভালোকে বেছে নিতে হচ্ছে, বা নিলাম’। এই ‘মন্দের ভালো’ নির্ধারণ করলে দেখে-শুনে-বুঝে ভোট দেওয়া হয় না আদতে, বাধ্য হয়েই ভোট দিতে হয়। এখানে ভোটারের স্বাধীনতার বিষয়টি প্রকাশিত হলেও প্রার্থীর যোগ্যতা নির্ধারণ হয় না। এখানে ভোটদাতার প্রায়োগিক ইচ্ছের প্রতিফলন হলেও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিফলন হয় না মোটেও; এটা হলে দেখে-শুনে-বুঝে ভোট দেওয়ার স্লোগান ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হতো।
আমার ভোট আমার ক্ষমতা, আমার অধিকার। ক্ষমতা ও অধিকারের এই স্বীকৃতি কাগজে-কলমে আছে ভালোভাবেই। ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে আমরা এখনও ‘যাকে খুশি তাকে’ ভোট দেওয়ার পর্যায়ে। এ থেকে আমাদের উত্তরণ দরকার। উত্তরণের শুরুটা আপাত ‘দেখে-শুনে-বুঝে’ দেওয়ার স্লোগানে শুরু হয়েছে, একটা সময়ে এটা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও হবে বলে বিশ্বাস করতে চাই।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/টিআর