ডাকসু নির্বাচন, ছাত্রঅধিকার ও বাস্তবতা
১০ মার্চ ২০১৯ ১৫:২৭
।। ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান।।
স্বাধীনতার পর ছাত্ররাজনীতি নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। টেন্ডারবাজি, হলদখল, ক্ষমতার আধিপত্য, ছিনতাইয়ের মতো বিভিন্ন কারণে ছাত্ররাজনীতি মানুষের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আমার বিবেচনায়, গত কয়েক বছর ধরে ছাত্র-রাজনীতির গতিধারায় এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। রাজনীতির সব স্তরে পরিবর্তনের প্রভাব ছাত্ররাজনীতির মূল কারণ। ছাত্ররাজনীতিতে পূর্বের সেই কালো অধ্যায়গুলো অবসানের দিকে প্রায়। তারপরও ছাত্র নামধারী কতিপয় দুষ্কৃতকারীদের কারণে এ রাজনীতি কলুষিত হচ্ছে। আর তাদের হাতে নিষ্পেষিত হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এমতাবস্থায় ছাত্রদের দীর্ঘদিনের দাবি ডাকসু নির্বাচন। আগামী ১১ মার্চ এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের অধিকার কতটা প্রতিষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে চিন্তার অবকাশ আছে।
উচ্চশিক্ষার শিক্ষার্থী হিসেবে তাদের মত-প্রকাশের স্বাধীনতা ও অধিকার অনেকক্ষেত্রেই সুদূরপরাহত। প্রথমবর্ষে ভর্তির পর থেকেই হলে ওঠার জন্য তারা ছাত্রনেতাদের দ্বারস্থ হয়। অনেকের ভাগ্যে প্রথমে জোটে গণরুম নামে একটি ‘মিনি জেলখানা’। সেখানে একরুমে চারজনের স্থলে রাখা হয় ৩০-৪০ জন বা তারও অধিক। এসব কক্ষে কোনো খাট থাকে না। সবাই মেঝেতে কোনো রকমে শুয়ে রাত কাটায়। পর্যায়ক্রমে তারা রাতে ঘুমায়। অনেকের ঘুমোনোর ঠাঁইটুকু মেলে না। বাধ্য হয়েই তারা বারান্দায় বা মসজিদে রাতপার করে। এছাড়া হলে থাকে বলে তার জন্য অতিরিক্ত কিছু কাজ করতে হয় তাদের। হলগেট পাহারা দেওয়া, বড় ভাই বা বোনের ব্যক্তিগত কাজকর্ম, অর্থ-উপার্জন উপলক্ষে ছিনতাই, চাঁদাবাজির মতো কর্মকাণ্ড তাদের নিত্যদিনের কাজের ফিরিস্তি হয়ে যায়। ক্লাস বাদ দিয়ে মধুর কেন্টিনে যাওয়াটাকে অনেক হলেই রুটিনমাফিক কাজ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন হল-নেতারা। কাজেই নিরুপায় হয়েই এসব কাজে লিপ্ত হয় তারা। কিন্তু এসব কর্মকাণ্ড অধিকাংশের পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। অনেকেই আবার তথাকথিত বড়ভাইদের অনুগত বাহিনীতে যোগ দিতে নারাজ। তাই নেতাদের রোষানলে পড়ে তারা। তখন অনেককেই হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। হলে থাকলেও তাদের অনেকেই এক অসুস্থ পরিবেশের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে।
বাংলাদেশের রাজনীতি গত কয়েক বছর ধরে ক্ষমতাসীনদের বগলে। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা তথা ভোটাধিকার প্রয়োগ আজ নির্বাসনে। মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার আন্দোলনে বিরোধী দল বিএনপির অবস্থান নেই বললেই চলে। ছাত্রদলের অবস্থা নাজুক। কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের কমিটির অনেকেই অছাত্র হওয়ায় ক্যাম্পাসে তারা বহিরাগত হিসেবে খ্যাত। আর ছাত্রত্ব থাকলেও অনেকেই হুমকি ও মারধোরের ঘটনায় ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত। কাজেই সাধারণ ছাত্রকে নিয়ে বৃহত্তর গণআন্দোলন গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় তারা ব্যর্থ।
আগে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করেও তা থেকে পিছ-পা হয়েছে ছাত্রলীগের ভয়ে। হলে হলে ছাত্রদলের কোনো কমিটি নেই। কাজেই হলগুলোতে ছাত্রলীগের একক কর্তৃত্বই দৃশ্যমান। এমতাবস্থায় জাতীয় রাজনীতির মতো কোণঠাসা ছাত্রদল নামমাত্র সংগঠন হিসেবে টিকে আছে। বৃহত্তর দলের সংগঠন হিসেবে এর কোনো ভূমিকা গত কয়েকবছর ধরে দেখা যায়নি। সাধারণ ছাত্রদের মাঝে ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির পরিচিতিও তেমন নেই। হলের আংশিক কমিটিতে যারা আছেন, তাদের সাধারণ শিক্ষার্থীরা চেনেন না। ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের প্রার্থীরা স্বাধীনভাবে নির্বাচন প্রচারণায়ও অংশ নিচ্ছেন না। এমতাবস্থায় আগামী ১১ মার্চ নির্বাচনে তাদের অবস্থা কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়। প্রশ্ন হলো—ছাত্রদল নির্বাচনে এলো কেন? কয়েকদিন আগে জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘নিরঙ্কুশ’ বিজয়ের ফলে বিএনপির অবস্থা আরও নাজুক। সেখানে ছাত্রদলকে ছাত্রলীগ ছাড় দেবে না এটাই স্বাভাবিক। তারপরও ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
ছাত্রদলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় ছাত্রলীগ বেশি লাভবান হয়েছে। কারণ, ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল মধুর কেন্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে তারা প্রমাণ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব দলের সহাবস্থান আছে। ছাত্রলীগের কাছে নতজানু হয়ে ছাত্রদল সেলফি ও ফটোসেশন করে দেশের মানুষের কাছে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। কারণ গত কয়েক বছর ধরে তারা ছাত্রদলের কমিটিতে থাকলেও দেশের মানুষ তো বটেই শিক্ষার্থীদের কাছেও তারা অপরিচিত। এই সুযোগে তারা দেশের মানুষের কাছে মিডিয়ায় মুখ দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে। দলীয় নেতৃত্ব মজবুত করার জন্য তারা যতটা না সক্রিয়, তার চেয়ে ব্যস্ত নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করা। নির্বাচনের পর যখন ছাত্রলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে, তখন ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করে পিটিয়ে তাদের ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ তাড়িয়ে দেবে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। তখন ছাত্রদলের এই সহজ ও সস্তা উদ্দেশ্য ভেস্তে যাবে।
ডাকসু নির্বাচনে বারোটি প্যানেল তাদের প্রার্থী দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের সংগঠন ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য দলগুলোর মধ্যে ছাত্রদল তেমন প্রচারণায় সরব নয়। অন্যান্য দলগুলো সগৌরবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা সঞ্চার করেছে। শুরু থেকে ছাত্রদলসহ অন্য দলগুলো হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের জোর দাবি করলেও তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নাকচ করে দেন। ফলে অনেকের আশঙ্কা আছে নির্বাচনে একটি নীরব পেশীশক্তির ব্যবহারের। ইতোমধ্যে নির্বাচনি বিধি ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের প্রতি। প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার আগেই তারা পোস্টার ও দেয়াল লিখনের মাধ্যমে যে নির্বাচনি প্রচারণা চালাচ্ছে, তা বৈধ নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রশাসনের কোনো হস্তক্ষেপ দেখা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ১৯৭৩ সালে একবার ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগের নিরঙ্কুশ জয়ের জন্য ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। ব্যর্থ ছাত্রদলের পরাজয়ের মধ্য দিয়েই তাদের বিজয়ের পথ সূচিত হবে।
ছাত্রলীগের এ জয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর মধ্যে দ্বিধা আছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতারা যে প্রার্থী দিয়েছে, তাতে তারা বিচলিত। তাদের ধারণা, কোটাসংস্কার আন্দোলনে যেভাবে সাধারণ শিক্ষার্থী যূথবদ্ধ হয়েছিল নির্বাচনের ব্যালটে তার প্রতিফলন হলে ছাত্রলীগের কোমল সোভিত রাজ্যে তা হানা দিতে পারে।
ডাকসু নির্বাচনের গুরুত্ব কোনোক্রমেই অস্বীকার করা যায় না। এই নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হবেন, তারাই ভবিষ্যতে দেশের রাজনীতিতেও ভূমিকা রাখবেন। কাজেই জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে ডাকসু নির্বাচনের সেতুবন্ধন সহজেই অনুধাবন করা যায়। পাকিস্তান আমলে ১৯৬৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ডাকসুর নেতারা যে বলিষ্ঠ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তার গুরুত্ব সবার কাছে বিদিত। নব্বইয়ের দশকে ডাকসু স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। গত প্রায় তিনদশক ডাকসু না থাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট হিসেবে খ্যাত ‘ডাকসু’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬ হাজার শিক্ষার্থীর প্রতিনিধিত্ব করবে। জাতীয় রাজনীতির মতো ডাকসু নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে উচ্চশিক্ষার প্রতিনিধিত্বকারী এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। সেইসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন অনুষ্ঠানের গৌরব ও সুনাম হবে বিনষ্ট।
প্রশাসনের সদিচ্ছার মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করা উচিত। কারণ, এই নির্বাচনের দিকে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়, দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে। অন্যদিকে ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে দেশের অন্যান্য বিদ্যাপীঠেও এরূপ নির্বাচনের বৈতরণী উড়বে। তাই প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, তারা যেন দলীয় স্বার্থসিদ্ধি না করে নৈর্ব্যক্তিক অবস্থানে থেকে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন উপহার দেয়। আর এরূপ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ডাকসুর সেই স্বর্ণালি দিনগুলো ফিরে আসবে—এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়