ঢাবি’র ঘ ইউনিট: আমরা ভুল করছি কি!
২৩ অক্টোবর ২০১৮ ১৯:৫১
ঘটনাটা ১৯৮৯ সালের… আজ থেকে তিন দশক আগে। তখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ি। কলেজে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বড়ভাই বিসিএস কোয়ালিফাই করে মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক হয়েছেন। বিসিএস- তখনো বিস্ময়ের নাম। আমরা দু’তিনজন মিলে বন্ধুর সাথে তার বাসায় গেলাম বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। তো সেই সদ্য চিকিৎসক বড়ভাই বললেন- আরে বিসিএস কিছুনা! আমার আগের যিনি প্রার্থী ছিলেন, তাকে জিজ্ঞেস করা হযেছিলো- কলম্বিয়ার রাজধানী কোথায়? তিনি বলতে পারেননি। আমি ঢুকলাম। একই প্রশ্ন করা হলো। আমি বললাম বোগোটা। ব্যাস! বিসিএস পাশ হয়ে গেলো।
এটাই ব্যবস্থা। আপনাকে বিসিএস পাশ করতে হলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে এমন কিছু টোটকা প্রশ্নের উত্তর জানতে হয়। ধরুন আপনি অনেক কিছু জানেন, কিন্তু হিমালয়ের উচ্চতা কত? তা জানেন না কিংবা মনে করতে পারছেন না? আপনার পাশ করা হবে না। প্রাকারন্তরে এটাই বলে দেওয়া হবে আপনি মেধাবী নন- আপনাকে দিয়ে কিছুই হবে না।
এই যখন ব্যবস্থা, তার মধ্য দিয়ে গিয়ে আপনি একবার পাশ করে ফেললে… ব্যাস আর কোনও চিন্তা নেই। কিন্তু এ কী হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে? এখানে ‘ঘ’ ইউনিটে আবারও পরীক্ষা নেওয়া হবে? ভর্তি পরীক্ষায় প্রায় লাখ খানেক ছেলে মেয়ে অংশ নিয়ে হাজার কয়েক পাশ করেছে। তাদের জন্য বরাদ্দ মোটে হাজার দুয়েক আসন। সেই প্রতিযোগিতার পরীক্ষায় যারা পাশ করেছে- তাদের প্রায় সকলেরই বলা চলে ওইসব কোন দেশের রাজধানী কোথায়, কোনটির উচ্চতা কত, কোনটি কতটা প্রশস্ত? সাধারণ জ্ঞানের নামে এমন ধরনের কিছু টোটকা প্রশ্ন পাখির মতো শিখে পরীক্ষা দিয়ে এসেছে। হলফ করে বলতে পারি… ওগুলো ওরা যেভাবে শিখেছে এরই মধ্যে সেভাবেই ভুলে গেছে। এ অবস্থায় তাদের পরীক্ষাটি ফের নেওয়া হচ্ছে- সুতরাং সেরা ফল যিনি করেছেন তার জন্যও এই পরীক্ষাটি অনিশ্চয়তার। কারণ কোন কোন টোটকা প্রশ্ন এবার প্রশ্নকারীর মস্তিষ্কে স্থান পাবে তা এখন অজানা। প্রশ্নকারীতো তথ্য ঘেঁটে ঘেঁটে কঠিন প্রশ্নটিই করবেন? আমাদের মেধাযাচাইয়ের প্রশ্ন করার দিন কোনও কালেই আসেনি। এখানে পরীক্ষার প্রশ্ন হয়… শিক্ষার্থীকে আটকানোর জন্য, পরীক্ষা যে শিক্ষার্থীর মেধার পরিষ্ফুটনেরও একটি সুযোগ তার চর্চা কখনোই এখানে হয় না।
একটি কথা বলে রাখি, দেশে এখন যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মওসুম চলছে… বিশ্বের দেশে দেশে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির প্রক্রিয়া চলছে। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু এমন এমসিকিউ পদ্ধতির পরীক্ষা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ে তারা নিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের আইকিউ টেস্ট। এছাড়া তাদের দিয়ে একটি লেখা লিখিয়ে নিচ্ছে- কি তার লক্ষ্য কেনই বা সে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। একটি লেখাই হয়ে থাকছে শিক্ষার্থীর দক্ষতা বা যোগ্যতার নির্ণয়ক। শিক্ষার্থীর বিশ্লেষণের ক্ষমতা, পারিপার্শ্বিকতা থেকে অনুধাবনের দক্ষতা এসবই দেখা হয় এসব পরীক্ষায়।
হাহ্! এসব নিয়ে বকবকানি এখানে অরণ্যে রোদনমনাত্র।
যাই হোক বাস্তবতা হচ্ছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা আবারও হচ্ছে। পরীক্ষাতো সবারই জন্য সুতরাং কোনও একজনের এতে আলাদা করে বিচলিত হবার কিছু নেই। আবার বলা চলে একই সমস্যা একই চ্যালেঞ্জ সবার জন্যই প্রযোজ্য। সুতরাং সবার জন্যই বিচলিত হবার সুযোগ রয়েছে।
তবে যাদের কমন পড়বে…. আর যাদের কমন পড়বে না তাদের মধ্যে ফারাক তৈরি হয়ে যেতেই পারে। কারণ এখানে মেধা যাচাইয়ের জন্য কিছু টোটকা প্রশ্নই থাকবে।
থাক সে কথা। বাচ্চারা ফের পরীক্ষা দেবে, যারা পাশ করেছে তারাই কেবল পরীক্ষা দেবে। ফলে এতে যারা আগে ভালো করেছে, তাদের খারাপ করার সুযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি যারা অপেক্ষাকৃত খারাপ করেছে, তাদের এবার ভালো করার সুযোগ তৈরি হলো। আর যারা আগে ভালো করেছে তাদের আরও ভালো করার সুযোগ তৈরি হলো। আর যারা সবচেয়ে ভালো করেছে, তাদের সেই অর্জন ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ তৈরি হলো। ইতিবাচকভাবে দেখলে সেভাবেই বলতে হবে।
তবে কী জানেন! এই সবার চেয়ে ভালো করার কারণেই কিন্তু এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিট নিয়ে এত কেলেঙ্কারি!
বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দুই দশকের এই পরীক্ষা পদ্ধতিতে এত নম্বর পেয়ে কেউ প্রথম হয়নি। অথচ সেই প্রথমই… যিনি তার নিজস্ব ইউনিটে ইংরেজিতে মাত্র দুই পেয়ে, আর মোট ৩৪ পেয়ে ফেল করেছিলেন, ঘ ইউনিটে তিনিই পেয়ে বসলেন ১২০ এর মধ্যে ১১৪ নম্বর। আর ইংরেজিতে ৩০ এর মধ্যে ৩০। বাহ! বেশ ভালো ফল। এটা বলা যায়, এই ফলাফল অসম্ভব নয় বটে, তবে অবাস্তব যে তাতে সন্দেহমাত্র নেই কারো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইউনিটে অনেকেই এমন অস্বাভাবিক নম্বর পেয়েছেন। প্রথম দিকে ফল করা ১০০ জনের মধ্যে অন্তত ৭০ জনকে পাওয়া গেছে যারা নিজ নিজ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছেন। আর এরই মধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষা শুরুর প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে ফাঁস হয়েছে।
প্রশ্নফাঁস কোনও নতুন ঘটনা নয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম অবহেলার কারণে এটি এখন রোটিন কর্ম। বলা চলে অনেকটা নিয়মেই পরিণত হয়ে গেছে। যারা প্রশ্ন ফাঁস করেছে, আর তার সুবিধা নিয়ে যারা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে, তাদের ফল অপেক্ষাকৃত ভালো হয়েছে সে কথা নিঃসন্দেহেই বলা চলে। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছিলো এই ফাঁসের সাথে যারা জড়িত এবং যারা ফাঁসকৃত প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দিয়েছে তাদের চিহ্নিত করে তাদের ফল বাতিল করা। সে কাজে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো- পরীক্ষা আবারও হবে। তবে যারা কেবল পাশ করেছে তাদের মধ্যে হবে। এতে যারা ফাঁসকরা প্রশ্ন দেখে পরীক্ষা দিয়েছে তাদের সায়েস্তা করা যাবে।
কিন্তু কিছু অপরাধীকে সায়েস্তা করতে অনেক শিক্ষার্থীকে যে বিপাকে ফেলে দেওয়া হলো- সে দিকটা কে দেখবে?
আর অপরাধীদেরতো পোয়াবারো। একবার ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে শাস্তি হিসাবে পাচ্ছে আরেকবার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ।
কিন্তু কতগুলো দিক আমাদের অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে-
পরীক্ষাটির ধরনই এমন যে, একটু পড়াশোনার মধ্যে থাকতে হয়। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সগুলো সারাক্ষণ নজরে রাখতে হয়। এই পরীক্ষায় যারা পাশ করে মেরিট লিস্টের সিট ক্যাপাসিটির, প্রথম, মাঝের কিংবা শেষের দিকেও ছিলো তারা ফল ঘোষণার পর থেকে পড়াশোনা অনেকটা ছেড়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে দিনগুনছে। কোন সাবজেক্ট পাবে, কোনটা পাবে না সে নিয়ে হিসাব নিকাশ করছে। তারা পড়ালেখা বন্ধ রাখার এই গ্যাপ কিভাবে পূরণ করবে সেটা এখন চিন্তার বিষয়।
যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছে তারা নিশ্চয়ই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ (২৩ অক্টোবর) সম্পন্ন হয়ে যাওয়া ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে যায়নি। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনওভাবে যারা মেরিট লিস্টে আগের তুলনায় পিছিয়ে যাবে তাদের জন্য দুঃখের সময়ই অপেক্ষা করছে।
পরীক্ষাটি আবারও নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনেকটা ঝামেলা পোহাতে হবে বৈকি। কিন্তু যে ছেলেটি কিংবা মেয়েটি এর আগেই পরীক্ষা দিয়ে মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়ে নিজের গ্রামে ফিরে গেছে। তাকেও তো আবার ছুটে আসতে হবে পরীক্ষা দিতে। সেটি সময়ের বিষয় যেমন, খরচেরও বটে। অনেক দরিদ্র বাবা-মায়ের সন্তানেরাও তো এই পরীক্ষা দিয়ে, পাশ করেছে। তাদের জন্য দ্বিতীয় দফা এই খরচটিও হবে একটি বড় বোঝা।
একটি শিক্ষার্থী যে এখন পরীক্ষায় পাশ করে নিজের গ্রামে সে কথা জানিয়েছে, আত্মীয়-স্বজনের কাছেও জানিয়েছে তাদের যখন আবার পরীক্ষা দিতে আসতে হবে, তখন সে গ্রামে তো এমন কথাও উঠতে পারে, আত্মীয়দের কেউ একথাও বলে বসতে পারে আগে মিথ্যা কথা বলেছে বলেই আবার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। সব সবর দেশের সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছাবে এমন একটি ব্যবস্থাতো আমরা এখনও করতে পারি নি। আর সকলের ভাবনা, বিশ্বাস, বিচার-বিশ্লেষণ, অনুধাবন একই রকম হয় না।
ভেবে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম বার পাশ করার পর অন্যের জালিয়াতির কারণে দ্বিতীয়বার নেওয়া পরীক্ষায় পাশ করতে না পেরে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, আমাদের সামনে এমন উদাহরণও রয়েছে।
কে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়েছে, কে দেয় নি- সেটি কারও জানা নেই। ফলে এখন যখন দ্বিতীয়বার পরীক্ষা হচ্ছে- তখন প্রত্যেককেই অপরাধী ভাবা হচ্ছে। এটি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের আইন বলে, একজন নিরাপরাধ মানুষকেও শাস্তি দেওয়া যাবে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের এটা এমন এক সিদ্ধান্ত যাতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিনা অপরাধে শাস্তি পেতে চলেছে। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়াটাই একটা সাজা। আর অপমানেরও বটে। কেনও আমরা গুটিকয় শিক্ষার্থীর জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অপমানিত করছি। কেনও আমরা প্রশ্ন ফাঁসের মতো ঘটে যাওয়া অন্যায়কে রোধ না করে, ফাঁসকারীকে চিহ্নিত না করে এতগুলো কোমলমতি শিক্ষার্থীর মন নিয়ে খেলছি? সে প্রশ্নের জবাব আজ নয়তো কাল- একদিন আমাদের দিতেই হবে। তবে ততদিনে জাতি হিসেবে আমরা আরও পঙ্গু হয়ে যাবো নিশ্চয়!
সারাবাংলা/এমএম