এক জোড়া পিটি সুজ: কোনো চকে মুছবে না রক্তের ছোপ!
৩১ জুলাই ২০১৮ ২১:২০
|| মাহমুদ মেনন, নির্বাহী সম্পাদক ||
সাদা রঙের এক জোড়া পিটি সুজ। তার ওপর ছোপ ছোপ লাল রক্ত। আহা! ছেলেটির মাথার চামড়া ফেটে বের হয়ে আসা রক্ত বেয়ে বেয়ে পড়েছে। সারা শরীর জুড়ে তার রক্তের দাগ। গায়ের সাদা জামা। সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি, সাদা প্যান্ট। সব কিছুতেই রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাতে সাদা পিটি সুজ জোড়াও বাদ যায়নি।
মনে পড়ে গেল, আমরা যখন এই পিটি সুজ পরে স্কুল কিংবা কলেজ করতাম, কিছুদিন পর ধুলো ময়লায় নষ্ট হয়ে গেলে ধুয়ে খড়ি (চক) ঘষে নিতাম। আবার সাদা জুতো, নতুন নতুন দেখতে হতো।
আবদুল হাদীর জুতো জোড়াও ছিল নতুনের মতো। কে জানে হয়তো সেও চক ঘষেই সাদা বানিয়েছিল ওইদিন। কিংবা ছিল সত্যিই নতুন কিংবা কিছু দিনের সামান্য পুরোনো। তবে সেই সাদা জুতো জোড়াই আজ রক্তে রঞ্জিত।
আবদুল হাদীর আর কতই বয়স? ১৬ কিংবা ১৭। স্কুলের গোণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পড়ছে। হাদি এসেছিল বন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানাতে। আরো বন্ধুদের সাথে। ওদের বয়স তো প্রতিবাদেরই। বন্ধুর রক্তে রাঙা আলোর মাতাল ভোরে… কে কি বলবে তা-কে হেলায় তুচ্ছ করে নিজের পুচ্ছটি উচ্চে তুলে নাচাতে এসেছিল এই দুরন্ত- কাঁচাপ্রাণের তরুণেরা।
প্রতিবাদী না হয়ে ওদের আর কী-ই উপায় ছিল? ওদের সমবয়সী ও সহপাঠী দুই বন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের পিষে দিয়ে গেছে রাস্তায় অবৈধ ঘাতক বাস। কলেজ শেষে নিজ কলেজের সামনের সড়কেই প্রকাণ্ড সূর্যের ঠিক নিচে বলি হয়ে গেল নির্দোষ দু’টি প্রাণ।
প্রতিবাদ না করলে ওদের জন্য রবীন্দ্রনাথের আহ্বান মিথ্যা হয়ে যাবে। ওদের নিয়ে কাজী নজরুলের সকল প্রত্যাশা অপূরণ থেকে যাবে। ওরাই তো দেখাবে শক্তি। তারুণ্যের শক্তি। ওরা যখন দেখাবে আমরা সচেতন রয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের চেতনা জাগরুক, তখনইতো টনক নড়বে সেই শক্তির যারা অন্য সকল শক্তিকে, বিশেষ করে চেতনার শক্তিকেও তুচ্ছ জ্ঞান করে।
সুতরাং প্রতিবাদ হবেই। হাদী, সপ্নীল ও উদয়রা নেমে আসবে রাস্তায়। ওদের গায়ে থাকবে স্কুলের সাদা পোশাক, পায়ে সাদা পিটি সুজ। সেই শুভ্র সাদায় ওরা প্রতিবাদ জানাবে- হাতে প্ল্যাকার্ডখানা ধরে- যাতে লেখা থাকবে- উই ওয়ান্ট জাস্টিস।
সড়কে মৃত্যুর মিছিল নতুন নয়। তাতে শিক্ষার্থীর প্রাণহানিও নতুন নয়। তবে সে মৃত্যুর ঘটনায় ভেদ আছে। আমরা শোকের সাগরে ভেসেছিলাম যখন স্কুলের শিশুগুলো ফুটবল খেলে ঘরে ফিরতে গিয়ে ট্রাক উল্টে পড়েছিল খাদে। চোখের জলে আমরা খাদ থেকে তুলে এনেছিলাম লাশের পর লাশ। কোই প্রতিবাদতো করিনি। কারণ সেটি ছিল নিছকই দুর্ঘটনা।
কিন্তু একি দেখলাম আমরা। নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির তাজা তরুণ পায়েল কী অপরাধ করেছিল। দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর সড়ক পাশে পড়ে থেকে যে মৃত্যু, সেটিও জুটলো না ওর ভাগ্যে। ঘাতকেরা ওকে পানিতে ফেলে দিয়ে পালালো। কতটা পিশাচ হলে মানুষ এই কাজটি করতে পারে। কী অপরাধ ছিল রাজীবের। যার একখানি খণ্ডিত হাত, পেন্ডুলামের মতো ঝুলে ছিল দুই বাসের মাঝে। রাজীবকে বাঁচানো যায়নি।
আর রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে স্রেফ পাল্লাপাল্লির জেরে পিষ্ট করে দিয়ে গেল দুটি তাজা প্রাণ। একজন আবদুল করিম, অপর জন দিয়া খানম। আরো বন্ধুদের নিয়ে ওরা রাস্তার পাশে ছিল বাসের অপেক্ষায়। তখনই রাস্তায় রুট পারমিট ছাড়া অবৈধ বাস জাবালে নূর যাত্রী তোলার পাল্লাপাল্লিতে পিষ্ট করে গেল ওদের। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বিমানবন্দর সড়কে সেই বাসচাপায় আহত হয়েছে আরো ১৩ জন।
এমন হতাহতের পর কে থাকবে ঘরে বসে? বিনা কারণে বেঘোরে প্রাণ হারানো বন্ধু-সহপাঠীর হত্যার প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ হবেই। এটুকু মেনে নেওয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্যও জরুরি। অবরোধ প্রতিবাদেরই ভাষা। হ্যাঁ, একটু কঠোর ভাষা বটে। তবে এর চেয়ে সহজ ভাষার কোনো প্রতিবাদ কোনোকালে শুনেছে, কিংবা গুরুত্ব দিয়েছে কর্তৃপক্ষ? শোনেনি। দেয়নি।
আর তাজা তরুণের প্রতিবাদেও থাকবে প্রাণ। আমাদের স্কুল কলেজের তরুণ তাজা ছেলে-মেয়েগুলো সে কাজটিই করেছে। কিন্তু ওদেরও দমাতে আমাদের হাতে উঠে এলো হাতিয়ার। রাইফেলের বাটে আমরা ওদের মাথায় আঘাত হানলাম। তাতে রক্ত ঝরলো আবার। প্রাণহানির প্রতিবাদে নেমে রক্তহানি। সেওতো নতুন কিছু নয়! অতীতে হয়েছে। এখন হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে। কারণ এই প্রতিবাদের চেতনাই জাতির শক্তি। সে শক্তির প্রমাণ আমরা পেয়েছি সবকালে।
তবে দেখার বিষয় তাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের টনক কখন নড়ে। ওরাতো সুনির্দিষ্ট কিছু দাবিও সামনে এনেছে। কারণ এ ধরনের ঘটনা যে নিছক দুর্ঘটনা নয়, স্রেফ হত্যাকাণ্ড তা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই বুঝতে পারবেন। তাই হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধের শাস্তি ওরা চাইছে ঘাতকের। ওরা চাইছে নিরাপদ সড়ক, স্বাভাবিক চলাচলের নিশ্চয়তা। আর চাইছে একজন মন্ত্রীর ক্ষমা প্রার্থনা ও দুঃখ প্রকাশ। সে মন্ত্রী বাহাদুর তো এ ঘটনার পর আরো বেফাঁস মন্তব্য করে ফেঁসেছেন। মিডিয়া তাকে তুলোধুনো করেছে বটে। তবে এসবে তার হয়তো কিছু আসবে যাবে না। কারণ নানা কাজের (অপকর্ম অর্থে) কাজী এই মন্ত্রী বহাল তবিয়তেই থাকবেন। এমনি এমনি হাসা এই মন্ত্রীই আসলে পরিবহন শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করেন, আশকারা দেন। তারই সুবাদে তারা আহত যাত্রীকে খালে ফেলে দেওয়ার, সড়কের পাশে অপেক্ষরত শিক্ষার্থী তথা যাত্রীদের পিষ্ট করে যাওয়ার, পাল্লা-পাল্লি করে এক শিক্ষার্থীর হাত অপর শিক্ষার্থীর পা কেটে নেওয়ার, যার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে মৃত্যুও ঘটে, এসব কিছু করে চলার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে।
আর তারই প্রতিবাদে যখন ছোট ছোট ছেলেরা রাস্তায় বিক্ষোভ দেখায়, বিচারের দাবিতে প্ল্যাকার্ড হাতে অবরোধ করে তখন তাদের ওপর হামলা হয়। রাইফেলের বাটে তাদের মাথা ফাটে। এও বুঝি এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া! এতসব রক্তঝড়া প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই হয়তো আসবে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা। এর মধ্য দিয়েই শিক্ষা নেবেন মন্ত্রী বাহাদুর। রাষ্ট্রযন্ত্র হয়তো সঠিক কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে। একদিন হয়তো সেই সুদিন আসবে। কিন্তু প্রাণপ্রিয় সন্তানকে ফিরে পাবেন না করিম ও দিয়ার বাবা-মা।
আর শত শত চক দিয়ে যতই চকচক করা হবে হাদীর একজোড়া পিটি সুজ। কোনো দিন আর মুছে দেওয়া যাবে না তার ওপরে জমে থাকা রক্তের ছোপগুলো।
মাহমুদ মেনন, নির্বাহী সম্পাদক, সারাবাংলা.নেট ও দৈনিক সারাবাংলা
সারাবাংলা/এমএম