চুপ করো, খামোশ…
১৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৪:৪৭
রেজানুর রহমান ।।
কথায় আছে রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শ্রদ্ধাভাজন ড. কামাল হোসেনকে যেভাবে রেগে উঠতে দেখলাম তাতে বারবারই এই কথাটিই মনে পড়ছে। হঠাৎ এভাবে রেগে গেলেন কেন তিনি? তাও আবার সাংবাদিকদের ওপর। সাংবাদিকরা কি এমন ক্ষতি করেছে তাঁর? না হয় দু-একটা আপত্তিকর প্রশ্নই করেছে। যদিও প্রশ্নগুলো ড. কামাল হোসেনের কাছে আপত্তিকর। কিন্তু সাধারন মানুষের কাছে নিশ্চয়ই আপত্তিকর নয়। সারাজীবন যাদেরকে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি বলে অনেক গালাগাল করলেন হঠাৎ তারাই যখন আপনার বন্ধু হয়ে গেল তখন তো অনেক প্রশ্নই করার থাকে। তাছাড়া সময়টা যে বদলে গেছে একথা আমরা অনেকেই মাথায় রাখিনা রাখতেও চাইনা। বিশেষ করে তরুণদের অগ্রযাত্রাকে আমরা অনেকেই গুরুত্ব দিয়ে দেখি না। ভাবটা এমন ওরা আবার কি জানে?
কিন্তু ওই যে বললাম, সময় পাল্টে গেছে। যেখানেই যাবেন সেখানেই দেখবেন তারুণ্য আলো ছড়াচ্ছে। সম্ভাবনার আলো। কারও কারও অবশ্য তারুণ্যের এই মেধাদীপ্ত আলো সহ্য হচ্ছে না। কারণ তারুণ্যের এই মেধাদীপ্ত আলোর বিচ্ছুরণে অনেকরই আসল চরিত্র সামাজিক আয়নায় কদর্য ভঙ্গিতে ফুটে উঠছে।
কথায় আছে রেগে গেলে অনেকেই সাত পাঁচ না ভেবে তার মনের আসল কথাটা অবলীলায় বলে ফেলেন। তখনই বোঝা যায় তিনি আসলে কে? কি বলতে চাচ্ছেন! ড. কামাল হোসেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। কিন্তু তিনি যেভাবে রেগে গেলেন, সাংবাদিকদের প্রতি যেসব ভাষা ব্যবহার করলেন তা কতটা প্রেরণাদায়ী? বিশেষ করে তার মুখ থেকে উর্দু ভাষায় ‘খামোশ’ শব্দটি যেভাবে উচ্চারিত হয়েছে তা সত্যি ভীতিকর। কেন তিনি সাংবাদিকদের প্রতি ‘খামোশ’ শব্দটি উচ্চারণ করলেন? এটা কি তাৎক্ষণিকভাবে শুধুমাত্র তার রাগেরই বহিঃপ্রকাশ? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?
তার আগে আসুন জেনে নেই ড. কামাল হোসেন শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধে আসলে কি বলেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার বক্তব্যের যে অংশটি ভাইরাল হয়েছে তাতে দেখা যায়, সাংবাদিকরা প্রশ্ন করছেন, জামায়াতের নিবন্ধন নাই, অথচ আপনারা জামায়াতের নেতাদের মনোনয়ন দিয়েছেন…
কামাল হোসেন: (রেগে) প্রশ্নই আসে না… কত পয়সা পেয়েছো এই প্রশ্নগুলো করার জন্য? কার কার কাছে পয়সা খেয়েছো? তোমাদেরকে জেনে রাখবো… চিনে রাখবো… পয়সা পেয়ে শহীদ মিনারকে অশ্রদ্ধা কর। আশ্চর্য! (প্রচন্ড রেগে) শহীদদের কথা চিন্তা কর… হে: হে: হে: করে আবার হাসো… শহীদদের কথা চিন্তা কর।
ড. কামাল হোসেন অব্যাহতভাবে সাংবাদিকদের ধমক দিয়ে যাচ্ছিলেন। তবুও একজন সাংবাদিক দৃঢ়তার সাথে একটা প্রশ্ন করতে থাকে… শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের প্রশ্ন হলো যারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে আপনারা… ড. কামাল হোসেন ওই সাংবাদিককে প্রচন্ড ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন। তিনি প্রথমে বলেন, চুপ করো। তারপর উর্দুতে বলেন খামোশ… তারপর যাবার জন্য পা বাড়িয়ে সাংবাদিককে প্রশ্ন করেন, তোমার নাম কি? কোন পত্রিকা? কোনটা?
সাংবাদিকের পক্ষ থেকে উত্তর আসে যমুনা টিভি। তখন ড. কামাল হোসেন যেতে যেতেই মন্তব্য করেন যমুনা টেলিভিশন… জেনে রাখলাম!
এই যে ‘জেনে রাখলাম’ শব্দটা কেন উচ্চারণ করলেন শ্রদ্ধেয় ড. কামাল হোসেন…? এজন্যই একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। প্রশ্নটা হলো সাংবাদিকেরা কি এমন অন্যায়, অযৌক্তিক প্রশ্ন করেছে? মহান ৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্দিজীবীদেরকে জামায়াত নেতারাই বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে নির্মম, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল একথা তো সকলেই জানে। অথচ তাদেরই অনুসারীদের সাথে হাত মিলিয়ে কেউ যদি শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন তাহলে তো অনেক প্রশ্নই করার থাকে। অথচ প্রশ্নগুলো করতেই দিলেন না ড. কামাল হোসেন। বরং সাংবাদিকদের সাথে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাষায় কথা বললেন। ব্যাপারটা এমন যে, ড. কামাল হোসেনের দৃষ্টিতে সাংবাদিকরা তার সাথে মারাত্মক অন্যায় করেছেন।
কিন্তু বাস্তবতাকে তাই বলে? সাংবাদিকরা কি আদৌ অন্যায় করেছেন? বিষয়টির বোধকরি একটা সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। শুধু ড. কামাল হোসেনই নয় আরও অনেক নেতাকেই ইদানিং সাংবাদিকদের সাথে বিরূপ আচরণ করতে দেখছি। কয়েক মাস আগে একটি নিউজ টিভি চ্যানেলের টকশোতে নামকরা একজন রাজনৈতিক নেতা একজন তরুণ সাংবাদিকের ওপর অযৌক্তিক, অন্যায়ভাবে ক্ষেপে গিয়েছিলেন। তরুণ সাংবাদিক বন্ধুর ক্ষেত্রে শ্রদ্ধাভাজন ওই রাজনৈতিক নেতার মনোভাবটা ছিল অনেকটা এরকম, তুমি কে হে ছোকরা আমরা কথার বিরুদ্ধে কথা বল। জানো আমি কে? ওই নেতার মনোভঙ্গিটাই ছিল এমন যে একজন তরুণ সাংবাদিক তার বিরুদ্ধে কথা বলবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমার ধারনা শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে তরুণ সাংবাদিকদের দেখে ড. কামাল হোসেনও এমনটাই ভেবেছিলেন! এদের বয়স কত? এরা আমাকে প্রশ্ন করে! আশ্চর্য!
কিন্তু ওই যে লেখার শুরুতে বলেছিলাম, সময় অনেক পাল্টে গেছে। তরুণদেরকে এখন আর মন ভোলানো ছড়া শুনিয়ে লাভ নাই। সময়ের প্রয়োজনেই তারা বড়দেরকে প্রশ্ন করতে শিখেছে। তাদের প্রশ্ন যদি যৌক্তিক হয় তাহলে কারোরই রেগে যাওয়া উচিৎ নয়। বরং তাদের প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়া উচিৎ।
সাংবাদিকদের প্রতি ‘খামোশ’ শব্দটি উচ্চারণের প্রেক্ষিতে সাংবাদিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেছেন. ড. কামাল ক্ষেপলেন কেন? প্রশ্নটা অপ্রাসঙ্গিক নয়। অবাস্তবও নয়। খুবই স্বাভাবিক ও সাংবাদিকসুলভ প্রশ্ন। জামায়াতের নিবন্ধন নেই। কিন্তু ঐক্যফ্রন্ট, বিএনপি তাদের ২২ জনকে মনোনয়ন দিয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানাবেন আবার শহীদদের খুনী ও দোসরদের নেতৃত্ব দিবেন আর আমরা সাংবাদিকরা এই প্রশ্ন তুললে আতে ঘা লাগে কেন? ধমক দিলে আর ‘খামোশ’ বললেই আমরা চুপ হয়ে যাবো?
রেজানুর রহমান : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।
সারাবাংলা/পিএম