ধর্মীয় উৎসব কি সবার হতে পারে?
১৭ অক্টোবর ২০১৮ ১৫:৩৮
উৎসব শব্দটির সাথে জড়িয়ে আছে সমারোহ, আমোদ, আড়ম্বর, অনুষ্ঠান, সমাবেশ ইত্যাদি সব জাঁকজমক শব্দ। উৎসব তাই একা হয়না। উৎসবে থাকতে হয় হরেক রকম মানুষ, যারা নেচে গেয়ে, হইচই করে উৎসবকে করে তোলে প্রাণবন্ত। সেই অর্থে উৎসব সবার। কিন্তু আর্থ সামাজিক অবস্থা ভেদে আমরা খুবই দুঃখজনক ভাবে উৎসবগুলোকে সবার করে তুলতে পারিনা। এর মাঝে ব্যতিক্রম হল ধর্মীয় উৎসবগুলো। স্বাভাবিকভাবেই যে দেশে যে ধর্মের মানুষের বেশি বাস সে দেশে সেই ধর্মের উৎসব হয়ে ওঠে সার্বজনীন। বাংলাদেশের দুটো ইদে দেশের আনাচে কানাচে প্রতিটা কোণে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। দেশে বসবাস করা ভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসের মানুষেরাও সেই উৎসবের অংশ হয়ে পড়ে কোন না কোনভাবে। তারাও ইদের ছুটি কাটায়, হিন্দু ধর্মের ময়রার বাড়িতেও ইদ উপলক্ষ্যে মিষ্টি বানানোর চাপ বেড়ে যায়। স্বর্ণকার দ্রুত হাতে ডিজাইন তোলেন। এমনি করেই ধর্মীয় উৎসব হয়ে পড়ে সবার। ইদের দিন বাড়িতে বন্ধু বান্ধবদের দাওয়াত দিলে ভিন্ন ধর্মের বন্ধুটিও আসেন বেড়াতে। এটাই উৎসবের মূলমন্ত্র।
অনেকেই ধর্মীয় উৎসব আর ধর্মীয় প্রার্থনাকে সমার্থক করে ফেলছেন আজকাল। “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার” এই কথাটিকে কাউন্টার দিতে গিয়ে তারা বোকার মত বলছেন, কেন মুসলিমরা পুজায় যাবে, হিন্দুরা কি ইদের নামাজ পড়তে আসে? হিন্দুরা কি গরু কুরবানি দিতে আসে? এগুলো ভুল তুলনা, ভ্রান্ত যুক্তি।
ধর্মীয় উৎসবের একটা বেশ বড়সড় অংশে আসলে ধর্মের সাথে তেমন কোন সম্পর্ক নেই। বরং সম্পর্ক আছে একেকটি বিশেষ অঞ্চলের সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ভূগোল ইত্যাদির সাথে। দুই ইদের দিন আমরা নামাজে, খুৎবায় অর্থাৎ প্রার্থনায় সময় দেই কতক্ষণ? বড়জোর এক ঘন্টা! অথচ এরও অনেক আগে থেকে এবং এর পরেরও বেশ কয়েকদিন আমরা ইদ করতে থাকি নানান ভাবে। প্রায় এক মাস আগে থেকে কেনাকাটা শুরু হয়। এখন তো ইন্ডিয়ায় গিয়ে কেনাকাটা করে হাজার হাজার মানুষ। ইদের উৎসবে খাবার একটা বেশ বড় অংশ দখল করে আছে। বাংলাদেশের মানুষ ইদে খায় বিরিয়ানি, পোলাও, মাংস, সেমাই, ফিরনি ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্যই বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশে ইদের দিন তৈরি করা হয় তাদের আঞ্চলিক খাবার। যেমন মরক্কো আর আলজেরিয়ার মানুষ ইদের দিন টুজিন নামের মুখরোচক এক খাবার খায়, সৌদি আরবের লোকেদের ইদের প্রধান খাবারের তালিকায় থাকে মুগালগাল। এতে কি ইদের মূল অর্থ পালটে যায়? যায়না। শুধু নামাজ অংশ ছাড়া সারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিমদের ইদ উৎসবের মধ্যে অর্থাৎ খাবারে, পোশাকে, আনন্দের মাত্রায়, ধরনে কোনকিছুতে আপনি খুব বেশি মিল পাবেন না। কিন্তু এসবই ইদের অংশ। এই যে কথায় কথায় হিন্দুরা কি গরু কুরবানি দিতে আসবে? বলে বিরক্তিকর যুক্তি দেয়া লোকগুলো মনে করে কুরবানি ইদ মানেই গরু কুরবানি। অথচ আরব দেশগুলোতে বেশি কুরবানি হয় উট আর দুম্বা। সুতরাং গরু সার্বিকভাবে কুরবানি ইদের কোন সিম্বল নয়। এমনকি সারা পৃথিবীর নানান অঞ্চলের মানুষ একই দিনে ইদও করতে পারেন না, বিচিত্র ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। অর্থাৎ একটা ধর্মীয় উৎসব শুধু ধর্মকে ধারণ করেনা, একই সাথে সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকেও ধারণ করে। আর এজন্যেই একে উৎসব বলে।
বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে যখন আমরা আহবান করি অন্য ধর্মের উৎসবে অংশ নিতে, তখন আমরা অবশ্যই ধর্মীয় উৎসবের প্রার্থনা অংশটিকে বোঝাই না। প্রার্থনা বাদে একটা ধর্মীয় উৎসবের যেই অংশগুলো আছে সেগুলোকেই আসলে আমরা প্রাধান্য দেই।
বাঙ্গালি হিন্দুদের দুর্গা পুজা উৎসবকে বলা হয় সার্বজনীন উৎসব। এই উৎসব সকলের জন্যে। বাঙালি হিন্দুরা দুর্গাকে কন্যারূপে দেখে। তাই শরতের এই সময়ে কন্যা তার ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে বাপের বাড়িতে নাইওরি আসার আনন্দে তারা উৎসবে শামিল হয়। অবশ্যই এই উৎসবের ধর্মীয় একটি দিকও আছে। কিন্তু উৎসবটির সাংস্কৃতিক দিকটিকে সামনে রেখে যে কেউ চাইলে যেতেই পারে এই উৎসবে। এমনকি আজকাল অনেক হিন্দুও প্রতিমা পুজায় বিশ্বাস রাখেনা। তাদের অনেককেই দেখেছি পুজায় আনন্দ করে, কিন্তু প্রতিমাকে প্রণাম করেনা। আমি দেখেছি হিন্দুদের মধ্যে এ নিয়ে কোন প্রকাশ্য জোরজবরদস্তিও নেই।
অনেকের কাছে দুর্গার প্রতিমাটি শিল্পবোধের প্রকাশ। একেক মন্ডপে দেখা যায় একেকভাবে সাজানো হয়েছে দুর্গাকে। এখানে বাঁধাধরা কোন নিয়মও নেই। আর ইসলামে পুজার প্রসাদ খাওয়া নিষেধ আছে। হিন্দুরা পুজা উপলক্ষ্যে যেসব খাবার রান্না করে সেগুলো কিন্তু পুজার প্রসাদ নয়। এই ব্যাপারটি আমরা অনেকে হয় জানিনা, নয় জেনেও ভুল কথা প্রচার করে বেড়াই। অনেক ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ যায় পুজা উৎসবে অংশ নিতে। তার মানে এই নয় যে তারা প্রতিমাকে পুজো করছে। তারা আসলে ধর্মের প্রার্থনা অংশটি নয়, সামাজিক/সাংস্কৃতিক অংশটিকে উপভোগ করতেই যায়।
যারা ভিন্ন ধর্মের উৎসবে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না তাদেরকে কোন জোরাজোরি করা এই লেখার উদ্দ্যেশ্য নয়। যার যেখানে যেতে ইচ্ছে করবে না তাকে সেখানে জোর করে নিয়ে যাবার কোন অর্থ নেই। তবে যারা আগ্রহ নিয়ে ভিন্ন ধর্মের উৎসবে যাচ্ছে তাদেরকে ভ্রান্ত যুক্তি দিয়ে অথবা ভয় দেখিয়ে নানান ভাবে উৎসবে অংশগ্রহণ থেকে বিরত করার পেছনে মহৎ কোন কারন আমি অন্তত দেখিনা।
আজকের এই যুগে বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে আপনি কখনোই টিকে থাকতে পারবেন না। অস্বীকার করার উপায়ও নেই। আপনি যা করতে পারেন, তা হল ভান। বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করার ভান করতে পারেন আপনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা খুব সুন্দর ছবি এসেছিলো কয়েকদিন আগে। এক সফেদ পাঞ্জাবি পরা দাঁড়িওয়ালা মুসলিম হিন্দুদের প্রতিমার পোশাক সেলাই করছেন। এই যে দুর্গা উৎসবের সাথে জড়িয়ে আছে নানান রকম খুঁটিনাটি কাজ, প্যান্ডেল টানানো, গেট বানানো, আলোকসজ্জা ইত্যাদি ইত্যাদি। উৎসবের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়েই তো রয়েছে ব্যাবসা বাণিজ্য। এবং বাংলাদেশে সেই বানিজ্যে অবধারিতভাবে মুসলিমরা অংশ নিচ্ছে। আবার মুসলিমদের কুরবানির গরু আসছে ভারত থেকে। এটা তো অস্বীকার করার কোন উপায়ই নেই। আজকের এই যুগে এসে আপনি কোনভাবেই একটা গোষ্ঠী থেকে পুরোপুরি আলাদা হতে পারবেন না।
আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় বৈচিত্র্য নেই বললেই চলে। তাই আমরা এই বৈচিত্র্যকে উদযাপন করতে শিখিনি। যেটুকু বৈচিত্র্য আছে সেটার প্রতিও আমাদের দারুণ বিবমিষা, প্রচণ্ড ভয়। এই অজ্ঞতার কারণে আমরা ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষগুলোকে নিজের মত মানুষ ভাবছিনা। ভাবছি অন্য কেউ। আমি এমন অনেককে জানি যারা ভিন্ন ধর্মের লোকজনের বাসায় গিয়ে খেতে পর্যন্ত পারেন না। এই ঘৃণার উৎস আর কিছুই না, অজ্ঞতা। আর এই অজ্ঞতার ফলে আমরা গোটা বিশ্বের অসধারন সব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে উপভোগ করতে পারি না, উলটো ভয় পাই। ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্ন ধর্মের মানুষকে ঊনমানুষ হিসেবে ভাবাটা তখনই দূর হবে যখন আমরা তাদেরকে কাছ থেকে দেখতে শুরু করবো। আর এই দেখতে শুরু করার প্রক্রিয়াটা খুব সহজেই শুরু করা যায় বিভিন্ন ধর্মের উৎসবের সামাজিকভাবে (আবার বলছি, ধর্মীয় নয়) অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
এই যে, ভিন্ন ধর্মের উৎসবে যাওয়া তো দুরের কথা সেই উতসবে শুভেচ্ছা জানাতেও আজকাল যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে এবং আমাদেরই কেউ কেউ মহানন্দে সেই সব ঘৃণার বানী প্রচার করে যাচ্ছি এর ফল কখনোই সুখকর নয়। একদল বলছে ধর্মীয় উৎসব এক্সক্লুসিভলি শুধু সেই ধর্মের মানুষদের জন্যে। অর্থাৎ তারা মনে করছেন ধর্মীয় উৎসবের বাইরে এমন কোন উৎসব আছে যেটিতে সবাই একত্রে অংশ নিতে পারেন। বেশ ভালো কথা। অথচ যারা ভিন্ন ধর্মের উৎসবে যাওয়ার জোর বিরোধিতা চালান তাদেরি একটা বেশ বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ পয়লা বৈশাখের মত সার্বজনীন একটা উৎসবও মুসলিমদের জন্যে হারাম বলে প্রচার করেন।তাই মানুষকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার এই প্রক্রিয়াগুলোকে কিছুতেই সন্দেহাতীত বলে মনে হয় না প্রায় সময়ই।
আমাদের ভিন্ন ধর্মের বন্ধুটি যখন আমাদের উৎসবে স্বেচ্ছায় অংশ নেয় আমরা খুশি হই। তাহলে অন্যের প্রতি সেই একই আচরণ করতে আমাদের আপত্তি কেন? সব ধর্মের একটা খুব কমন আদর্শ হল, “অন্যের প্রতি তেমন আচরণ কর, যা তুমি নিজের জন্যে প্রত্যাশা কর”। এইটুকু মাথায় রাখলেই হয়। বিশ্বের রাজনৈতিক নেতারা নানান ধর্মের উৎসবে অংশ নিয়ে থাকেন। কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো যখন পাঞ্জাবি পরে মুসলিমদের ইফতারিতে অংশ নেন মুসলিমরা খুশি হয়ে ওঠেন। এর মাধ্যমে আসলে প্রেসিডেন্ট সেই দেশের মানুষদেরকে জানান দেন তিনি সহিষ্ণু। তেমনি বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক নেতারাও পুজা মন্ডপে যান। এটা আসলে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটা প্রচেষ্টা। তো এই ট্র্যাক টু ডিপ্লোম্যাসির যুগে শান্তি প্রতিষ্ঠায় শুধু বড় বড় রাজনৈতিক নেতারাই নয় সমাজের প্রতিটি মানুষই নিজের মত করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে পারেন এবং করা উচিত।
জান্নাতুল মাওয়া: গবেষক, সংবাদকর্মী এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপ কর্মী
সারাবাংলা/এমএম