Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নির্বাচনি প্রচারে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড: কমিশন কতটুকু সার্থক?


২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৬:১৩

।। ব্যারিস্টার মাহিন এম রহমান।।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী এবং তাদের কর্মীরা ততই শেষ মূহূর্তের নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। নির্বাচনি প্রচার প্রক্রিয়ায় সকল প্রার্থীর সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) পাওয়া তাদের আইনগত অধিকার এবং প্রার্থীদের এই আইনগত অধীকার নিশ্চিত করা বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।

বিজ্ঞাপন

নির্বাচন পূর্ব সময়ে প্রচারণার ক্ষেত্রে প্রার্থীদের আচরণ “জাতীয় সংসদ নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা ২০০৮” দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। এই বিধিমালা নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ এর ৯১খ এর অধীনে ক্ষমতা বলে প্রণয়ন করেন এবং প্রত্যেক রাজনৈতিক দল প্রার্থী এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মীদের নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে বিধিমালা অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক।

কিন্ত অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনি প্রচারণার ক্ষেত্রে অনেক প্রার্থী এবং তাদের কর্মীরা বিধিমালা বহির্ভূত অনেক কাজ করেন ও করছেন। প্রচারণার ক্ষেত্রে দেখা যায় বেশির ভাগ প্রার্থী এবং তাদের কর্মীরা মোটর সাইকেল, গাড়ি, বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন ব্যবহার করে মিছিল বা শোডাউন করছেন। যা নির্বাচনি আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি এবং আইনবহির্ভূত। এবং এমন আইন বহির্ভূত কার্যক্রম অনেক প্রার্থীই করছেন। প্রার্থীরা এবং তাদের কর্মীরা প্রচারণার জন্য বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে জনসভা বা পথসভা করেন। জনসভা বা পথসভার মাধ্যমে প্রার্থীরা জনগণের কাছে বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরেন এবং ভোটারদের মন জয় করতে চান। ভোটারদের মন জয় করতে গিয়ে অনেক প্রার্থী কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই মাঝে মাঝে এমন এমন জায়াগয় বা সড়কে জনসভা বা পথসভা করেন যা জনসাধারনের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে এবং দুর্ভোগ বাড়ায়। অথচ নির্বাচনী বিধিমালা অনুযায়ী কোন ট্রাক, বাস, মোটরসাইকেল, নৌযান, ট্রেন কিংবা অন্য কোন যান্ত্রিক যানবাহন সহকারে মিছিল বা মশাল মিছিল বা শোডাউন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নির্বাচনি আচরণ বিধিমালায় আরো বলা হয়েছে- জনগণের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে এমন কোন সড়কে জনসভা বা পথসভা করা যাবে না। অনেক প্রার্থী এবং তাদের কর্মীরা জেনেশুনে বা অনেকেই না জেনে প্রতিনিয়ত এই বিধিমালা ভঙ্গ করে চলেছেন।

বিজ্ঞাপন

প্রার্থীরা এবং তাদের কর্মীরা প্রচারণার অংশ হিসেবে কোন গেইট বা তোরণ নির্মাণ করতে পারবেনা এবং সর্বোচ্চ ৪০০ (চারশত) বর্গফুটের বেশি স্থান নিয়ে প্যান্ডেল ও করতে পারবে না। কিন্তু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে, প্রার্থীরা ও তাদের কর্মীরা নির্বাচন পূর্ব সময়ে প্রচারণার জন্য বিভিন্ন ধরণের আলোকসজ্জা করছেন। অথচ বিদ্যুত ব্যবহার করে যে কোন প্রকার আলোকসজ্জা করা নির্বাচনি আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি।

নির্বাচনি প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পোস্টার ব্যানার। নির্বাচন মওসুম শুরুর অনেক আগে থেকেই পোস্টার, ব্যানার বা বিলবোর্ডে পুরো বাংলাদেশ ছেয়ে যায় । বিভিন্ন আকৃতির, বিভিন্ন রকমের পোস্টার বা ব্যানার করে প্রার্থীরা নিজেদের পক্ষে প্রচারণা চালান। কিন্তু এই ক্ষেত্রেও নিদিষ্ট বিধিমালা প্রয়োজন ।

নির্বাচনি আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী পোস্টারের সাইজ হতে হবে লম্বায় ৬০ সে.মি. ও প্রস্থে ৪৫ সে.মি.। ব্যানার এর সাইজ হতে হবে ৩ মিটার বাই ১মিটার এবং উভয়ই শুধুমাত্র সাদাকালো রঙে ছাপা যাবে। এর ব্যতিক্রম হলে সেসব পোস্টার বা ব্যানার অবৈধ বলে গণ্য হবে ।

পোস্টার বা ব্যানারে প্রার্থীর ছবি , দলীয় প্রধানের ছবি এবং প্রতীক ছাড়া অন্য কোন ছবি বা প্রতীক ব্যবহার করলে সেটাও অবৈধ বলে গণ্য হবে ।

নির্বাচনি প্রচারণায় সরকারি সম্পত্তি, যানবাহন, কর্মচারী বা সুযোগ সুবিধা ব্যবহারে আইনগত নিষেধজ্ঞা রয়েছে। নির্বাচনি আচরণবিধি অনুযায়ী কোন প্রার্থী এবং তাদের কর্মীরা বা কোন ভিআইপি নির্বাচনী প্রচারণায় কোন সরকারি কর্মচারী, যানবাহন , সম্পত্তি বা সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন না । কোন সরকারি সুবিধভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সরকারি কাজের সঙ্গে নির্বাচনি কর্মসূচি যোগ করতে পারবেন না। সরকারি কর্মচারীদের নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যবহারের ওপর আইনানুগ নিষেধজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও , অনেক সরকারি কর্মচারী বিশেষ করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষভাবে প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আইন বহির্ভূত কার্যক্রমও আমরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পারছি।

এইখানে উল্লেখযোগ্য যে দুটি ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে অনেক আলোড়ন তোলার পর, নির্বাচন কমিশন পুলিশের দুইজন কর্মকর্তাকে নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গের দায়ে বরখাস্ত বা প্রত্যাহার করেছে যা অত্যন্ত ইতবাচক। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে যেইসব ক্ষেত্রে আইনবহির্ভূত কার্যক্রমের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন পদক্ষেপ নিচ্ছে এর বাইরেও আরো অনেক আইন বহির্ভূত কাজ হচ্ছে। সেই সব ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। বিগত কিছু দিনে নির্বাচনি প্রচারণায় আরেকটি খুব দুঃখজনক ঘটনা আমরা দেখতে পেয়েছি। সেটি হচ্ছে- প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের নির্বাচনি সভা, শোডাউনে বাধা দেওয় বা পণ্ড করা। পোস্টার বা ব্যানার ছিড়ে ফেলাসহ আরো অনেক আইন বহির্ভূত কাজ। অথচ নির্বাচনি আচরণ বিধিমালায় স্পষ্টভাবে বলা আছে প্রচারণায় সবাই সমান অধিকার পাবে এবং প্রতিপক্ষের সভা, শোভাযাত্রা, বা প্রচারাভিযান পণ্ড করা বা বাধা দেয়া যাবে না এবং এর মাধ্যমেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা সম্ভব হয় । কিন্তু প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের নির্বাচনি সভা পণ্ড করা বা পোস্টার ছিড়ে ফেলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন থেকে যায়। প্রচারণার ক্ষেত্রে কোন প্রার্থী এবং তাদের কর্মীরা কোন প্রচার মানহানিকর মন্তব্য সাম্প্রদায়িক বা এমন কোন মন্তব্য যা ধর্মীয়ানুভূতিতে আঘাত করে বা সম্প্রাদায়িকতা নষ্ট করে, করতে পারবে না এবং যদি করে তকে তা আচরণবিধি পরিপন্থি এবং অবৈধ বলে গণ্য হবে ।

নির্বাচনি প্রচারণা ঘিরে প্রতিনিয়ত মারামারি এবং হানাহানির ঘটনাও ঘটছে। নির্বাচনি প্রচারণাকে ঘিরে সহিংসতায় কিছুদিন আগে একটি শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্মী হতহতের ঘটনাও ঘটছে। মারামারি এবং হানাহানি ছাড়াও প্রচারণায় অংশ নেওয়া অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা ও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গিয়েছে। সকল প্রকার সহিংসতা বন্ধে এবং সকল প্রার্থীও জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এবং প্রচারণায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে আরো কঠোর হতে হবে। এছাড়াও হঠাৎ করে রাজনৈতিক কমীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার ক্ষেত্রে, মামলাসমূহের সত্যতা যাচাই করা এবং হয়রানিমূলক মামলা বন্ধের জন্য পদক্ষেপ নেওয়াও নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

নির্বাচনী প্রচারণার বিধিমালা সকল রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ও তাদের কর্মীদের জন্য প্রচারণার ক্ষেত্রে অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। যে কোনো আচরণ বিধিমালা ভঙ্গ করা হলে শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ৫০,০০০ টাকা জরিমানা বা উভয়ই দণ্ডনীয় হবে। নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে আচরণ বিধিমালা অনেক ̧গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং বিধিমালা যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। কিন্তু বিধিমালা ভঙ্গের জন প্রদত্ত শাস্তি অত্যন্ত নগন্য বলে প্রার্থীরা অনেক সময় এই বিধিমালাকে তোয়াক্কা করতে চান না । তাই নির্বাচন কমিশনের আরো কঠোর শাস্তি অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে চিন্তা করা প্রয়োজন।

বর্তমানে দেশের ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে অগ্রযাত্রার কথা মাথায় রেখে নির্বাচন কমিশনের উচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারণার বিস্তারিত বিধিমালা প্রণয়ন করা। সেই সাথে নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে প্লাস্টিকসহ অন্য যে কোন বস্তু ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা প্রণয়ন করে পরিবেশ বান্ধব বাংলাদেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এছাড়াও অনেক সময় প্রার্থীদের পক্ষে অনেকেই পরোক্ষ প্রচারণা চালান। এ ক্ষেত্রেও সুনিদিষ্ট বিধিমালা থাকা দরকার।

বিগত সময়ের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় যে, এইবার ঢাকাসহ অনেকস্থানে প্রার্থীরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন সকল বিধিমালা অনুসরণ করে প্রচারণা করতে এবং সবার জন্য সমান সুযোগের পরিবেশ বজায় রাখতে। যাহোক, তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়- নির্বাচন কমিশন আচরণ বিধিমালার অনুসরণ কতটকু নিশ্চিত করতে পেরেছে এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে কতটুকু সার্থক হয়েছে? যদি সেটা সম্ভব না হয় তাহলে তরুণদের ২২ শতাংশ ভোট কতটা নিশ্চিত করা যাবে সে নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

লেখাটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আশিকুর রহমান, অ্যাডভোকেট, গার্ডিয়ান চেম্বারস লিগ্যাল সলিউশনস

সারাবাংলা/এমএম

আচরণবিধি আরপিও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্বাচনি প্রচার ব্যারিস্টার মাহিন এম রহমান লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সারাবাংলা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর