মুক্তিযুদ্ধের টুকরো টুকরো অমূল্য স্মৃতি
১৮ এপ্রিল ২০১৯ ২০:১৯
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার খাগড়াছড়ির সার্কেল অফিসার। খাগড়াছড়ি তখন মাত্র একটি ইউনিয়ন। আমার পদবি ছিল সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) মহালছড়ি, হেড কোয়ার্টার খাগড়াছড়ি। আজকের দিনের পালছড়ি, খাগড়াছড়ি, মহালছড়ি ও লক্ষ্মীছড়ি—এসবই ছিল আমার কর্মক্ষেত্র। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে রামগড় মহকুমাটি খাগড়াছড়িতে স্থানান্তরিত হয়। মহকুমা অফিসার রামগড় থেকে খাগড়াছড়ি চলে আসেন। আগে থেকে আমি সেখানে ছিলাম।
যাইহোক কিছুদিন থেকে রেডিও, পত্র-পত্রিকার মারফত মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনছিলাম। স্থানীয় জনসাধারণ, বিশেষ করে নেতৃস্থানীয় লোকজন আমার কাছে জানতে চাইছিল কী হতে পারে? আমি তখন যুবক অফিসার। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে আমি খুব উদ্দীপ্ত হয়ে পড়তাম। কারণ আমি পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীকে একদম পছন্দ করতাম না। এর পেছনে ছেলেবেলার একটি ঘটনা আমাকে তাদের প্রতি বিদ্বেষ ভাব এনে দিয়েছিল। দেশ ভাগের পর ১৯৫০ এ আমি তখন মেহেরপুর হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। সেই সময় আমি আমার গ্রাম আমঝুপি থেকে বাই সাইকেলে চেপে স্কুলে যেতাম। মেহেরপুর হোটেল পাড়ার মোড়ে ইস্তুল নামে এক পান বিড়ির দোকানদার ছিল। একদিন পাঞ্জাবি আর্মির এক সুবেদার এসে একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের সিগারেট চাইল। ইস্তুল বললো, ওই সিগারেট তার দোকানে নেই। সুবেদার দোকানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো, ওই যে দেখা যায়। উত্তরে দোকানদার জানালো ওগুলো খালি প্যাকেট। সাজিয়ে রাখা হয়েছে। একথা শুনে পাঞ্জাবি সুবেদার রেগে গিয়ে বললো, ‘সালে লোক বাঙাল বেঈমান হেয়, আওপাঞ্জাবি শের হ্যায়, ইয়ে কায়দে আজম মান তা হ্যায়।’ কথাটা আমাকে ভীষণ আঘাত করলো। কিন্তু আমি তখন ১৩-১৪ বছরের বালক কীই-বা করতে পারি। কিন্তু বিষয়টা আমি কোনোদিন ভুলিনি।
যাইহোক বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধ ঘোষণা করলেন তখন আমার মনে পাঞ্জাবিদের সেই মনোভাব মনে পড়লো। আমরা সবাই মিলে কোর্ট বিল্ডিংয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুললাম। কিন্তু তখনকার এসডিও এবং সেকেন্ড অফিসার ছিলেন ভীরু প্রকৃতির। তারা পতাকা নামিয়ে ফেললেন। একথা জানা জানি হলে খাগড়াছড়ির মুক্তিযোদ্ধারা যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন দোস্ত মোহাম্মদ নামে এক আনসার কমান্ডার। সে বিরাট দলবল নিয়ে কোর্ট বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে আসছিল। পথে আমার অফিস। তিনি আমাকে বললো, ‘স্যার এসডিও সাহেব বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে দিয়েছেন। আমরা আবার পতাকা তুলবো এবং এসডিওকে খুন করবো।’
তার কথা শুনে আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম এবং বললাম এসডিওকে মারার আগে আমাকে মারো। তখন সে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো এবং আমিও কেঁদে উঠলাম। তারপর সবাই মিলে জয় বাংলা ধ্বনি দিতে দিতে কোর্ট বিল্ডিংয়ে গেলাম এবং আবার বাংলাদেশের পতাকা তুললাম।
ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসক জনাব এইচটি ইমাম (বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা)। রামগড়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প স্থাপন করলেন। চেংগী নদীর ওপর বাঁশের সাঁকো করে ভারতের সাব রুমের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ভারত থেকে অস্ত্রশস্ত্র আসার ব্যবস্থা করলেন। আমি খাগড়াছড়ি থেকে রামগড় এসে তার কাজে সহায়তা করা শুরু করলাম। তিনি আমাকে ও একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দিলেন। রাঙ্গামাটি ট্রেজারি লুট করে, টাকা-পয়সা মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে জমা দিতে। আমরা দু’জন রওনা দিলাম। কিন্তু পথিমধ্যে সংবাদ পেলাম রাঙ্গামাটি পাকিস্তান আর্মি দখল করে নিয়েছে। সদর মহকুমা প্রশাসক আব্দুল আলি তাদের হাতে নিহত হয়েছেন। আমরা দুজন ফিরতে বাধ্য হলাম। যুদ্ধ চলতে লাগল আমরা ডিসি সাহেবের নেতৃত্বে কাজ করতে লাগলাম।
দিন তারিখ মনে নাই; আমি খাগড়াছড়ি হতে একটা চান্দের গাড়ি (ভাড়ায় চালিত বিশেষ জিপ) নিয়ে রামগড় গেলাম এবং সারাদিন কাজকর্ম করে দিনের শেষে খাগড়াছড়ি ফেরার উদ্যোগ নিলাম। কিন্তু জিপওয়ালা জানালো তার গাড়িতে তেল দরকার। আমি তখন তেল বিক্রেতার ওখানে গিয়ে জিপের জন্য তেল দিতে বললাম। সে বললো, মেজর সাহেবের স্লিপ ছাড়া সে তেল দিতে পারবে না।
একটা কথা তখন আমাদের কানে এসেছিল—মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গোপসাগরে ‘সোয়াত জাহাজ’ থেকে পাকিস্তানিদের পক্ষে অস্ত্র খালাস করতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে মেজর রফিকুল ইসলাম তাকে বাধা দেন এবং ফিরিয়ে এনে রামগড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে বলেন।
তো বাধ্যই হয়ে আমি মেজর জিয়ার কাছে গেলাম। তিনি তখন রামগড় পোস্ট অফিস বিল্ডিংয়ের ওপর তলায় থাকতেন। আমি সেখানে দেখলাম মেজর জিয়া খুব উত্তেজিতভাবে পায়চারী করছেন। তার পরনে খাকি প্যান্ট কিন্তু গাঁয়ে তখনকার দিনের গুলটেকস-এর চেক শার্ট। তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে কয়েকজনের সঙ্গে হম্বিতম্বি করছেন। বলছেন, ‘আনপ্রিপেয়ার্ড ওয়্যার ডিক্লেয়ার করে তিনি (বঙ্গবন্ধুকে ইঙ্গিত করে) এখন সেফ পজিশনে বসে আছেন।’
মেজরের মূর্তি দেখে কিছুটা সংকোচের সঙ্গে আমার পরিচয় দিলাম এবং বললাম আমার জিপের জন্য কয়েক গ্যালন পেট্টোল দরকার। এ কথা শুনে রেগে গিয়ে বললেন, ‘I can’t spare petrol’। বাধ্য হয়ে ফিরে এসে ডিসি এইচটি ইমামকে বললাম, স্যার আমি পেট্রোল এর জন্য মেজর সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে পেট্রোল দিলেন না। তখন ডিসি বললেন, আমার সঙ্গে আসুন। আমি তার সঙ্গে পুনরায় মেজর জিয়ার কাছে গেলাম। ডিসি আমাকে তার কাছে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মেজর বললেন, ‘yes I met him’। ডিসি বললেন, আপনি তাকে পেট্রোল দিলে সে খাগড়াছড়ি থেকে আরও পেট্রোল এবং খাদ্য-সামগ্রী পাঠাতে পারবে। এরফলে তিনি রাজি হয়ে কয়েক গ্যালন পেট্রোল দিলেন। আমি খাগড়াছড়ি থেকে তাকে এক ব্যারেল পেট্রোল ও আটা ইত্যাদি খাবার নিয়ে পরদিন দিয়ে আসি।
এখানে একটা কথা উল্লেখ করি, আমার স্ত্রী তখন গর্ভাবস্থায় আমার গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরের আমঝুপি অবস্থান করছিলেন। আমি তার গর্ভস্থ সন্তান ও আরও দুটি মেয়ের জন্য ভীষণ উদ্বিগ্ন ছিলাম। রামগড়ে হঠাৎ আমি আমার গ্রামে আমাদের পাশের বাড়ির আব্দুল হান্নানকে দেখতে পেলাম। ভদ্রলোক মেহেরপুরের লোক হলেও চট্টগ্রামে বিয়ে করে চট্টগ্রামবাসী হয়ে যান এবং দক্ষতার গুণে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি হন। তাকে আমার অবস্থার কথা জানালাম। তিনি বললেন, তুমি আগরতলা হয়ে বাড়ি চলে যাও। তোমার পরিবারের সঙ্গে মিলিত হও। যদি দরকার হয় তোমাকে আওয়ামী লীগের প্যাডে একটি পরিচিতিপত্র দেব। আমি ইন্ডিয়া যাবো, এ কথা চিন্তা করে ডিসি এইচটি ইমামকে বললাম, স্যার আমার সরকারি তহবিলে ১২,০০০/- নগদ টাকা আছে। ওটা আমি মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে দিয়ে দিতে চাই। তিনি বললেন, ঠিক আছে, আপনি তাই করুন। আমি বললাম, টাকাটা নিযে আমাকে একটা রশিদ দিতে হবে। আমি সেটা ক্যাশ বইয়ে গেঁথে রাখবো। যেন ভবিষ্যতে আমি বিপদে না পড়ি। তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে আমাকে রশিদ দিতে রাজি হলেন। আমি তাকে টাকা দিয়ে রশিদ ক্যাশ বইয়ে খরচ লিখে রাখলাম। এতে মুক্তিযুদ্ধের খরচ চলবে ভেবে বেশ আনন্দিত হলাম।
ইমাম সাহেব এ সময় তার সরকারি জিপ নিয়ে আগরতলায় যাতায়াত করতেন। আমি একদিন বাসার সব মালপত্র ফেলে রেখে তার জিপে করে আগরতলা গেলাম। সেখান হতে একদিন ট্রেনে কলকাতা রওয়ানা দিলাম। কলকাতা শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে দেখা হলো আমাদের মেহেরপুরের আব্দুর রশিদ নামে এক উকিলের সঙ্গে। সে ছিল আমার বয়সে ছোট এবং এক বন্ধুর আত্মীয়। যাইহোক, সে আমাকে বললো, হুদা ভাই, আমি আপনাদের পরিবারের লোকজনকে একটা গরুর গাড়িতে চড়ে বর্ডারের দিকে আসতে দেখেছি।
উল্লেখ্য, আমাদের বাড়ি আগে নদীয়া জেলায় ছিল। ১৯৫০ সালে পরিবারের সদস্যরা কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার আমঝুপি গ্রামে চলে আসে। নদীয়া জেলায় আমার বড়বোনের বাড়ি। আমি শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে পাগলাচণ্ডী স্টেশনের কাছে রাধাকান্তপুর গ্রামে বোনের বাড়ি গেলাম। সেখানে জানতে পারলাম, আমার পরিবারের সদস্যরা নেই। শুনলাম, বারুই পাড়া নামে অন্য গ্রামে তারা আমার আরেক আত্মীয়ের বাড়িতে আছে। সেখানে গেলাম এবং তাদের পেলাম। সেখানে একটা গোয়াল ঘরের পাশে একটা ঘরে কোনো রকমে আমার স্ত্রী ও তিনটি সন্তান আছে। ৪ এপ্রিল, ১৯৭১ এ জন্ম নেওয়া আমার শিশুটির তখন মরণাপন্ন অবস্থা।
সুখে-দুখে প্রায় পাগলপারা হয়ে কী করা যায়, তা চিন্তা করে বাড়ি ফিরে আসতে চেয়েছিলাম। তাহলে হয়তো শিশুদের বাঁচানো যাবে। বেশি চিন্তা না করে গ্রামের আরও একজন ফিরছিলেন, তার সঙ্গে আমঝুপিতে স্বপরিবারে ফিরে এলাম। কিন্তু সেখানেও স্বস্তি হলো না। দিন কয়েকেই রাজাকাররা আমার খোঁজ খবর নিতে শুরু করলো। আমার এক ছোট ভাইকে আর্মি ধরে নিয়ে গেলো। তখন ভাবলাম ঢাকা কিছুটা শান্ত। ঢাকায় আমাদের কেউ চিনবে না। তাই ঢাকায় চলে আসার মনস্থির করলাম। একদিন চলেও এলাম।
যাই হোক, ঢাকায় এসে এক আত্মীয়ের আজিমপুরে সরকারি বাসায় উঠলাম। সেখানে সেই ভদ্রলোকের বোঝা হয়ে থাকতে ইচ্ছে হলো না। তার ওপর সাংঘাতিক অর্থকরী সমস্যা। তারপরও পরিবারকে সেখানে রেখে আমি নানা ঝক্কি নিয়ে কোনো রকমে রাঙ্গামাটি পৌঁছালাম। কয়েক মাস পালিয়ে থাকার দরুণ বেতন তোলা হয়নি। আমি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এর রাঙ্গামাটি শাখায় ম্যানেজারকে বললাম, আমার বেতন তোলা যায় কি না। তখন ট্রেজারি মারফত ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে আমাদের বেতন তোলা যেত। তিনি বললেন, আপনি একটা জয়েনিং রিপোর্ট দেন। তার কপি একটা আমাদের দেন। আমি সেই অনুযায়ী কাজ করলাম। আমার কয়েক মাসের বেতন তুলে টাকাটা নিয়ে আবার আত্মগোপন করলাম। এবং পরিবারের কাছে টাকাটা পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম। ততদিনে আমার পরিবার ঢাকায় থাকতে না পেরে সন্তানসহ আমার আত্মীয়ের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলায় চলে গেছে। এরূপ নানা ঘাত-প্রতিঘাত মানসিক কষ্ট বিপদ কাটলে দেশ স্বাধীন হলে আবার পরিবারসমেত খাগড়াছড়ির বাসায় উঠলাম। সেখানে আসবাবপত্র সব খোয়া গেছে। কোনো রকমে বাসায় থেকে আবার চাকরি করতে লাগলাম। পরে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারীতে চলে গেলাম।
এভাবে নানা ঘাতপ্রতিঘাত আর বিপদ মাথায় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস পার করি। বুকের ভেতরে বিশ্বাস ছিল, দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। কারণ এই স্বাধীনতার ডাক তো দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনিই স্বাধীনতার ঘোষক। তার অনুপস্থিতিতে যিনি রেডিওতে এ ঘোষণা দেন, তিনি আব্দুল হান্নান। যিনি আওয়ামীলীগের চট্টগ্রাম জেলার জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। এরপরে মেজর জিয়া আবারও ঘোষণা দিয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে আমি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে অবসর নিয়ে এখন অবসর জীবন যাপন করছি। আজ ৮৩ বছর বয়সে লিখলাম, যেটুকু মনে আছে। আমি মনে করি, যেকোনো জাতির ইতিহাসের এসব টুকরো টুকরো অংশও মূল্যহীন নয়।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এমএম