Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাজনীতিতে পল্টি ও একটি নীল শার্টের আফসোস


২১ নভেম্বর ২০১৮ ১৩:১৫

জিও নিউজের খবরে জানা গেল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন- “পল্টি খাওয়াই রাজনীতির আরেক নাম। যে নাকি পল্টি খেতে পারেনা সে কোন রাজনীতিবিদই নয়।” আদর্শের সংঘাত বা নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে গিয়ে এক ধারা থেকে অন্যধারায় গমন রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। আর এসব কারণে দলত্যাগ করলে তাকে পল্টি বলাটা নেহায়েত অন্যায়। পল্টি মানে মূলধারা থেকে হার্ডলাইনে বা লিবারেল লাইনে যাওয়া নয়, একেবারে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া। আর তাই নেতাজী সুভাষ বোস যখন কংগ্রেস জাতীয় সন্মেলন থেকে ফরোয়ার্ড ব্লক গঠন করেন কিংবা মুদ্রানীতির প্রশ্নে উনবিংশ শতকের শেষভাগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবালিকান পার্টি ভেঙ্গে সিলভার রিপাবলিকান পার্টি হয় তা পল্টি খাওয়া হয় না; বরং আদর্শের বিজয় কেতন ওড়ানো হয়। কাগমারী সন্মেলনে মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ছেড়ে ন্যাপ করেছিলেন ক্ষমতার জন্য নয়, ক্ষমতা থেকে দূরে গিয়ে গনমানুষের মুক্তির জন্য, স্বীয় মতে অবিচল থাকার কারণে।

বিজ্ঞাপন

’৯১ এ সাধারন নির্বাচনের আগে অবসরপ্রাপ্ত আমলা, সামরিক কর্মকর্তা এবং লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যবসায়ীগণ আইনপ্রণেতার ভুমিকায় নিজেদের দেখতে চেয়েছিলেন। দেশের মানুষের উপকার এবং উন্নয়নে ভুমিকা রাখতে চেয়ে অনেকেই বড় দলগুলো থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন এবং বিজয়ী হয়েছিলেন। এর ধারবাহিকতা অব্যাহত ছিলো পরবর্তীতে এবং কখনো কখনো এই সাংসদ হওয়ার অনুপ্রেরণা এত বেশি ছিল যে, দীর্ঘদিনের লালিত রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং চেতনাকে খুব সহজেই ত্যাগ করেছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব বা জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের সভাপতি মাহবুবুল রহমান তারা।

বিজ্ঞাপন

গণতান্ত্রিক দেশে মানুষের রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটতেই পারে। ব্যক্তি স্বাধীনতার চরম বিকাশের এ যুগে অনেক নেতাই দল–মত-আদর্শ পরিবর্তন করেন। মজার ব্যাপার যে স্বপ্নের, যে আদর্শের দোহাই দিয়ে অনেক নেতা তাদের দীর্ঘদিনের সাথীদের বা দলকে ত্যাগ করেন সেই স্বপ্নও অনেক ক্ষেত্রে তারা ভুলে যান। মুজিব, জিয়া, এরশাদ এবং খালেদা জিয়া সরকারের সময় সরকারি দলে ছিলেন এমন লোকের উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছেন। অনেক সময় দেখা যায় মতাদর্শের পরিবর্তন এত দ্রুত হয় যে তা আসলেই দল পরিবর্তনের কারন সম্পর্কে ফিসফাসের জন্ম দেয়। বিশেষত জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর যখন জনপ্রতিনিধি দলত্যাগ করেন তা শুধু দলের সাথে বেঈমানীই নয় বরং নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের সাথেও প্রতারণা বটে। আমাদের দেশে এই বিশেষ প্রজাতির পল্টি খাওয়া লোকের সংখ্যা হাতে গোনা হলেও ঘরের পাশে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পল্টি খাওয়ার উদাহরণ ভুরিভুরি।

অন্যদিকে, এ প্রসংগে সাম্প্রতিক কালে যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট নির্বাচনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত এক তরুণ ব্রিটিশ রাজনীতিবিদের ভূমিকার কথা বলা যায়। তাঁর নির্বাচনী এলাকার জনগণ ব্রেক্সিটের বিপক্ষে ভোট দেয় যদিও কেন্দ্রীয়ভাবে তাঁর নিজের দল ব্রেক্সিটের পক্ষে ছিল। তিনি পদত্যাগ করেন এ কারণে যে তিনি যে সংসদে তাঁর নিজ এলাকার জনগনের প্রতিনিধিত্ব করেন তাঁদের মতামতকে সন্মান জানানো তাঁর নিজ দলের মতকে মেনে নেয়ার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্র এবং একজন রাজনীতিবিদের দায়বদ্ধতা এবং সর্বোপরি ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের এর চাইতে মহৎ কোন উদাহরণ হয়না।

বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া সাহেব যেদিন গ্রেনেড হামলায় নিহত হন সেদিন দুজন বর্ষীয়ান নারী তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এবং মতিয়া চৌধুরী সাত কিলোমিটার পায়ে হেঁটে সন্মিলিত সামরিক হাসপাতালে যান কারণ তাদের গাড়ী আটকে দেয়া হয়েছিল জাহাংগীর গেটে। প্রয়াত কিবরিয়া সাহেবের স্ত্রী নীল রংয়ের পোশাকে প্রতিবাদের ডাক দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, জীবনে দ্বিতীয় হননি এমন এক সফল ছাত্র, ডিপ্লোম্যাট, মুক্তিযোদ্ধের মহান সংগঠক এবং অর্থমন্ত্রীর মৃত্যু মেনে নিতে পারিনি বলে বিবেকের তাগিদে আসমা কিবরিয়া ও রেজা কিবরিয়ার ডাকে পকেটের শেষ সম্বল কটি টাকা দিয়ে একটি নীল শার্ট কিনে অফিস ফেরতা এই আমিও সেদিন লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম নীল শার্ট পরে। রেজা কিবরিয়া আজ বলছেন, পিতা হত্যার বিচার আওয়ামী লীগ করেনি বলে তিনি আওয়ামী লীগ ছেড়েছেন। আপনার মত প্রকাশের, যে কোন সংগঠন করার ইচ্ছা আপনার সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু যে কারণে আপনার মনে হয়েছে আওয়ামী লীগ আপনার পিতার হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার করছে না তা কি খোলাসা করবেন? সেটি কি বিচারের শম্ভুকগতি না বিচারের ভুল দিশায় চলা? যদি বিচার ভুল দিশায় চলে তবে আপনার উচিত ছিল নারাজী আবেদন দেয়া। যদি ভুল লোককে আসামি করা হয় তবে যেসব মানুষ এ মামলায় জেলে আছেন তাঁদের কাছেও আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। আর যদি মনে করেন চার্জশিট ঠিক আছে তবে বিচার দ্রুত হচ্ছে না তবে আপনার কাছে প্রশ্ন এদেশের আদালতের গতি ও মামলা জট আপনি কি জানেন না?

পিতৃহীন আমি বুঝি পিতা হারানোর কষ্ট। আপনার পিতার মত মানূষের মৃত্যুতে গোটা জাতিই ব্যথিত। পিতা হত্যার বিচারের আশায় যে রাস্তায় আপনি হাঁটছেন তা সঠিক কিনা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু যদি জানতাম আপনি এ রাস্তায় হাঁটবেন তবে সেদিন এক অফিসফেরত যুবক তার সাদা শার্টটি ব্যাগে ঢুকিয়ে তড়িঘড়ি করে নীল শার্ট কিনে আপনার পাশে দাঁড়াতো না। তৎকালীন সরকারের কাছে আপনার পিতার হত্যার বিচার চেয়ে আপনার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম বলে নিজেকে নিয়ে গর্ব হত। যে কাজের জন্য গর্ববোধ করেছি সেই নীল শার্ট নিয়ে আজ মানুষ না চেনার আফসোসে ভুগছি।

সৌরিন দত্ত: কর্মকর্তা, ডিএইচএল

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর