শেষ হয় না আগুনের দিন!
৩০ মার্চ ২০১৯ ১৪:৫৫
খুব কম দিনের ব্যবধানে আগুনের ভয়াবহতা আবারও দেখল বাংলাদেশ। একুশ ফেব্রুয়ারিতে চকবাজারের আগুন এবং ২৮ মার্চে আগুন বনানীতে। এমন না যে, আমরা এর আগে আগুনের ভয়াবহতা দেখিনি। চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে নিমতলী, তাজরীন গার্মেন্টস বা এনটিভি ভবনের আগুনের ঘটনা। কত প্রাণ গেলো! কত অঙ্গীকার। আর কত হেলায় হারানো জীবন। এর থেকে কী শিক্ষা পেলাম না পেলাম, সেটার থেকে আরও কিছু বিষয় আছে।
খুব দূরে না যাই। চকবাজার ও বনানী হোক আজকের বিষয়।
চকবাজারের ঘটনার পর রাস্তার প্রশস্ততা, পানির অভাব, ফায়ার সার্ভিসের সরঞ্জামের অভাব ইত্যাদি নিয়ে আলাপ হয়েছে। সবসময় আলাপ হয় মানুষের ভিড় করা নিয়ে। এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা সমালোচনা হতেই থাকে। শুধু তাই নয়, চক বাজারের ঘটনায় বিল্ডিং, ব্যবসা ইত্যাদি নিয়েও আলাপ হয়েছে। এবার ফিরে আসি বনানীতে। আলাপ করি একটু ভিন্ন বিষয় নিয়ে।
১. এফ আর টাওয়ার অর্থাৎ ফারুক রূপায়ন টাওয়ার বিশাল বড় বিল্ডিং। জনপ্রিয় অফিস স্পেস। আছে হেরিটেজ এয়ার এক্সপ্রেস ও আমরা নেটওয়ার্কের মতো কোম্পানিরও অফিস। অর্থাৎ সারাটা বিল্ডিং মানুষে গিজ গিজ করে। এই অফিস ভবনে কি অটো ফায়ার স্প্রিংকলার আছে? যখন স্পেস ভাড়া দেওয়া বা নেওয়া হয়, মাস শেষের নগদ টাকা বুঝে পাওয়ার দিন টুকে নেওয়া হয়, সেখানে কি এ প্রয়োজনীয় বিষয়টির উল্লেখ থাকে? ফায়ার এস্কেপ বা ইমারজেন্সি এক্সিট বলে যে বিষয়টা আছে, সেটা কি আপনারা জানেন? না হয় পুরান ঢাকার লোকজন লোভী বেশি, লুঙ্গি পরে, নতুন ঢাকার আধুনিকতার সংজ্ঞা কী তাহলে? কেন এই উঁচু ও আধুনিক ভবনে এই বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করা হচ্ছে? ব্যবসা করার জন্যই যদি এই উপেক্ষা হয়, তাহলে এই বিষয়গুলোও আলোচনায় আনা প্রয়োজন। এখানে মানুষের জান, মাল ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কযুক্ত!
২. ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের নিয়ে আমাদের গর্ব করা দরকার। কারণ তাদের অবস্থা হয়েছে এমন, হাত পা বেঁধে সমুদ্রে নামিয়ে বলা, এবার যাও তো সাঁতার কেটে আসো! ভাবতে অবাক লাগে, দেশটায় বড় বড় ভবন হয় কিন্তু ইলেকট্রিক ল্যাডার একটা! কোনো সেফটি নেট দেখলাম না! কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। বড় বড় ভবন হচ্ছে অথচ অত উচুঁতে ওঠার মই নেই! আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ট্রেনিং দেওয়া হয় কি না, জানি না। কিন্তু প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তাদের ক্লান্ত হয়ে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ার ছবি দেখি। খুব বেশি কি হয়ে যায় তাদের সুযোগ সুবিধা এবং আধুনিক করতে? ফুটওভার ব্রিজ না বানিয়ে যেমন দক্ষচালক নিশ্চিত করা যায়, তেমনই কিছু হলে জনগণকে গালি না দিয়ে ফোর্সকে আরও ক্ষমাতায়ন করা যায় কিন্তু।
৩. যারা চাকরি দেন তারা তো আপনার বেডরুমের কথাও জিজ্ঞেস করে। কবে বিয়ে করবেন, বাচ্চা নিবেন কবে, কিন্তু আপনারা কি জিজ্ঞেস করেন, আগুন লাগলে কী ব্যবস্থা আছে? ভূমিকম্প হলে? অথবা টেরর অ্যাটাক? আপনার জানমালের রক্ষা কি কোনো অফিস করে যে, আপনারা তাদের জন্য জান দিয়ে চাকরি করেন? না হলে এখন থেকে জিজ্ঞাসা করবেন অন্তত। আর এমন বিল্ডিং যেখানে নিরাপত্তা নেই, সেখানে অপিস স্পেস ভাড়া না নিতে থাকলে মালিকরা এমনিতেই বাধ্য হবেন সব সুবিধা দিয়ে বিল্ডিং বানাতে। যে মালিক আপনার প্রাণের মূল্য দেয় না, তার সঙ্গে লুঙ্গিপরা বা গার্মেন্ট মালিকের (যাদের আমরা গালি দেই আর কী) তাদের কিন্তু কোনো পার্থক্য নেই।
৪. যুগের চাহিদা এসি থাকবে অফিসে! কিন্তু এমন দুর্যোগপ্রবণ একটি শহরে বারান্দা থাকতে পারবে না, এমন কোনো যুক্তি কি আছে? জানালা খোলার ব্যবস্থাও কি রাখা যায় না? কেউ কি ভেবে দেখেছেন? উন্নত শহরে বা দেশে অনেক ফরমেটেই অনেক কিছু করা হয়, সব তো আপনার দেশে করা সম্ভব না। আপনার দেশে বরফও পড়ে না। বরং মানুষগুলো যেন বেঁচে থাকে সেটাই কি মাথায় রাখা প্রয়োজন না? ধরুন, আপনি পুরান ঢাকা নিয়ে বলতে গেলে যা বলবেন কোনোটাই তো মেলে না। ভবনের নির্মাতা শিক্ষিত, অফিস যারা নেন তারা শিক্ষিত, যারা যায় কাজ করতে তারাও শিক্ষিত। তারা তো স্প্রে বা নকল পারফিউম বানান না। তাদের লোভটা কিসে? কেন তারা নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবেননি? বিল্ডিং-এর আশেপাশে এত অনিয়ম, এটা কি প্রশাসনের চোখে পড়েনি? কোনো জায়গায় তার ঝুলছে, কোনখানে জটলা পাকিয়ে আছে। কেউ কি দেখেছে? পুরান ঢাকায় না হয় ভবন ভাঙা হবে, আর এখানে? রাস্তা প্রশস্ত করতে! এখানে তো রাস্তাও আছে ! সেই তো মানুষকেই দোষ দেওয়া হবে!
৪. কিছু হলেই ইতিউতি করে অন্যদিকে পিছলে যাই। কারণও আছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর সাধারণ জনতা এগিয়ে গিয়েছিল। সাহায্য করতেই। কিন্তু তাদের তো সেই প্রশিক্ষণ নেই। তারা এভাবে মৃত্যু দেখতে অভ্যস্ত নয়! ফলে কত মানুষ মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। কতমানুষ আত্মহত্যা করেছে। তা থেকে কী শিখলাম? কিছুই না। আজও বনানীর অগ্নিকাণ্ডে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছে। শুধু দেখতে। এই ভিড়টা আমাদের ফায়ার সার্ভিসকে আরও মন্থর করে দেয়। আমি নিজে দুইটি ভিডিও দেখে মরে যেতে চাইছি, যারা সামনাসামনি দেখলেন তারা কী করে ঠিক আছেন? সবার জন্য সব কাজ নয়! এটা আমরা বুঝব না। মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ এই শহরে প্রতিদিন নতুন মানুষ আসে, যারা শহর মানে শুধু টাকা বোঝে, আদব-কায়দা নয়। উন্নত বিশ্বের মতো না ভেবে আগেই এখানে পুলিশ নামানো দরকার। অন্তত ফায়ার সার্ভিসকে সহায়তা করার জন্য। যে দেশে একটা মানুষকে হত্যার সময়েও সবাই দেখে হা করে, তাদের কাছে কি কাণ্ডজ্ঞান আশা করেন! বরং তাদের কাণ্ডজ্ঞান বিবেচনা করে আঁটঘাট বাধাই কী ঠিক নয়? আর চব্বিশ তলা বিল্ডিং! ধরুন, আপনার আত্মীয় সেখানে আটকাপড়েছেন, আপনি তো যাবেনই তাই না? দলবল নিয়েই যাবেন! দোষ নিয়ে পিলোপাস না করে সমাধানটা বের করা জরুরি।
৫. আবারও বাচ্চারাই পথ আগলে ধরলো, সামাল দিলো খানিকটা হলেও। সামনের ভবন থেকে দেখা এক নারী নিজে বলেছেন তরুণরা, স্কুলের বাচ্চারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। অতএব দেশের আগামী খুব বেশি অন্তঃসারশূন্য নয়।
দোষারোপ করতে গেলে যা হবে, তা হলো ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়! বরং সহজ সমাধানটা আজই বের করা দরকার! অ্যাক্সিডেন্ট হলে ফুটওভার ব্রিজ বানানো সমাধান না, দক্ষ চালক দিয়ে বাস চালানো নিশ্চিত করা হলো আসল সমাধান, আগুন লাগলে পানির ব্যবস্থা করা সমাধান না, বরং আগুন যেন নাই লাগে এবং তাৎক্ষণিক আগুন নির্বাপণ সুবিধা নিশ্চিত করা হলো সমাধান। সেটা না করে যা হচ্ছে, তাহলো চোখ সয়ে যাওয়া। কারওয়ান বাজার বা বসিলার আগুন কিন্তু আলাপেই আসেনি। চক বাজারের পরের ঘটনা এটা! আবরারের পর রাস্তায় প্রাণ হারিয়েছে আরও শিক্ষার্থী! এই চোখ সয়ে যাওয়াটা মানুষ ও মানবিক মানদণ্ডে ভালো কিছু অবশ্যই নয়!
লেখক: সাংবাদিক